দেশজুড়ে

বিদ্যুৎহীন দুর্বিষহ জীবন চর আষাড়িয়াদহে

আধুনিক সভ্যতায় বিদ্যুৎবিহীন দৈনন্দিন জীবন অকল্পনীয়। দুর্ভোগের শেষ থাকে না। তবে বিশ্বায়নের এই যুগেও বিদ্যুৎবিহীন জীবন কাটছে রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার চর আষাড়িয়াদহ ইউনিয়নের ৪০ হাজার মানুষের। সন্ধ্যার পর তাদের ভরসা মোমবাতি, কুপি বাতি ও হারিকেনের আলো।

Advertisement

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পদ্মা নদী সংলগ্ন উপজেলার পিরিজপুর থেকে চর আষাড়িয়াদহের দূরত্ব মাত্র পাঁচ কিলোমিটার। পিরিজপুরে বিদ্যুৎ ও ইন্টারনেটের সব সুবিধা থাকলেও বিপরীত চিত্র স্বল্প দূরত্বে নদীর ওপারে থাকা পুরো ইউনিয়নে। বৈদ্যুতিক সংযোগ না থাকায় নানাভাবে পিছিয়ে সমগ্র চরবাসী। লাগেনি আধুনিকতার ছোঁয়া।

২০১৫ সালে সরকারের ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি লিমিটেডের (ইডকল) কারিগরি সহযোগিতায় পুরো ইউনিয়নে সৌর বিদ্যুতের প্ল্যান্ট স্থাপন করে বেসরকারি সংস্থা আভা। আভা মিনি গ্রিড প্রজেক্ট প্ল্যান্টের মাধ্যমে চরের এক হাজার ৩০০ পরিবার বিদ্যুতের সংযোগ পায়। তবে এতেও ভাগ্য সহায় হয়নি চরের বাসিন্দাদের। স্বাভাবিক বিদ্যুৎ মূল্যের দ্বিগুণেরও বেশি দাম দিয়েও ছিল না স্বাভাবিক বিদ্যুৎ সরবরাহ। লোকসানের মুখে গত জুনের মাঝামাঝি সেটিও গুটিয়ে নেয় কর্তৃপক্ষ।

চরের বাসিন্দা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ইমাম হোসেন বলেন, ‘আগের (আভা মিনি গ্রিড প্রজেক্ট) যে বিদ্যুৎ ব্যবস্থা ছিল সেটাতেও চরের মানুষ খুব বেশি লাভবান হতো না। গ্রামে ১০০ বাড়ি থাকলে হয়তো ২০টির মতো বাড়িতে ওই বিদ্যুৎ সুবিধা পেতো। তারাও সারাদিন নির্বিঘ্নে বিদ্যুৎ সুবিধা পেতেন না। আমাদের চরে ৭ থেকে ১০ মেগাওয়াট বিদ্যুতের চাহিদা। সেখানে ওই প্রকল্পের মাধ্যমে সরবরাহ হতো মাত্র ৬০ কিলোওয়াট।’

Advertisement

তিনি বলেন, আমরা বিভিন্নভাবে আমাদের বিদ্যুতের প্রয়োজনীয়তা নেসকোকে জানিয়েছি। তারা আমাদের সোলার প্ল্যান্ট দিতে আশ্বস্ত করেছেন। কিন্তু এতে আরও সংকট বাড়বে। কারণ একটা সোলার প্ল্যান্ট করতে ৬০-৭০ বিঘা জমি প্রয়োজন। চরে এই পরিমাণ জমি প্ল্যান্টে দিতে হলে কৃষিতে একটা নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। তাই নদীর তলদেশে সাবমেরিন ক্যাবলের মাধ্যমে ১০ মেগাওয়াট বিদ্যুতের লাইন চালুরও দাবি জানান তিনি।

চর আষাড়িয়াদহের দিয়ার মানিকচর গ্রামের সন্তান আব্দুল্লাহিল কাফি। সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়াশোনা শেষ করে রাজশাহীতে ইলেকট্রনিক্স পণ্য বিক্রি করেন। জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বলতে গেলে চরে কখনোই বিদ্যুৎ ছিল না। সোলার প্ল্যান্টের মাধ্যমে পুরো ইউনিয়নের একটা অংশ বিদ্যুৎ পেতো, সেটাও দিনের একটা অংশ এবং কম ভোল্টেজের। আমরা যে কোনো মূল্যেই চরে বিদ্যুৎ সংযোগ চাই।’

আব্দুল্লাহিল কাফি বলেন, ‘নেসকোকে বারবার বলার পর ক্যাবলের মাধ্যমে সংযোগ চালুর একটা উদ্যোগ নিয়েছিল। কিন্তু তৎকালীন এমপি ফারুক চৌধুরীর কাছের লোক কাজ না পাওয়ায় তার গাফিলতির কারণে পুরো প্রকল্প বন্ধ হয়ে যায়। আসলে কোনো রাজনৈতিক দলের কাছেই চরে বিদ্যুতের প্রয়োজনীয়তা গুরুত্ব পায়নি। সবার কাছেই আমরা বঞ্চিত থেকেছি।’

চরের বাসিন্দা ও রাজশাহী কলেজের শিক্ষার্থী আব্দুল আলিম বলেন, ‘রাজশাহী শহরের জীবন আর চরের জীবনের মধ্যে আকাশ-পাতাল তফাৎ। বিদ্যুৎ ছাড়া এই যুগে কিছুই ভাবা যায় না। কিন্তু যখন বাসায় থাকি তখন পুরো লাইফস্টাইলই বদলে যায়। বিদ্যুৎ না থাকায় চরের যারা পড়াশোনা করে, তাদের অনেক দুর্ভোগ পোহাতে হয়। আধুনিক বিশ্ব থেকে তারা অনেক পিছিয়ে থাকে। যেভাবেই হোক, এই বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধান হওয়া জরুরি।’

Advertisement

চর আষাড়িয়াদহ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আসরাফুল ইসলাম বলেন, নেসকোকে অনেকবার বলার পর তাদের পক্ষ থেকে জরিপ চলছে। ঢাকায় বোর্ড মিটিংয়েও আলোচনা করেছে। তারা জানিয়েছেন, বিদ্যুৎ সংযোগটা সোলার প্ল্যান্টের মাধ্যমে হবে নাকি টাওয়ার স্থাপন করবে, নাকি ক্যাবলের মাধ্যমে করবে সেটা নিয়ে সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় আছে।

এ বিষয়ে রাজশাহী নর্দান ইলেকট্রিসিটি সাপ্লাইয়ের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (প্রকৌশল) ইয়াসির আরাফাত বলেন, নেসকোতে আলোচনা হয়েছে। আমাদের প্রধান প্রকৌশলী মিজানুর রহমান এটা দেখভাল করছেন। বোর্ড মিটিংয়েও তোলা হয়েছে। তবে সবশেষ সিদ্ধান্তটা আমার জানা নেই। এটা সাবমেরিন অথবা অন্য কোনো ব্যবস্থার মাধ্যমে স্থায়ীভাবে কীভাবে বিদ্যুৎ দেওয়া যায়, সেটার পরিকল্পনা চলছে, বাস্তবায়নও এগোচ্ছে।

সাখাওয়াত হোসেন/এসআর/জেআইএম