বয়সের ভারে ন্যুব্জ শরীর। চলাচলের একমাত্র ভরসা লাঠি। এরপরও বেঁচে থাকতে প্রতিনিয়ত সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন স্বাধীনতা যুদ্ধে নিজের সর্বস্ব খোয়ানো শরীয়তপুরের ৮৫ বছর বয়সী বীরাঙ্গনা যোগমায়া মালো। রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পেলেও মেলেনি একটি সরকারি ঘর। অন্যের জমিতে টিনের দোচালা ঘর তুলে ভাড়ায় কোনোমতে দিনযাপন করে যাচ্ছেন তিনি। অভিযোগ, একাধিকবার সরকারি দপ্তরে ধরনা দিয়েও মেলেনি নিজের একটি কাঙ্ক্ষিত ঠিকানা। মৃত্যুর আগে অন্তত নিজের ঘর দেখে যেতে চান তিনি।
Advertisement
যোগমায়া মালো, তার পরিবার ও স্থানীয় বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সূত্রে জানা যায়, ১৯৭১ সালের ২২শে মে। সেদিন শরীয়তপুর সদরের মনোহর বাজারের দক্ষিণ মধ্যপাড়ার হিন্দু এলাকায় তাণ্ডব চালায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। প্রতিটি ঘর থেকে তুলে আনা হয় হিন্দু নারী-পুরুষ আর গৃহবধূদের। সেদিন সবার সঙ্গে তুলে আনা হয় নেপাল চন্দ্র মালোর স্ত্রী যোগমায়া মালোকে। তখন ১৫ বছরের কিশোরী গৃহবধূ ছিলেন তিনি। বেশ কয়েকজনকে মধ্যপাড়া এলাকায় গুলি করে হত্যার পর অন্তত ১০০ জন নারী-পুরুষকে ধরে লঞ্চে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় মাদারীপুরের এআর হাওলাদার জুট মিলে। সেখানে পুরুষদের অনেককেই গুলি করে হত্যা করা হয়। আর নারীদের ৩ দিন ৩ রাত আটকে রেখে চালানো হয় পাশবিক নির্যাতন। সেই নির্যাতন শেষে ছাড়া পেয়ে যোগমায়া মালো ফিরে আসেন স্বামীর কাছে।
একাত্তরের হানাদার বাহিনীর পাশবিকতার ভয়াল স্মৃতি এখনো মনে পড়লে আঁতকে ওঠেন যোগমায়া মালো। স্বাধীনতার ৪৭ বছর পর ২০১৮ সালে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি মেলে তার। তবে দীর্ঘ ৫৩ বছর ধরে মনের ক্ষত বয়ে বেড়ানো এই বীরাঙ্গনা থাকছেন অন্যের আশ্রয়ে। দুই ছেলে অশোক মালো ও উত্তম মালো পেশায় জেলে। তারা ঋণ করে তিন বছর আগে মায়ের নামে ৪ শতাংশ জমি কিনেছেন একটি ঘর পাবেন বলে। তবে এখনো ঘর পাননি তিনি। একাধিকবার সরকারি দপ্তরে আবেদন জানিয়েও আশ্বাস ছাড়া আর ভাগ্যে জোটেনি ঠিকানা।
যোগমায়া মালোর পুত্রবধূ ডলি মালো বলেন, খুব কষ্টে টিনের একটি ঘরে শাশুড়ি, স্বামী আর সন্তানদের নিয়ে থাকি। অনেক মুক্তিযোদ্ধাইতো ঘর পেলো, কিন্তু আমার শাশুড়ি একজন বীরাঙ্গনা হয়েও ঘর পেলো না। জমি থাকলে সরকার থেকে ঘর দেওয়া হবে, সেই আশায় ঋণ করে জায়গা কিনেছি। তবে এখনো একটা ঘর পাইনি। সরকার থেকে যদি একটা ঘর দিতো তাহলে আমার শাশুড়ি অন্তত মৃত্যুর আগে সেটা দেখে যেতে পারতেন।
Advertisement
প্রতিবেশী লিপি রানী সাহা বলেন, বিজয় দিবস এলেই অনেকে তার কাছ আসেন। কিন্তু তিনি আজও একটি ঘর পেলেন না। নিজের ঘর নেই, তাই অন্যের জায়গায় ভাড়ায় ছোট একটা টিনের ঘরে খুব কষ্ট করে থাকেন। আমরা চাই সরকার থেকে ওনার জন্য একটি নতুন ঘর করে দেওয়া হোক।
বীরাঙ্গনা যোগমায়া মালো বলেন, সেদিন আমার চোখের সামনে ভাসুরকে গুলি করে হত্যা করেছিল মিলিটারিরা। আমাকে ধরে নিয়ে ৩ দিন আটকে রেখে অপমান করা হয়েছিল, নির্যাতন করা হয়েছিল। আজ বয়স হয়ে গেছে, এখনো নিজের একটি ঘর হলো না। যাদের বাড়ি থাকি তারা দূর দূর করে তাড়িয়ে দিতে চায়। মানুষ জায়গাসুদ্ধ ঘর পায়। আমি তো জায়গা চাই না। আমি শুধু একটা ঘর চাই। আপনারা আমাকে একটা ঘর করে দেন, যাতে সন্তানদের নিয়ে থাকতে পারি।
বীরাঙ্গনা যোগমায়া মালোর আবেদন পর্যালোচনা করে দ্রুত সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়ার কথা জানিয়েছে জেলা প্রশাসন।
শরীয়তপুরের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আশরাফ উদ্দিন বলেন, বীর মুক্তিযোদ্ধা আর বীরাঙ্গনারা জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান। তাদের জন্য রাষ্ট্রীয় যতো সুযোগ সুবিধা রয়েছে তার ব্যাপারে সর্বাত্মক সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেবো। বীরাঙ্গনা যোগমায়া ঘরের জন্য যে আবেদনটি করেছেন তা আমরা পর্যালোচনা করবো। বীর নিবাসের জন্য সরকারি নীতিমালা অনুযায়ী ওনার প্রাপ্যতা কতোটুকু তা আমরা বিধি মোতাবেক পর্যালোচনা করে আশু পদক্ষেপ গ্রহণ করবো। একইসঙ্গে বীর নিবাস সংশ্লিষ্ট কোনো জটিলতা যদি থেকেও থাকে, আমরা অন্য কোনোভাবে জেলা প্রশাসন থেকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেবো।
Advertisement
এফএ/এমএস