একটি প্রকল্পে ২৭ হাজার ৭২০ টাকা দামের একটি বালিশের কাভারের দাম চাওয়া হয় ২৮ হাজার টাকা। অথচ একটি বালিশের বাজারমূল্য ৭৫০ থেকে দুই হাজার টাকা এবং একটি কাভারের দাম ৫শ থেকে ১৫শ টাকার মধ্যে। এক হাজার কোটি টাকা কমিয়ে তুমুল আলোচিত ‘বালিশকাণ্ড’ খ্যাত সেই প্রকল্প একনেকে পাস হয় চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে। তবে অন্তর্বর্তী সরকার এ প্রকল্পে ‘বুদ্ধিবৃত্তিক দুর্নীতি’ হয়েছিল যা গ্রহণযোগ্য নয় উল্লেখ করে অর্থায়ন করতে চায় না।
Advertisement
তুঘলকি এ কাণ্ড ঘটে ‘চট্টগ্রাম মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (সিএমইউ) স্থাপন’ শীর্ষক প্রকল্পে। ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য দুই হাজার ৮শ কোটি ৬২ লাখ ৬৮ হাজার টাকা ব্যয়প্রস্তাব করা হয়। সংশোধিত ব্যয়প্রস্তাবে এ থেকে কমানো হয় প্রায় এক হাজার কোটি টাকা। এই ‘অযৌক্তিক ব্যয়’ কেন চাওয়া হয়েছিল এসব বিষয় বিবেচনায় নিতে যাচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রশাসন। জেনে-শুনে এ ব্যয়প্রস্তাবকে ‘বুদ্ধিভিত্তিক দুর্নীতি’ বলছে সরকার। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে অনুমোদন পাওয়া অথবা প্রস্তাবিত এমন অযৌক্তিক ব্যয়প্রস্তাবের প্রকল্পে অর্থায়ন বন্ধের কথা ভাবছেন সংশ্লিষ্টরা।
বিগত সময়ে এমন অনেক ঘটনা ঘটেছে। একটা বালিশের দাম কীভাবে প্রায় ২৮ হাজার টাকা ধরা হলো। এমন প্রকল্প আবার পরিকল্পনা কমিশনে প্রস্তাব করা হলো। যারা এটা করেছে তারা জেনে-শুনেই করেছে। এটাকে আমরা ‘বুদ্ধিবৃত্তিক দুর্নীতি’ হিসেবে চিহ্নিত করেছি।- শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির সদস্য ও বিশ্বব্যাংক ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন
শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির সদস্য ও বিশ্বব্যাংক ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, ‘বিগত সময়ে এমন অনেক ঘটনা ঘটেছে। একটা বালিশের দাম কীভাবে প্রায় ২৮ হাজার টাকা ধরা হলো। এমন প্রকল্প আবার পরিকল্পনা কমিশনে প্রস্তাব করা হলো। যারা এটা করেছে তারা জেনে-শুনেই করেছে। এটাকে আমরা ‘বুদ্ধিবৃত্তিক দুর্নীতি’ হিসেবে চিহ্নিত করেছি।’
Advertisement
তিনি বলেন, ‘যে প্রকল্পের প্রস্তাব করেছে সেও জানে একটা বালিশের দাম ২৮ হাজার হতে পারে না। বুদ্ধিবৃত্তিক দুর্নীতি হিসেবে অনেক প্রকল্প চিহ্নিত করেছি। এটা নিয়ে আমরা পরিকল্পনা উপদেষ্টার সঙ্গে কথা বলেছি। উনি এগুলো দেখতে বলেছেন।’
অনেক বেশি ব্যয় চেয়ে পরিকল্পনা কমিশনে প্রথমে প্রকল্প পাঠানো হয়, পরে এটা ফেরত পাঠায়। তবে এত বেশি ব্যয় চাওয়া অবশ্যই অযৌক্তিক। যারা প্রকল্পের সঙ্গে প্রথমে জড়িত ছিল তারা কেউ নেই। অনেকে আবার দেশ ছেড়েও পালিয়েছেন। একটি তোয়ালে পাঁচ হাজার টাকা কেন হবে, এটা তুঘলকি কাণ্ড।- চমেবির ভিসি ও প্রকল্পের পরিচালক অধ্যাপক ডা. ওমর ফারুক ইউসুফ
এই অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘যতই স্বাস্থ্যের জন্য হোক এমন প্রকল্পে আমরা অর্থায়ন করতে পারি না। যার গোড়ায় গলদ সেই প্রকল্প জনকল্যাণে হতে পারে না। আমাদের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির কাজ হচ্ছে। শ্বেতপত্রে এগুলো রাখছি যা অতি মূল্যায়িত বুদ্ধিবৃত্তিক দুর্নীতি হিসেবে চিহ্নিত। এসব ডিপিপি রিভিউ করা হবে। কিন্তু কয়টা করতে পারবো সেটা দেখার বিষয়। এখানে যৌক্তিককরণের পদক্ষেপ নেবো। বালিশের দাম যেখানে ২৮ হাজার টাকা ধরা হলো এসব প্রকল্প স্থগিত করা দরকার। এগুলোর অর্থায়ন করবো কোন যুক্তিতে? বাজেটই ঠিক নেই অর্থায়নের প্রশ্ন কেন? তথ্যের সত্যতা যাচাই করে বন্ধ করা উচিত।’
আরও পড়ুন ‘শুধু ভারতীয় ঠিকাদার কাজ করবে’ নীতির পরিবর্তন চায় বাংলাদেশ কাজ ফেলে চলে গেছেন ভারতীয়রা, অনিশ্চয়তায় ১২ হাইটেক পার্ক ৩৭৮ কোটি টাকা খরচের খবর নেই, আরও ৩৪৫ কোটি আবদার ইভিএম এখন গলার কাঁটা, রক্ষণাবেক্ষণ খরচ জোগাতে পারছে না ইসিপরিকল্পনা কমিশন সূত্র জানায়, বুদ্ধিবৃত্তিক দুর্নীতি চিহ্নিত করে বেশকিছু প্রকল্প আগামী বার্ষিক কর্মসূচিতে বরাদ্দ দেওয়া হবে না। তার মধ্যে অন্যতম চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ স্থাপন প্রকল্প। ২০১৯ সালেই ১২টি আইটেমের ব্যয় নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল পরিকল্পনা কমিশন। একই সঙ্গে প্রকৃত বাজারদর বের করেছিল। যাতে ব্যাপক অসঙ্গতি ধরা পড়ে।
Advertisement
প্রস্তাবিত প্রকল্পে একটি স্টেরাইল হ্যান্ডগ্লোভসের দাম ধরা হয়েছিল ৩৫ হাজার টাকা, অথচ পরিকল্পনা কমিশনের মতে ২০১৯ সালে এর সম্ভাব্য বাজারমূল্য ছিল মাত্র দুই থেকে পাঁচ হাজার টাকা। এছাড়া একটি টেস্ট টিউব গ্লোভসের দাম ধরা হয়েছিল ৫৬ হাজার টাকা, যার বাজারমূল্য ছিল দেড় থেকে পাঁচ হাজার টাকা, একটি মাল্টিপ্লাগ উইথ এক্সটেনশন কডের দাম ধরা হয় ৬ হাজার ৩০০ টাকা, যার বাজারমূল্য মাত্র ২৫০ থেকে ৫০০ টাকা। একটি রাবার ক্লথের দাম ধরা হয় ৫ হাজার টাকা, যার বাজারমূল্য মাত্র ৫শ টাকা, একটি ৫৪ ইঞ্চি প্রস্থের রেক্সিনের দাম ধরা ৮৪ হাজার টাকা, যার সম্ভাব্য বাজারমূল্য মাত্র ৩০০-৫০০ টাকা। একটি কটন টাওয়েলের দাম ধরা হয় ৫ হাজার ৮৮০ টাকা, যার বাজারমূল্য ২৫০ টাকা, একটি গোয়াট গাউনের দাম ধরা হয় ৪৯ হাজার টাকা, যার বাজারমূল্য এক থেকে দুই হাজার টাকা। একটি ডিসপোজেবল সার্জিক্যাল ক্যাপ ও মাস্কের দাম ধরা হয় ৮৪ হাজার টাকা, যার বাজারমূল্য ১০০ থেকে ২০০ টাকা, একটি ডিসপোজেবল শু কাভারের দাম ধরা হয় ১৭ হাজার ৫শ টাকা, যার বাজারমূল্য মাত্র ২০ টাকা।
গ্রহণযোগ্য নয় মত দিয়েও প্রকল্প পাস!এ ধরনের অসামঞ্জস্যপূর্ণ প্রাক্কলন কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয় বলে ২০১৯ সালে মত দিয়েছিল কমিশন। তারপরও ২০২৪ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি এক হাজার ৮৫১ কোটি টাকার সংশোধিত প্রকল্পটি অনুমোদন করে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি-একনেক।
প্রকল্প বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (চমেবি) ভাইস চ্যান্সেলর (ভিসি) ও প্রকল্পের পরিচালক অধ্যাপক ডা. ওমর ফারুক ইউসুফ জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমি শুনেছি একটি বালিশ ও তোয়ালের দাম অনেক ধরা হয়েছিল। তবে আমি নতুন। কিছুদিন আগে এখানে এসেছি। আগের বিষয় শুনেছি, তবে বিস্তারিত বলতে পারবো না।’
তিনি বলেন, ‘অনেক বেশি ব্যয় চেয়ে পরিকল্পনা কমিশনে প্রথমে প্রকল্প পাঠানো হয়, পরে এটা ফেরত পাঠায়। তবে এত বেশি ব্যয় চাওয়া অবশ্যই অযৌক্তিক। যারা প্রকল্পের সঙ্গে প্রথমে জড়িত ছিল তারা কেউ নেই। অনেকে আবার দেশ ছেড়েও পালিয়েছেন। একটি তোয়ালে পাঁচ হাজার টাকা কেন হবে, এটা তুঘলকি কাণ্ড। তবে প্রকল্পের ৬৬৫ পাতার ডিপিপি আমি চুলচেরাভাবে বিশ্লেষণ করছি।’
পরিকল্পনা কমিশন থেকে জানা যায়, প্রকল্পের কিছু আইটেমে ত্রুটি-বিচ্যুতি ছিল। তারপরও অনুমোদন পেয়েছে প্রকল্পটি।
একই ধরনের যন্ত্রপাতি একাধিকবার কেনার প্রস্তাবচিকিৎসা সরঞ্জামাদির মূল্যেও দ্বৈততা দেখা যায়। বিভিন্ন দপ্তরের জন্য প্রায় এক হাজার ৫০টি ওয়াটার ফিল্টার, এক হাজার ৫০টি রিভার্স ওজমোসিস, প্রায় এক হাজার ৫০টি ডেস্কটপ কম্পিউটার, এক হাজার ৫০টি ল্যাপটপ, এক হাজার কালার প্রিন্টার ও ১ হাজার ৫০টি সাদাকালো প্রিন্টার কেনার প্রাক্কলন করা হয়। ওয়াটার ফিল্টার থাকলেও ওজমোসিস, ডেস্কটপ থাকলেও ল্যাপটপ, কালার প্রিন্টার থাকলেও সাদাকালো প্রিন্টারে বিপুল পরিমাণে ব্যয় প্রস্তাবের যৌক্তিকতা খুঁজে পায়নি কমিশন।
আসবাবপত্রের ব্যয় প্রাক্কলনে অসামঞ্জস্যতাআসবাবপত্রের ব্যয় নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। একই ফার্নিচারের মূল্য একেক জায়গায় একেকরকম ধরা হয়। রিসার্চ ল্যাবের যন্ত্রপাতির তালিকায় কম্পিউটার টেবিল, কম্পিউটার চেয়ার, শু র্যাক কুশন চেয়ার, ক্যাবিনেট ইত্যাদি আসবাবপত্র দেখানো হয়। আবার ফার্নিচারের তালিকাতেও দেখানো হয় মোট ব্যয় ৭৫ কোটি ২৫ লাখ টাকা।
নির্মাণ ও পূর্ত কাজের ব্যয় প্রাক্কলনে অসামঞ্জ্যতানির্মাণ ও পূর্ত কাজের ব্যয় প্রাক্কলনে অসামাঞ্জস্যতা রয়েছে। ২০ তলা ভবনের জন্য ১০ তলা ফাউন্ডেশন ধরা এক ধরনের ভুল। ফাউন্ডেশন নির্মাণের রেট, বিভিন্ন ভবনের ফ্লোরের রেট নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। স্যালাইন জোন উইন্ড অ্যান্ড আর্থকোয়েক লোড, সাইক্লোন ও ওয়াটার সার্জ ইত্যাদির জন্য অতিরিক্ত ব্যয় ধরা হয়।
বইপত্রের মূল্যেও নয়-ছয়প্রকল্পের আওতায় বইপত্র কেনার জন্য মোট দুই কোটি ৮৩ লাখ টাকার সংস্থান রাখা হয়। ক্লিনিক্যাল হেমাটোলজি বইয়ের ২০১৫ সালের ১৩ নম্বর সংস্করণের তালিকা দেওয়া হয়, যার তিন কপির দাম ধরা হয় ৬০ হাজার টাকা করে ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা। কিন্তু বাজার পর্যালোচনা করে দেখা যায়, এ সংস্করণটির প্রকাশক থেকে কমিশনসহ নির্ধারিত মূল্য ৩৪ হাজার টাকা।
পরিকল্পনা কমিশন জানায়, প্রকল্পটি গ্রহণের আগে সম্ভাব্যতা সমীক্ষা করা হয়নি। সম্ভাব্যতা যাচাই করা হলে ডিপিপিতে এত বেশি ব্যয় দেখানো যেত না। সম্ভাব্যতা সমীক্ষা ছাড়া এ প্রকল্প পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়। প্রকল্প প্রণয়ন সংশ্লিষ্ট সবারই জানার কথা যে ২৫ কোটির বেশি ব্যয়ের প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই বাধ্যতামূলক।
তারপরও অনুমোদন দেওয়া প্রসঙ্গে পরিকল্পনা কমিশনের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, ‘আমরা প্রকল্পে নানা ধরনের সুপারিশ দেই ব্যয় কমানোর জন্য। তারপরও ওপর মহলের চাপে এসব প্রকল্প অনুমোদন হয়ে যেত। কারণ একটা প্রকল্পের জন্য নানা ধরনের চ্যানেল কাজ করতো যেগুলো আমাদের ধরা-ছোঁয়ার বাইরে।’
এমওএস/এএসএ/জিকেএস