তানজিদ শুভ্র
Advertisement
বাঙালি জাতির হাজার বছরের শৌর্য-বীর্য ও বীরত্বের এক অবিস্মরণীয় গৌরবময় দিন। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর এক বীরত্বপূর্ণ সংগ্রাম শেষে পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশ নামে একটি স্বাধীন দেশের যাত্রা শুরু হয়েছিল। বিজয়ের এই দীর্ঘ ৫৩ বছর পেরিয়ে ৫৪ বছরে পদার্পণ করতে যাচ্ছে এবার। দিবসটি উপলক্ষ্যে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষার্থী জানিয়েছেন তাদের ভাবনা, অনুভূতি আর প্রত্যাশার কথা-
আমার স্বপ্নের বাংলাদেশরিকমা আক্তার, শিক্ষার্থী, উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগ
স্বাধীনতার ৫৩ বছর পেরিয়ে গেছে এখনো আমরা আমাদের কাঙ্ক্ষিত সাফল্য অর্জন করতে পারি নি। ২০২৪ সালে এসেও আমাদের বাকস্বাধীনতা নেই, সরকারের জবাবদিহিতা নেই। বিভিন্ন চড়াই উতরাই পার হয়ে ৫ আগস্ট ছাত্র জনতার অভ্যুত্থানের মাধ্যমে স্বৈরাচার সরকারের পতন ঘটে। বর্তমান সময়ে এসে আমাদের সরকারি বেসরকারি সব খাতকে স্বচ্ছ জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে। যাতে করে সর্বস্তরে ন্যায় প্রতিষ্ঠিত হয়।
Advertisement
বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে আমি এমন এক বাংলাদেশ দেখতে চাই যেখানে শিক্ষার মান হবে গবেষণা কেন্দ্রিক এবং বিশ্বমানের। বেকারত্ব দূর করে শিক্ষার্থীদের জন্য তৈরি হবে নতুন কর্মসংস্থান। লেখাপড়ার পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের সহশিক্ষার দক্ষতা অর্জনেরও সুযোগ করে দিতে হবে। শিক্ষাক্ষেত্রে সমতা বজায় রেখে প্রত্যন্ত অঞ্চলেও উন্নতমানের শিক্ষাব্যবস্থা চালু করতে হবে। চিকিৎসা ক্ষেত্রে বৈষম্য দূর করে সরকারি এবং বেসরকারি উভয় চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের সহায়তায় উন্নতমানের চিকিৎসাব্যবস্থা তৈরি করতে হবে যেখানে পথশিশু থেকে শুরু করে সব পর্যায়ের মানুষ সহজলভ্য এবং উন্নত চিকিৎসা পাবে।বর্তমান সময়ে এসে ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গভেদে বৈষম্যহীন একটি সুন্দর দেশ আমার একান্ত কাম্য।
আগামীর বাংলাদেশ হবে সাম্য ও সম্প্রীতিরমোঃ হাসনাইন রিজেন, শিক্ষার্থী, হিসাববিজ্ঞান বিভাগ
স্বাধীনতার ৫৩ বছর অনেক চ্যালেঞ্জ ও নানা প্রতিবন্ধকতা মোকাবেলা করে ২৪ এর ছাত্র জনতার আন্দোলনের মাধ্যমে আমরা নতুন এক বাংলাদেশ পেয়েছি। এই নতুন বাংলাদেশ পাওয়া জন্য দিতে হয়েছে তারুণ্যের প্রাণ। আর এই তরুণ প্রজন্ম স্বপ্ন দেখে আগামীর বাংলাদেশ হবে সাম্য, সম্প্রীতি ও মানবিক বাংলাদেশ।
অর্থনৈতিক বৈষম্য কমিয়ে, গ্রামীণ ও শহুরে জীবনের মধ্যে ভারসাম্য নিয়ে এসে ন্যাযতার ভিত্তিতে তৈরি হবে নতুন বাংলাদেশ। উন্নত শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা এবং কর্মসংস্থান নিশ্চিত করে প্রতিটি নাগরিককে সমান সুযোগ দিয়ে দেশকে এগিয়ে নিতে হবে এক নতুন উচ্চতায় নারী-পুরুষের সমান অধিকার, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার জন্য ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার মাধ্যমেই প্রকৃত সাম্য প্রতিষ্ঠিত হবে।
Advertisement
বাংলাদেশ একটি বহুজাতিক, বহু-ধর্মীয় এবং বহু সংস্কৃতির দেশ। এখানে সহমর্মিতা, সহযোগিতা এবং সহাবস্থান কেবল সামাজিক শৃঙ্খলা রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ নয়; এটি আমাদের জাতীয় পরিচয়েরও অন্যতম ভিত্তি। সম্প্রীতি বাংলাদেশের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য আমাদের গৌরব। কিন্তু সাম্প্রতিককালে সামাজিক বিভাজন ও বিদ্বেষমূলক ঘটনা আমাদের অগ্রযাত্রাকে থামিয়ে দেওয়ার হুমকি দিচ্ছে। আমাদের প্রয়োজন সামাজিক ঐক্য ও সহনশীলতার সংস্কৃতি গড়ে তোলা। শিক্ষা ও সচেতনতা বাড়িয়ে নতুন প্রজন্মকে সম্প্রীতির মূল্যবোধে উজ্জীবিত করতে হবে।
মানবতা হলো একটি সভ্য জাতির পরিচয়। উন্নত অবকাঠামো ও প্রযুক্তিগত উন্নতির পাশাপাশি মানবিক মূল্যবোধের চর্চা নিশ্চিত করা প্রতিটি জাতির জীবনের অত্যন্ত জরুরি। সমাজের ধনী গরীব ব্যবধান ভুলে গিয়ে একটি সুন্দর ও মানবিক সমাজ গড়ে তুলতে পারলে নতুন বাংলাদেশ সার্থক হবে।
ভবিষ্যতের জন্য নতুন শপথ গ্রহণের দিনগৌরাঙ্গ সরকার, শিক্ষার্থী, ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং
১৬ ডিসেম্বর, শুধু একটি তারিখ নয়; এটি আত্মত্যাগ, সংগ্রাম ও বিজয়ের প্রতীক। ১৯৭১ সালের এই মহান বিজয় শুধু ভৌগোলিক স্বাধীনতার গল্প নয়; এটি একটি জাতির জাগরণের গল্প, একটি নতুন সভ্যতার নবজন্ম।
আমাদের বিজয়ের দিনটি কেবল উদযাপনের নয়; এটি আমাদের জন্য এক বড় দায়িত্বের স্মারক। আমি আমার দেশটিকে একটি উন্নত, সমৃদ্ধ ও মানবিক রাষ্ট্র হিসেবে দেখতে চাই। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আমাকে অনুপ্রাণিত করে এমন একটি বাংলাদেশ গড়ার, যেখানে প্রতিটি নাগরিক তার অধিকার, মর্যাদা এবং ন্যায়বিচার পাবে। আমি একটি বৈষম্যহীন সমাজের স্বপ্ন দেখি, যেখানে দারিদ্র্য থাকবে না, থাকবে না শোষণ। আমার বাংলাদেশ হবে এমন একটি দেশ, যেখানে শিক্ষা হবে সবার জন্য সহজলভ্য, কর্মসংস্থান থাকবে নিশ্চিত, এবং পরিবেশবান্ধব উন্নয়ন হবে আমাদের অগ্রাধিকার।
১৬ ডিসেম্বর তাই শুধু অতীতের গৌরবগাঁথা নয়, ভবিষ্যতের জন্য নতুন শপথ গ্রহণের দিন। এদিন আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, স্বাধীনতার প্রকৃত অর্থ তখনই পূর্ণ হবে, যখন আমরা আমাদের জাতীয় চেতনা, একতা এবং মানবিক মূল্যবোধ ধরে রাখতে পারব। বিজয় দিবস আমাদের জন্য অনুপ্রেরণা এবং দায়িত্ববোধের চিরন্তন উৎস। এটি আমাদের শিখিয়েছে, প্রতিটি সংগ্রামেই বিজয় সম্ভব, যদি লক্ষ্য সঠিক হয় এবং প্রচেষ্টা আন্তরিক। তাই, একটি উন্নত, মর্যাদাপূর্ণ এবং সুশৃঙ্খল বাংলাদেশ গড়াই হোক আমাদের সবার অঙ্গীকার।
বাংলাদেশ হোক বৈষম্যহীন, সমৃদ্ধ সোনার বাংলাদেশ আতাউর রহমান রাব্বি, শিক্ষার্থী, হিসাববিজ্ঞান বিভাগ
একটি পতাকা, একটি দেশ। ১৬ ডিসেম্বর মহান বিজয় দিবস, এই দিনটি বীরের জাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করার দিন। পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশ নামে নতুন একটি স্বাধীন ভূখণ্ডের আত্মপ্রকাশ ঘটে এদিন। দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে ৩০ লাখ শহীদের তাজা রক্ত এবং দুই লাখ মা-বোনের ইজ্জত বিসর্জন দিয়ে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর আমরা অর্জন করেছি বিজয়, পেয়েছি লাল-সবুজের গৌরবান্বিত একটি পতাকা।
বিজয়ের এতো গুলো বছর পার হয়ে আসলেও নতুন করে আশা এবং প্রত্যাশার জানান দিচ্ছে দেশের মানুষ। বিজয়ের ৫৪তম বছরে পদার্পণ করতে যাচ্ছে দেশ সেই সঙ্গে তরুণ প্রজন্মের আশা এবং প্রত্যাশা যেমনটি রয়েছে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস জানার ইচ্ছে ও রয়েছে।
নতুনত্বের এই বিজয় দিবসে বাংলাদেশ হোক বৈষম্যহীন; এখানে থাকবে না কোনো ভেদাভেদ, থাকবে সবাই একই ছায়াতলে। তবেই আমরা বিনির্মাণ করতে পারব সুখী, সমৃদ্ধ সোনার বাংলাদেশ।
সব অপশক্তি দূর হোকজুবায়ের আহমেদ সাব্বির,শিক্ষার্থী, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ
আমার কাছে বিজয় মানে অধিকার আদায়ের দ্বার উন্মুক্ত। বাঙালি হিসেবে আমার ভাষার অধিকার, দেশপ্রেমিক হিসেবে সাংবিধানিক অধিকার আদায় আমার হক। বিশ্বব্যাপী আমার জাতিসত্তার আনন্দ, উল্লাসের ও গর্বের জন্য বিশেষ একটি দিন বিজয় দিবস। বিজয়ের হাসি খুশির মাঝে কল্পনায় আমাদের হারানোর বেদনাও রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ কোন কাল্পনিক গল্পকাব্য ছিল না। বরং মুক্তিযুদ্ধ ছিল বাস্তব জীবনে দেশপ্রেম ও অস্তিত্বের লড়াই, পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্তির জন্য রক্ত বিসর্জন। লাখো শহীদের রক্তে অর্জিত দেশের প্রতিটি মাটি কণা দুর্নীতিমুক্ত, নীতিবোধের অবক্ষয় থেকে রক্ষা করে রাখাই হবে আমাদের জন্য প্রকৃত বিজয়। বিজয় দিবস মানে হলো দায়িত্ব, আদর্শ ও ন্যায়-নীতির চেতনাকে আরও একটি বছরের জন্য নিজের মাঝে জাগ্রত করা সুযোগ। সব অপশক্তি দূর হোক, প্রতিষ্ঠিত হোক সেই সোনার বাংলা। তারুণ্যের হাত ধরে বিশ্ব জানুক এক অপরাজেয় সত্ত্বাকে।
প্রত্যাশিত বিজয়ের লক্ষ্যে আমাদের লড়াই চলবেতানজিদ শুভ্র, শিক্ষার্থী, উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগ
রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় অর্জনের মাধ্যমে আমরা লাভ করি লাল সবুজের পতাকা। আমাদের বিজয়ের দীর্ঘ সময়ে অর্জনের খাতায় যুক্ত হয়েছে অনেক প্রাপ্তির গল্প। আমাদের বিজয়ের গল্পগুলো দেশের সব প্রান্তে ছড়িয়ে দিতে তরুণদের ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে।
আমাদের পথচলায় স্বাধীনতার চেতনা, বিজয়ের চেতনাকে ধারণ করার মাধ্যমে একদিন সুখী সমৃদ্ধশালী কাঙ্ক্ষিত সোনার বাংলা গড়ে উঠবে। রাজনৈতিক প্রতিহিংসা, বৈষম্য আর বেকারত্বের অভিশাপ থেকে মুক্তি না দিতে পারলে বিজয়ের আনন্দ ফিকে হয়ে যাবে নতুন প্রজন্মের কাছে। বৃত্তিমূলক শিক্ষা ব্যবস্থা ও যোগ্যতা অনুযায়ী কর্মপ্রাপ্তি নিশ্চিত করণের মাধ্যমে জনশক্তি গড়ে তোলা সম্ভব। নেপোলিয়ন হিল বলেছিলেন, ‘যে ব্যক্তি লড়াই বন্ধ করতে অস্বীকার করে তার পক্ষে সর্বদা বিজয় সম্ভব হয়।’ প্রত্যাশিত বিজয়ের লক্ষ্যে আমাদের লড়াই চালিয়ে যেতে হবে অপ্রত্যাশিত সব কিছুর বিরুদ্ধে। তথ্য প্রযুক্তি নির্ভর এই সময়ে দ্রুত সময়ে ছড়িয়ে পড়া অপতথ্যের মাধ্যমে বৈশ্বিকভাবে দেশের ভাবমূর্তি যখন ক্ষুণ্ণ হয় ঠিক তখন আমাদের তরুণ প্রজন্মকে এগিয়ে আসতে হবে সত্য তথ্য প্রচার প্রসারের মাধ্যমে। আমাদের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা পারে সকল নেতিবাচকতা দূর করতে।
যে বিজয় লাখো জীবনের বিনিময়ে অর্জিত, সেটা ধরে রাখার কর্তব্য আমাদের সবার। আমাদের প্রত্যেকের উচিত দেশের ঐতিহ্য ও গৌরবময় স্বাধীনতার ইতিহাস ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দেওয়া।
আরও পড়ুন
‘শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস’ কেন একটি বিশেষ দিন? স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়তে শপথ হোক ঐক্যেরকেএসকে/এমএস