মতামত

সরকার উৎখাতে ‘মোসাদ’ কানেকশন

প্রায় প্রতিদিন বাংলাদেশের প্রতিটি সংবাদ মাধ্যমে বলা হচ্ছে ‘মোসাদ ঝড়ে বিএনপি’ বিধ্বস্ত। ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের এজেন্ট মেন্দি এন সাফাদির সঙ্গে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব আসলাম চৌধুরীর গোপন বৈঠক এখন তদন্তের পর্যায়ে রয়েছে। গত এপ্রিল (২০১৬) মাসে সজীব ওয়াজেদ জয় অপহরণ ও হত্যাচেষ্টা মামলা, গ্রেফতার এবং অপরাধী শনাক্তের পর এবার শেখ হাসিনার সরকার উৎখাতে ইসরাইলি ষড়যন্ত্রে এদেশের জনগণ হতবাক ও ক্রুদ্ধ। ৫ মে থেকে কয়েকটি পত্রিকা ও অনলাইনে প্রকাশিত সংবাদে শেখ হাসিনার সরকার উৎখাতে সচেষ্ট কিছু ব্যক্তির পরিচয় সামনে এসেছে। ‘সরকার উৎখাতে এবার মোসাদ’র অর্থায়ন’(৫ মে), ‘ডিসেম্বরের মধ্যেই সরকার উৎখাতের পরিকল্পনা ছিল’(৬ মে), ‘সরকার উৎখাতের বৈঠক নিয়ে তোলপাড়’(৭ মে) এবং ‘বাংলাদেশের দরজা ইসরাইলিদের জন্য খুলে দেয়া হবে’(৯ মে)- এই শিরোনামে প্রকাশিত সংবাদগুলো দেশ-বিদেশি ষড়যন্ত্রের নানামুখি তৎপরতার তথ্য উন্মোচন করেছে। সরকার উৎখাতের জন্য মার্চে (২০১৬) কলকাতা, দিল্লি­ ও লন্ডনে তিনটি বৈঠক করেছে ইসরাইলের প্রভাবশালী নেতা ও মোসাদের দায়িত্বে থাকা মেন্দি এন সাফাদি। তার সঙ্গে বিএনপির প্রভাবশালী এক নেতা, একটি ইসলামী দলের নেতা এবং মোসাদের এজেন্ট হিসেবে বাংলাদেশে কাজ করা একজন ব্যক্তি বৈঠকগুলোতে উপস্থিত ছিল। লন্ডনে বৈঠক চলাকালে বাংলাদেশে একজন বিএনপি নেতার সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সে কথা বলার তথ্য এখন গোয়েন্দাদের হাতে। আর সরকার উৎখাতের এই ষড়যন্ত্রে অর্থায়ন করার আশ্বাসও দিয়েছে মোসাদের ওই প্রভাবশালী নেতা।অন্যদিকে আওয়ামী লীগ সরকার উৎখাতে জঙ্গিবাদীদের চেষ্টা ও তৎপরতার কথাও উদ্ঘাটিত হচ্ছে। সম্প্রতি বাংলাদেশের তথ্যেই সিঙ্গাপুরে জঙ্গিবাদী তৎপরতায় যুক্ত আট জনকে গ্রেফতার করে দেশে পাঠানো হয়েছে। প্রায় দুই মাস আগেও সিঙ্গাপুর সরকার জঙ্গি তৎপরতার অভিযোগে ২৬ জনকে ফেরত পাঠায়। এরা ২০০৭ থেকে ২০১১ সালের মধ্যে সিঙ্গাপুরে শ্রমিক হিসেবে ওয়ার্ক পারমিট নিয়ে গিয়েছিল। সিঙ্গাপুর কর্তৃপক্ষ অভিযোগ করেছে, আটকেরা ওই দেশে অবস্থান করে জঙ্গিবাদে যোগদানের জন্য সদস্য সংগ্রহ করছিল। বিভিন্নভাবে জঙ্গি কর্মকাণ্ডের জন্য তারা ফান্ড কালেক্টে সচেষ্ট ছিল। সিঙ্গাপুরের একটি সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সিরিয়া এবং ইরাকে গিয়ে জঙ্গি কার্যক্রমে সম্পৃক্ত হওয়ার পরিকল্পনা থাকলেও মধ্যপ্রাচ্য ভ্রমণ জটিলতাপূর্ণ হওয়ায় তারা বাংলাদেশে ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নেয় এবং সহিংস কার্যক্রমের মাধ্যমে সরকার উৎখাতের পরিকল্পনা করে। বাংলাদেশে ফিরে এখানে আইএসের শাখা গঠনের পরিকল্পনা ছিল তাদের। অর্থাৎ একদিকে ‘মোসাদে’র অপতৎপরতা অন্যদিকে ধর্মীয় উগ্রবাদিতার নানাবিধ নাশকতার প্রচেষ্টা বর্তমান সরকারের জন্য চ্যালেঞ্জ হিসেবে গণ্য হচ্ছে।কলকাতায় ৬ মার্চ ও দিল্লিতে ১০-১৪ মার্চ টানা ৪ দিন এবং ১৮ মার্চ লন্ডনের ওয়েস্ট মিনিস্টার ব্রিজ রোডের পার্ক প্ল­াজা হোটেলের ১১৪৫ নম্বর রুমে বিএনপির একজন প্রভাবশালী নেতার সঙ্গে বৈঠক করে মেন্দি এন সাফাদি। আগেই বলা হয়েছে, এসব বৈঠকে মেন্দি এন সাফাদি বাংলাদেশের সরকার উৎখাতে সবধরনের অর্থায়নের আশ্বাস দিয়েছে। আর তার সঙ্গে যোগ দেয়া বাংলাদেশিদের পক্ষ থেকে সরকার উৎখাত হলে বাংলাদেশে মোসাদকে স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ দেয়াসহ নানা ধরনের সহযোগিতার আশ্বাস দেয়া হয়েছে। উল্লেখ্য, মোসাদের দুই এজেন্ট- সিপান কুমার বসুর বাড়ি খুলনায়। অন্য একজন বিবেক দেব কলকাতার বাসিন্দা। লন্ডনে বৈঠক থেকেই বাংলাদেশে বিএনপির স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য ও চট্টগ্রামের একজন সিনিয়র বিএনপি নেতার সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সে কথা হয়। এর বাইরে চট্টগ্রামের একজন স্থানীয় বিএনপি নেতা আসলাম চৌধুরীর সম্পৃক্ততা মিলেছে। বৈঠকের ছবিতে মোসাদ এজেন্টদের সঙ্গে আসলাম চৌধুরীও আছেন। বর্তমান সরকারের আমলে বন্ধ হওয়া একটি জাতীয় দৈনিকের একজন সাংবাদিকেরও এই ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ততা মিলেছে। ভারতের বৈঠকগুলোতে তিনি উপস্থিত ছিলেন। এছাড়া লন্ডনের বৈঠকে ছিলেন ভারতের রাষ্ট্রীয় সয়ংসেবক সংঘের (আরএসএস) নেতা জোতিন্দার কুমার। তিনি বিজেপির প্রভাবশালীদের একজন। জোতিন্দারের দাবি, বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেই হিন্দুরা বেশি নির্যাতিত হচ্ছে। লন্ডনের ওই বৈঠকেই ডিসেম্বরের মধ্যেই বর্তমান সরকারকে উৎখাত করার পরিকল্পনা করা হয়েছিল।অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রকারীদের বিশাল নেটওয়ার্ক কাজ করছে শেখ হাসিনাকে উৎখাতের জন্য। বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ হিসেবে বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের ডকুমেন্টারি দেখানো হচ্ছে; যা ২০০১ সালের নির্বাচন-উত্তর জামায়াত-বিএনপি’র নৃশংসতা হিসেবে সারাবিশ্বে চিহ্নিত। সেসময় বিএনপি-জামায়াতের অত্যাচারে অনেক হিন্দু এলাকাছাড়া এমনকি দেশছাড়া হয়েছে। অথচ ওই ডকুমেন্টারি বর্তমান সময়ের বলে চালিয়ে দেয়া হয়েছে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সারাদেশে বিএনপি-জামায়াত তাণ্ডব চালায়। সেই সময়ের জ্বালাও পোড়াও-এর ঘটনা, হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর হামলার ঘটনা এবং ২০০১ সালের ডকুমেন্টারি নিয়ে সরকার বিরোধী প্রচারণা এখন তুঙ্গে। আমাদের এটা নিশ্চয় মনে আছে যে, মহাজোট সরকারের সময় অন্তত পাঁচটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত ধর্মীয় কার্ড তথা ধর্মীয় ইস্যু ব্যবহার করেছে নির্লজ্জভাবে। নির্বাচনে স্থানীয় উন্নয়নের বিষয়টি প্রাধান্য পায় নি। জাতীয় ইস্যু হিসেবেও ধর্মীয় বিষয় নিয়ে এসেছে বিএনপি বা তাদের জোটের অন্যান্য প্রার্থীরা। তারা মিথ্যা প্রচার করেছে মুসলমান হয়েও আওয়ামী লীগ নাকি ইমাম-আকিদার ওপর আঘাত হেনেছে। ভোটারদের কোরান ধরে শপথ করিয়েছে হেফাজতের কর্মীরা। সরকারকে বলেছে ইসলাম বিরোধী। আমরা জানি এর আগে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময় ধর্মের কথা বলেই জঙ্গিগোষ্ঠীর উত্থান ঘটেছিল। এধরনের অপপ্রচার করা হয়েছিল অতীতের জাতীয় নির্বাচনেও। ‘নৌকায় ভোট দিলে দেশে ধর্ম থাকবে না, ইসলাম থাকবে না, মাথায় টুপি থাকবে না, মসজিদে আজানের পরিবর্তে উলুধ্বনি বাজবে’। সন্তানের নাম ‘রহিম-করিম’ রাখতে পারবেন না, ‘রাম-শ্যাম যদু-মধু’ রাখতে হবে। বিএনপির হিন্দু নেতা গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেছিলেন, ‘আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসলে বিসমিল্লাহ থাকবে না।’ বরিশালে বিএনপির প্রার্থী নাস্তিক নয় আস্তিককে ভোট দিতে বলেছে। চরমোনাই পীরের সমর্থকরা হেফাজতকে নিয়ে শেষে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়। ধর্মের নানা অপব্যাখ্যা দিয়ে সাধারণ ভোটারদের বিভ্রান্ত করেছে। পক্ষান্তরে গণজাগরণ মঞ্চের তরুণরা উদ্দীপিত হয়েছিল ধর্ম নয় বাঙালির শাশ্বত ও অসাম্প্রদায়িক চেতনায়। সেখানে মুখ্য বিষয় ছিল মুক্তিযুদ্ধ। এজন্য সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ২০ দলীয় জোটের পক্ষে বিএনপির শীর্ষস্থানীয় নেতা এম কে আনোয়ার যখন বলেছেন, ‘গত ৫ মে হিন্দুরা পবিত্র কুরআন পুড়িয়ে দিয়েছে’ এই হিন্দু বিদ্বেষী বিএনপি নেতারা ভবিষ্যতের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করলে তখন দেশের পরিস্থিতি কি হবে ভেবে দেখতে হবে আমাদের। ধর্ম নিয়ে খেলা করার এই লোকরা দেশকে সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রে পরিণত করতে চায়। প্রগতিশীল তরুণদের চেতনার বিপরীতে এদের অবস্থান। আসলে ধর্মদ্রোহী নাস্তিক বলে যে সব তরুণকে দূরে ঠেলা হচ্ছে তারাই প্রকৃত দেশপ্রেমিক। পাকিস্তানের মতো মুসলিম রাষ্ট্রেও নির্বাচনে ধর্মকে ব্যবহার নিষিদ্ধ ছিল। অথচ এদেশে ধর্মকে ব্যবহার করে ক্ষমতা লুটতে চায় চিহ্নিত মৌলবাদী গোষ্ঠী। বর্তমান সরকার উৎখাতে সেই একই ধর্মীয় কার্ড ব্যবহার করতে দেখা যাচ্ছে।ইসরাইল ভিত্তিক অনলাইন সংবাদমাধ্যম ‘জেরুজালেম অনলাইন ডট কম’ এর প্রতিবেদনে বাংলাদেশ সরকারকে ‘বাংলাদেশে মুসলিম ব্রাদারহুড সরকার’ বলে অভিহিত করা হয়েছে। প্রচার করা হচ্ছে, এই দেশটি কেবল সংখ্যালঘুদের জন্য হুমকি নয়, দেশটি সন্ত্রাসীদেরও স্বর্গ। এখানে মানুষ নির্যাতিত এবং হত্যার শিকার হয়, কারণ তারা ভিন্ন মতের। ‘মোসাদ’র বাংলাদেশের প্রতিনিধি শিপান কুমার বসু, রওশন জাহিদ প্রিন্স এবং বিএনপি ও খেলাফত আন্দোলনের নেতা একইভাবে বর্তমান আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারকে ইসলামী মৌলবাদী সরকার হিসেবে উল্লেখ করেছে। আর বিএনপি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে এই ইস্যুটিতে সাফাদির সহযোগিতা চেয়েছে। সাফাদিও সেই অনুযায়ী কাজ করেছে এবং ভারত সফরও এর অংশ বলে জানা যায়।   সরকার পরিবর্তনে বিএনপির সঙ্গে সহযোগিতা করার নিশ্চয়তা দিয়েছে ইসলামভিত্তিক দলের নেতারা; যারা জামায়াতি রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। অন্যদিকে লন্ডন থেকে নিশ্চয়তা দেয়ার পর আসলাম চৌধুরীর পক্ষে সাফাদিকে আর্থিকভাবে সহযোগিতা করা হবে বলে জানানো হয়। এসব ভয়ঙ্কর তথ্য এখন বের হয়ে আসছে। এ প্রসঙ্গে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম গত ১২ মে বলেছেন, ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থাকে ব্যবহার করে বিএনপি ক্ষমতায় আসার চেষ্টা করছে। এ বিষয়ে সরকারের কাছে তথ্য-প্রমাণ রয়েছে। সরকারের কাছে খবর রয়েছে যে, তারা ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থাকে ব্যবহার করে বাংলাদেশকে একটি ধর্মান্ধ মুসলিম  দেশ হিসেবে উপস্থাপন করতে চাইছে। তারা ইসরায়েলকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করছে যে, বিএনপি ক্ষমতায়  গেলে  দেশটির সঙ্গে সম্পর্কের উন্নতি হবে।অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় হলো আওয়ামী লীগ সরকারের রাজনৈতিক দর্শনে লালন করা চেতনা। মুক্তিযুদ্ধের মর্মমূলে রক্ষিত সেই অন্তর্সত্যের জয়গান এখন সর্বব্যাপ্ত। তা কোনোভাবে নস্যাৎ হবে না ওই সব ষড়যন্ত্রকারীর কারণে। ওরা ধর্মীয় জঙ্গিবাদকে লালন করে; মনেপ্রাণে আওয়ামী লীগকে ঘৃণা করে। ‘মোসাদ’ সমর্থকরা এদেশকে তালেবান বানাতে পারলে নিজেদের জীবনকে ধন্য মনে করবে। আসলে ব্যর্থ এই মানুষগুলো বাংলাদেশের বর্তমান অগ্রগতিকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করার স্পর্ধা দেখাচ্ছে। তবে যুক্তি-বিচার ও বুদ্ধি দিয়ে মৌলবাদীদের মোকাবিলা করার জন্য এদেশে মানুষের অভাব নেই। এজন্য বিএনপি-জামায়াতের মতো ব্যক্তিদের পথভ্রষ্ট ও ‘মোসাদে’র নগ্ন দালাল বলে ধরে নেওয়া যেতে পারে, যারা দেশকে ভালোবাসেনি বরং দেশের জনগণকে বিভ্রান্ত করার জন্য শেখ হাসিনা সরকারকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে চাচ্ছে। এদের চিনে রাখার সময় এসেছে। প্রয়োজন রয়েছে সতর্ক থাকার।  লেখক: অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ এবং পরিচালক, জনসংযোগ, তথ্য ও প্রকাশনা দপ্তর, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়এইচআর/এবিএস

Advertisement