আজ ১৬ ডিসেম্বর, মহান বিজয় দিবস। ৫৩ বছর আগে এই দিনে মহান মুক্তিযুদ্ধে চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হয়েছিল। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত হয়েছিল ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শেষের গান। সমবেত কণ্ঠে শব্দসৈনিকরা গেয়ে উঠেছিলেন, ‘বিজয় নিশান উড়ছে ওই, বাংলার ঘরে ঘরে, মুক্তির আলো ওই ঝরছে…।’ সেই আলোর ঝর্ণাধারায় প্রজ্বলিত হয়ে উঠেছিল বিশ্ব মানচিত্রে এক নতুন দেশ, বাংলাদেশ।
Advertisement
বাঙালি জাতির হাজার বছরের শৌর্যবীর্য ও বীরত্বের এক অবিস্মরণীয় গৌরবময় দিন ১৬ ডিসেম্বর। বীরের জাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশের দিন। পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশ নামে একটি স্বাধীন ভূখণ্ডের নাম জানান দেওয়ার দিন। লাখো শহীদের রক্ত দিয়ে যে ভূখণ্ডের সীমানা গড়েছিলেন বীর বাঙালিরা।
এত প্রাণ, এত রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতার লক্ষ্য অনেকটাই অর্জিত হয়নি। স্বাধীন বাংলাদেশে মানবিক মর্যাদা আজও ভূলুণ্ঠিত। মৌলিক অধিকার এখনো যেন সোনার হরিণ। কর্মসংস্থানের প্রকট সংকটে বেকারত্বের রাহুগ্রাসে শিক্ষিত ২৬ লাখ যুবক। পদে পদে বঞ্চিত-নিষ্পেষিত সাধারণ মানুষ।
আরও পড়ুন
Advertisement
নিশ্চিত করা যায়নি সামাজিক ন্যায়বিচারও। সাম্যের গান গেয়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর অস্ত্রের সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়েছিল সাহসী বাঙালিরা। অথচ আজও এ ভূখণ্ডে পদে পদে বৈষম্য, অনাচার। দেশগড়া ও স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের প্রশ্নেও রাজনৈতিক দলগুলোর অনৈক্য-বিভাজনে ‘লক্ষ্যহারা’ সাধারণ মানুষ।
কিন্তু স্বাধীনতার ৫৩ বছরেও কেন মহান মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য অর্জন করা যায়নি? কেন পূরণ হয়নি বাঙালির সেই স্বপ্ন ও প্রত্যাশা। সেই প্রশ্নেও ভিন্ন ভিন্ন মত। পাল্টাপাল্টি দায়ী করার চিরায়ত মনোভাব।
স্বাধীনতার পর রাষ্ট্রক্ষমতায় যারাই এসেছেন, তারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সঠিকভাবে লালন করেননি বলে মনে করেন শিক্ষাবিদ ও বিশিষ্টজনেরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমিরেটাস অধ্যাপক ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী জাগো নিউজকে বলেন, ‘একাত্তরের যে বিজয়, তা আজও সম্পূর্ণ হয়নি। বিজয়ের যে স্বপ্ন ছিল—একটা নতুন রাষ্ট্র এবং নতুন সমাজ আমরা গড়ে তুলতে পারবো, সেদিকে তেমন এগোয়নি। যে উন্নতি হয়েছে, সেটা পুঁজিবাদী ধরনের। এতে কিছু লোকের উন্নতি হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের উন্নতি হয়েছে, বস্তুগতভাবে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের যে চেতনা ছিল; গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও সমাজ প্রতিষ্ঠা, সেখানে মানুষের সঙ্গে মানুষের অধিকার ও সুযোগের সাম্য থাকবে, ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ ঘটবে। প্রকৃত জনপ্রতিনিধিদের কর্তৃত্ব সর্বত্র প্রতিষ্ঠিত হবে। সেগুলো ঘটেনি। মানুষের অধিকার ও সুযোগের সাম্য তো হয়ই নাই, বৈষম্য বেড়েছে। মানুষে মানুষে বিচ্ছিন্নতা বেড়ে গেছে।’
Advertisement
‘মানুষ খুব ব্যস্ত হয়ে থাকে নিজেকে নিয়ে। নিজের উপার্জন, জীবিকা ও নিশ্চয়তার জন্য ছুটে। ফলে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে নতুন রাষ্ট্র ও সমাজ গড়বার চেতনা স্তিমিত হয়ে গেছে। তার প্রভাব সর্বত্র দেখা যায়। এই জন্যে বিজয় দিবসে আগের মতো উদ্দীপনা তৈরি হয় না। স্মৃতি জাগুরুক হয় না’- যোগ করেন অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী।
আরও পড়ুন
শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায় সিক্ত হতে প্রস্তুত জাতীয় স্মৃতিসৌধ বিজয় দিবসের স্মারক ডাকটিকিট অবমুক্তঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক জাগো নিউজকে বলেন, ‘এখন পরিবর্তিত পরিস্থিতে আমাদের একাত্তরের চেতনাকে গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করা দরকার। গণমাধ্যমের একটা কাজ হচ্ছে, অতীতের যে ঐতিহ্য, সেগুলোকে নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরা। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কাজ হচ্ছে, নতুন প্রজন্মকে একাত্তরের সঙ্গে সংযুক্ত রাখা। সেই কাজগুলো আমাদের করে যাওয়া অত্যন্ত জরুরি।’
এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর পরামর্শ একটু ভিন্ন। তিনি বলেন, ‘এ অবস্থা থেকে মুক্তির পথ হলো—একাত্তরের চেতনাটাকে বিকশিত করা। সেটা তো একটা রাজনৈতিক কাজ। রাজনৈতিক দল যদি সেরকমভাবে গড়ে উঠে যে, তারা সমাজে এ স্বপ্নকে (একাত্তরের) বাস্তবায়ন করবে, রাষ্ট্রকে পরিবর্তিত করবে, সেই অঙ্গীকারবদ্ধ রাজনৈতিক আন্দোলন বা দল এখন দরকার। জনগণকে সঙ্গে নিয়ে যারা গড়ে তুলবে স্বাধীনতার চেতনায় কল্যাণমূলক এক রাষ্ট্র।’
এএএইচ/এমকেআর