ভারতে অবৈধভাবে প্রবেশ করার পর দেশটির পুলিশের হাতে ধরা পড়েছে বাংলাদেশের কিশোরগঞ্জের হিন্দু সম্প্রদায়ের একটি পরিবার। তাদের এক সদস্য দেশটির গণমাধ্যমের কাছে অভিযোগ করেছেন, বাংলাদেশে নির্যাতনের শিকার হয়ে তারা ভারতে পালিয়ে এসেছেন। তবে দেশে অবস্থান করা পরিবারটির এক সদস্য, তাদের প্রতিবেশী, ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য, পূজা উদযাপন পরিষদের নেতা ও থানার পুলিশ কর্মকর্তা জানিয়েছেন, নির্যাতনের কোনো ঘটনাই ঘটেনি।
Advertisement
ভারতের গণমাধ্যম এবিপি আনন্দ, এনডিটিভিসহ কয়েকটি গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে, গত শনিবার (৭ ডিসেম্বর) ত্রিপুরা রাজ্যের আমবাসা রেলওয়ে স্টেশন থেকে বাংলাদেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের একটি পরিবারের ১০ জনকে আটক করে ত্রিপুরা পুলিশ। তারা আসামের শিলচরের উদ্দেশ্যে ট্রেনে ওঠার চেষ্টা করছিল।
তাদের মধ্যে একজন সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন এবং বাংলাদেশে নির্যাতনের অভিযোগ তোলেন। তিনি বলেন, ‘কী করমু দেশে আর থাকার মতো ভালো নাই। আমি গাড়ি চালাই। হে আমারে গাইলায়, হে আমারে গাইলায়। মারতে আহে, ধরতে আহে। আমার বাপ লইয়া, মেয়ে-ছেলে লইয়া, সব লইয়া চইলা আইছি।’
আরও পড়ুন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে এক থাকার আহ্বান প্রধান উপদেষ্টার সংখ্যালঘু ইস্যুতে ভারতের মিডিয়া অপপ্রচার চালাচ্ছে: পররাষ্ট্র উপদেষ্টা সংখ্যালঘুদের ঘর-মন্দির পাহারার বিষয়টি ইতিবাচকভাবে দেখছি সংখ্যালঘু ইস্যুতে বহির্বিশ্বের কোনো চাপ নেই: সেনাপ্রধান‘আমারে মারলেও আমি ভারত থেকে যাইতাম না, গাইলালেও আমি ভারত থেকে যাইতাম না। আমি এইহানেই থাকমু। অহন আপনারা যদি আমারে রাহন, আমি থাকমু। আমারে না রাখলে আপনেরা জেলে ভইরা থুইয়া দেন। আমি আর বাংলাদেশে যাইতাম না।’ বলে দাবি করেন তিনি।
Advertisement
এবিপি আনন্দর ভিডিও প্রতিবেদনে একবার তার নাম ‘শঙ্করচন্দ্র সরকার’, আরেকবার তার নাম ‘সুধীরচন্দ্র সরকার’ বলে উল্লেখ করা হয়। এনডিটিভির প্রতিবেদনে অভিযোগকারীকে ‘শঙ্করচন্দ্র সরকার’ বলে উল্লেখ করা হয়।
এবিপি আনন্দর ভিডিও প্রতিবেদনে কিশোরগঞ্জের সজিব সরকারকে একবার ‘শঙ্করচন্দ্র সরকার’, আরেকবার ‘সুধীরচন্দ্র সরকার’ বলে উল্লেখ করা হয়।
আটককৃতদের গ্রামের বাড়ি কিশোরগঞ্জের ইটনা উপজেলার ধনপুর ইউনিয়নের করঞ্চা গ্রামে। গ্রামটিতে গিয়ে অভিযোগকারীর নির্যাতনের অভিযোগের বক্তব্যের সত্যতা পাওয়া যায়নি। এছাড়া ভারতের গণমাধ্যমে সাক্ষাৎকার দেওয়া ব্যক্তির নাম সুধীরচন্দ্র সরকার বা শঙ্করচন্দ্র সরকার নন। সাক্ষাৎকার দিয়েছেন সুধীরচন্দ্র সরকারের বড় ছেলে সজিব সরকার। করঞ্চা গ্রামে পরিবার নিয়ে বাস করছেন সুধীরচন্দ্র সরকারের ছোট ছেলে শঙ্কর সরকার।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ইটনার ধনপুর ইউনিয়ন হিন্দু অধ্যুষিত এলাকা।
Advertisement
করঞ্চা গ্রামে গেলে শঙ্কর সরকারের প্রতিবেশীরা জানান, ধনপুরে এখন পর্যন্ত হিন্দুদের ওপর হামলা বা নির্যাতনের কোনো ঘটনা ঘটেনি। সুধীরচন্দ্র সরকারের সঙ্গে এলাকার কারো ঝগড়া বা সমস্যা হয়নি। গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পরিবর্তনের পর কিছুদিন আগে স্বেচ্ছায় পরিবার নিয়ে ভারতে চলে গেছেন সুধীরচন্দ্র সরকার। ভারতীয় গণমাধ্যমে সুধীরচন্দ্র সরকারের বড় ছেলে সজিব সরকারের মিথ্যা বক্তব্য শুনে তারা হতভম্ব হয়ে গেছেন বলে জানিয়েছেন।
সুধীরচন্দ্র সরকারের ছোট ছেলে শঙ্কর সরকার জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমার বড় ভাই সজিব সরকার তিন বছর কিশোরগঞ্জ শহরে গাড়ি চালিয়েছেন। কিশোরগঞ্জে গাড়ি চালাতে গিয়ে কী সমস্যা হয়েছে তা আমাদের জানাননি। পরে বাড়িতে এসে বড় ভাই বলেন, ভারতে চলে যাবেন। সবারই আলাদা সংসার রয়েছে। তাই তাদের কথা বলতে পারি না। এখানে আমার বলার কিছুই ছিল না। পরে একদিন তারা ভারতে চলে গেছেন।’
শঙ্কর সরকার বলেন, ‘এলাকায় আমাদের ওপরে কোনো নির্যাতনের ঘটনা ঘটেনি। বড় ভাই মিডিয়ায় যা বলেছেন, সব মিথ্যা।’
কিশোরগঞ্জের ইটনা উপজেলার ধনপুর ইউনিয়নের করঞ্চা গ্রামটি হিন্দু অধ্যুষিত। তাদের ওপর কোনো নির্যাতনের ঘটনা ঘটেনি বলে জানিয়েছেন/জাগো নিউজ
ধনপুর ইউনিয়ন পরিষদের ছয় নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক মহিলা সদস্য মিলন রানী দাস (৬০) বলেন, ‘আমাদের এলাকার আশপাশে কোনো মুসলমান নাই। এখানে আমরা সবাই সনাতন ধর্মের লোক বসবাস করি। ৫ আগস্টের পর থেকে তারা (সুধীরচন্দ্র সরকার) চলে যাবে বলেছিল। পরে হঠাৎ করে একদিন ভারতে চলে গেছেন। ধনপুরের বাজারে, হাটে-ঘাটে এরা কোনো নির্যাতনের শিকার হননি।’
আরও পড়ুন বাংলাদেশ নিয়ে অপপ্রচার চালাচ্ছে ভারতের মিডিয়া ভারতের গণমাধ্যম সত্য বলায় বিশ্বাসী না, সেখানে মিথ্যা চলে ভালো ভারতের মিডিয়ার বিরুদ্ধে সরব বাংলাদেশের নেটিজেনরা ‘সংখ্যালঘু কার্ড’ অনেক খেলা হয়েছে, আর নয়: তারেক রহমানইটনা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মনোয়ার হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, ‘সুধীরচন্দ্র সরকার নির্যাতনের শিকার হয়ে ভারতে পালিয়ে গেছেন এই মর্মে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়। এ ঘটনার সত্যতা যাচাইয়ের জন্য ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে ইটনা থানা পুলিশ। ঘটনাস্থলে গিয়ে এই সংবাদের কোনো সত্যতা পায়নি পাওয়া যায়নি। এই বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে।’
বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদ ইটনা উপজেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক কৌশিক দেব নাথ জয় জাগো নিউজকে বলেন, ‘ধনপুর ইউনিয়নে সংখ্যালঘু নির্যাতনের কোনো ঘটনা ঘটেনি। আমাদের উপজেলার হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন ভালো রয়েছি। ৫ আগস্টের পর থেকে এ পর্যন্ত আমাদের ওপর কোনো আক্রমণ হয়নি।’
কেআরএম/এসআইটি/এমএমএআর/জিকেএস