বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে গণহত্যার অভিযোগের মামলায় গ্রেফতারের পর কারাগারে থাকা সাবেক তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহ্মেদ পলককে ১৮ ডিসেম্বর সেফহোমে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের নির্দেশ দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।
Advertisement
বৃহস্পতিবার (১২ ডিসেম্বর) ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তুজার নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের বিচারিক প্যানেল এ আদেশ দেন। ট্রাইব্যুনালের অন্য সদস্যরা হলেন, বিচারপতি শফিউল আলম মাহমুদ ও বিচারক মো. মহিতুল হক এনাম চৌধুরী।
আদালতে আজ রাষ্ট্রপক্ষের শুনানিতে ছিলেন চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম, অতিরিক্ত চিফ প্রসিকিউটর মিজানুল ইসলাম ও প্রসিকিউটর বিএম সুলতান মাহমুদ।
এর আগে গত ১৮ নভেম্বর গণহত্যার অভিযোগে সাবেক আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলককে গ্রেফতার দেখিয়ে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল। একই সঙ্গে এ বিষয়ে অগ্রগতি প্রতিবেদন ও শুনানির জন্য আগামী ১৭ ডিসেম্বর পরবর্তী দিন ঠিক করেছেন আদালত।
Advertisement
আরও পড়ুন
সাবেক ওসি আবুলকে সেফহোমে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের নির্দেশআইনজীবীরা জানান ‘ছাত্র-জনতার আন্দোলন চলাকালে সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের অভিযোগে তাকে আগামী ১৮ ডিসেম্বর সেফহোমে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের নির্দেশ দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল। একজন চিকিৎসক, প্রসিকিউশনের সদস্য ও আসামিপক্ষের একজন আইনজীবীর উপস্থিতিতে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে গণহত্যার অভিযোগের মামলায় গ্রেফতারি পরোয়ানাভুক্ত শেখ হাসিনা সরকারের সাবেক ৯ মন্ত্রী, দুই উপদেষ্টা, আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত এক বিচারপতি ও সাবেক স্বরাষ্ট্র সচিবকে ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়। পরে তাদের গ্রেফতার দেখিয়ে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন ট্রাইব্যুনাল।
গত ১৮ নভেম্বর দুপুরের দিকে ট্রাইব্যুনাল থেকে একে একে ১৩ জনকে বের করে পুলিশের প্রিজনভ্যানের দিকে নেওয়া হয়। এসময় সাবেক ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক সাংবাদিকদের উদ্দেশে দুহাত তুলে দোয়া চান।
Advertisement
এদিন সকাল থেকেই ট্রাইব্যুনাল এলাকায় গণমাধ্যমকর্মী, আইনজীবী ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের ভিড় ছিল। বিগত সরকারের আমলে দায়িত্ব পালন করা ৯ মন্ত্রী, বিচারক, সচিবসহ ১৩ জনকে হাজির করা হয়েছিল। সকাল সাড়ে ৯টার দিকে নারায়ণগঞ্জ কারাগার থেকে প্রিজনভ্যানে ট্রাইব্যুনালে আনা হয় সাবেক মন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজীকে। এরপর ঢাকার পুলিশের গাড়িতে করে আনা হয় সাবেক মন্ত্রী দীপু মনিকে।
এর কিছুক্ষণ পরই আরেকটি গাড়িতে অন্যদের নিয়ে আসা হয়। তাদের মধ্যে ছিলেন- আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, শাহজাহান খান, ফারুক খান, কামাল আহমেদ মজুমদার, হাসানুল হক ইনু, রাশেদ খান মেনন, জুনায়েদ আহমেদ পলক, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা সালমান ফজলুর রহমান ও তৌফিক-ই-ইলাহী, সাবেক স্বরাষ্ট্র সচিব জাহাংগীর আলম ও সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক।
সাবেক মন্ত্রী দীপু মনিকে কাঠগড়ার পাশে চেয়ারে বসানো হয়। অন্যদিকে অসুস্থতার জন্য সাবেক মন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাককে ওইদিন হাজির করা হয়নি।
১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য গঠন করা হয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। সেই ট্রাইব্যুনালের বিচারে জামায়াতে ইসলামী, বিএনপি, জাতীয় পার্টিসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দলের সাবেক মন্ত্রী, এমপিসহ সংশ্লিষ্টদের বিচার করা হয়।
যুদ্ধাপরাধে গঠিত শেখ হাসিনা সরকারের গড়া যে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে যুদ্ধাপরাধের বিচার হয়েছিল, জুলাই-আগস্ট ‘গণহত্যার’ অভিযোগে সেই ট্রাইব্যুনালের কাঠগড়ায়ই দাঁড়ান আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রীরা।
এসময় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের টিনশেডের এজলাসে একসঙ্গে বসে ছিলেন আসামিরা। ১২ জন পুরুষ আসামি কাঠগড়ার ভেতরে বসলেও সাবেক মন্ত্রী দীপু মনি বসেন কাঠগড়ার বাইরে। প্রায় দুই ঘণ্টা শুনানি করা হয়। এসময় তারা পেছনে বসে সবকিছু দেখছিলেন। শুনছিলেন আইনজীবীদের সাবমিশন। ফাঁকে ফাঁকে একজন আরেকজনের সঙ্গে কথা বলতেও দেখা গেছে। পরে এ মামলার পরবর্তী শুনানির জন্য আগামী ১৭ ডিসেম্বর দিন নির্ধারণ করা হয়। অর্থাৎ ওইদিন এ মামলার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার দিন ঠিক করা হবে।
দুপুরে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের শুনানি শেষে এক ব্রিফিংয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মো. তাজুল ইসলাম বলেন, জুলাই-আগস্ট মাসেই নয়, বিগত সরকার ক্ষমতায় আসার পরেই গুম-খুন ও হত্যার বীভৎসতা সৃষ্টি করে। হিটলারের সময়ের ক্যাম্পের মতো ক্যাম্প তৈরি করে তাতে নিষ্ঠুরভাবে বন্দিদের নির্যাতন করা হয়েছে। তারা শুধু গণহত্যাই করেনি, নির্যাতনের যত রকম পন্থা রয়েছে সবই বাস্তবায়ন করেছে, যা হিটলারের নাৎসি বাহিনীর কথা মনে করিয়ে দেয়।
তাজুল ইসলাম বলেন, বিগত সরকারে যারা গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিলেন, তাদের মধ্যকার ১৩ জনকে আজ অপরাধ ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়েছে। আগামী দিনে যারা ফ্যাসিস্ট হতে চান, তাদের জন্য আজকের দিনটি একটি শিক্ষার দিন। মানবতাবিরোধী অপরাধ করে চিরদিন ক্ষমতায় থাকা যায় না, বিচারের মুখোমুখি হতে হয় তা আজকের দিনের এক বড় শিক্ষা।
তিনি বলেন, ২০০৯ সাল থেকে রাষ্ট্র-যন্ত্র ব্যবহার করে সব রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো রাজনীতিকরণ, দলীয়করণের মাধ্যমে একটি নিপীড়ক সংস্থায় পরিণত করা হয়েছিল, সে স্টোরি আমরা আদালতে তুলে ধরেছি। একটি পরিবারকে ক্ষমতায় রাখার উদ্দেশ্যে পিলখানা হত্যাকাণ্ড, শাপলা চত্বরে হত্যাকাণ্ড এছাড়া নির্বাচন ব্যবস্থা ধ্বংস করে ফেলা হয়েছিল।
এদিকে আসামিপক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট আজিজুর রহমান দুলু সাংবাদিকদের জানান, আসামিদের সঙ্গে আইনজীবীদের দেখা করার সুযোগ দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল। একই সঙ্গে গ্রেফতার ব্যক্তিদের আত্মীয়স্বজন যারা এসেছেন সুশৃঙ্খলভাবে তাদেরও দেখা করার সুযোগ দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল।
তিনি বলেন, আসামিদের অভিযোগের কপি যদি না পাই তাহলে কীভাবে ডিফেন্ট করবো? ডিফেন্ট করার জন্য এবং আসামিদের নির্দোষ প্রমাণের জন্য বিধি অনুযায়ী আবেদন করেছি এবং আবেদনটি মঞ্জুর করেছেন ট্রাইব্যুনাল। একই সঙ্গে ট্রাইব্যুনাল বলেছেন, আমরা অর্থাৎ আসামিপক্ষের আইনজীবীরা সুশৃঙ্খলভাবে একজন করে কথা বলতে পারবো এবং সেই আদেশটি আমরা পেয়েছি। আমরা সব আসামির সঙ্গেই কথা বলতে পারবো।
এফএইচ/এমআরএম/এমএএইচ/জিকেএস