মতামত

সংস্কার ভাবনা: আত্মা শুদ্ধি কর আগে

সংস্কার সর্ম্পকে ভাবার আগে জানা দরকার সংস্কার কি? সংস্কারের প্রয়োজন কি? কে সংস্কার করবেন? কার দায়িত্ব? কোথায় কোথায় সংস্কার প্রয়োজন।

Advertisement

সম্প্রতি সংস্কার শব্দটি ব্যাপকভাবে আলোচিত হচ্ছে। সুধীজন, গুনীজন, বুদ্ধিজীবি, রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ীসহ সকলেই এ বিষয়ে আলোচনা করছেন। সংস্কার চাই। চাই সংস্কার, কিন্তু সংস্কার প্রকৃতপক্ষে কি? সে সর্ম্পকে আমাদের অনেকের স্বচ্ছ ধারনা নেই। সহজ কথায় সংস্কার শব্দটির অর্থ মেরামত করা অথবা সংশোধন করা। কিন্তু শব্দটি বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিভিন্নভাবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। ব্যাপক অর্থে সংস্কার হল একত্রকরা, ভালোভাবে সম্পন্ন করা, নিখুঁত করা।

মোটামুটি সংস্কার বিষয়টি তখনই আসে যখন একটি বস্তু বা বিষয়ের নিম্মতর গুণাবলী থেকে অপেক্ষাকৃত উচ্চতর গুণাবলী সম্পন্ন করে গড়ে তোলার প্রয়োজন দেখা দেয়। আরও সহজভাবে বলতে গেলে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বা বস্তুতে ভুলভ্রান্তি, ক্রটি বিচ্যুতি সংশোধন অথবা নির্মূল করে উহার গৌরবপূর্ণ স্বীকৃতি এবং সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে সর্বজন কর্তৃক গ্রহণযোগ্য করে তোলার নাম সংস্কার। তবে সম্মানজনক স্বীকৃতি আদায় করা এর অন্যতম উপাদান। বৃহত্তর অর্থে কোনো প্রতিষ্ঠান ধর্মীয়, রাজনৈতিক বা সামাজিক প্রতিষ্ঠান এমনকি সরকারি বা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে উন্নত করার জন্য পরিবর্তন করার প্রক্রিয়াটিকে সংস্কার বলা হয়ে থাকে।

ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ছিদ্র মেরামত করে যেমন বৃহৎ জাহাজ মহাসমুদ্র গমনোযোগী করা যায়, তেমনি মানুষের মনোজগতের ছোট মেরামতের মাধ্যমে বৃহৎ উদ্দেশ্য সফল করা সম্ভব। এতে অবশ্য দীর্ঘ সময় প্রয়োজন। তবে রাষ্ট্র সংস্কারের চালকের ভূমিকা সরকারকেই বহন করতে হবে।

Advertisement

সংস্কারের সবচেয়ে গুরত্বপূর্ণ বিষয় দেশের ঊর্ধ্বমুখী মানুষের জন্য, উন্নত জীবন ও উন্নত জনসেবা তৈরির জন্য সংস্কারের মাধ্যমে উন্নত পরিবর্তন সম্ভব। এ মাধ্যম বা পদ্ধতি দূরবর্তী সময় (Long term) বা ভবিষ্যতের জন্য হতে পারে, কিন্তু এ পদ্ধতির গতি ধীর। এ ক্ষেত্রে প্রচুর গবেষণা ভালো-মন্দ যাচাই, প্রায়োগিক দিক ইত্যাদি বিবেচনার প্রয়োজন। এ জন্য দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন। এই বিবেচনায় প্রকৃত কার্যকরী মাধ্যম ‘বিপ্লব’। কোনো জরুরি পরিবর্তনের জন্য বিপ্লব খুবই কার্যকর। এটি একটি মহৌষধ-সর্বরোগ সংহারকারী। ইংরেজিতে যাকে বলে Panacea, সংস্কারের জন্য তা ব্যবহার করা অনেক ক্ষেত্রে অনিবার্য।

সম্প্রতি সময়ে ঘটে যাওয়া সরকার পরিবর্তন একটি ‘বিপ্লব’। একটি ঐতিহাসিক বিপ্লব ঘটে গেছে। মহাবিপ্লব এমনি হয়। সময়ের যৌক্তিক দাবী, মানবের প্রাণের দাবি একাকার হলেই বিপ্লব ঘটে। সময় লাগে কম, প্রাপ্তি বিশাল। এখন এই বৃহৎ প্রাপ্তি ধরে রাখতে হলে বৃহত্তর পুনঃসংস্কারের প্রয়োজন।

ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ছিদ্র মেরামত করে যেমন বৃহৎ জাহাজ মহাসমুদ্র গমনোযোগী করা যায়, তেমনি মানুষের মনোজগতের ছোট মেরামতের মাধ্যমে বৃহৎ উদ্দেশ্য সফল করা সম্ভব। এতে অবশ্য দীর্ঘ সময় প্রয়োজন। তবে রাষ্ট্র সংস্কারের চালকের ভূমিকা সরকারকেই বহন করতে হবে। আর সরকার যেহেতু কতিপয় মানবের সমাহার। মানুষ হলো রক্তে মাংসে তৈরি, তারা মেশিন নয় ইট-পাথর নয়, তাই এই রক্ত মাংসের মানুষগুলোকে মানবিক গুণাবলী সম্পন্ন হতে হবে। ক্লেদাক্ত রক্ত নয়, কুলষিত রক্ত নয়, পবিত্র শোনিত ধারা শিরা-উপশিরায় বাহিত হতে হবে।

তদানীন্তন বিট্রিশ প্রধানমন্ত্রী একজন প্রখ্যাত Political Scientist Edmund Burk এর উক্তি প্রনিধানযোগ্য: “Government is a contrivance of human wisdom to provide for human wants”. জনগণের কল্যাণের জন্য মানবিক সৎগুণ সম্পন্ন মানুষের সমাহারই সরকার। সরকারে যারা থাকবেন তাঁরা নৈতিকতাসম্পন্ন উচ্চমানের মানুষ হবেন এটাই আশা করা হয়। নৈতিকতা অত্যাবশ্যক অর্থাৎ “Morality is the Sine Qua Non. Morality is the belief that some behavior is right and acceptable and that other behavior is wrong’. Morality may be specifically synonymous with “goodness”, “appropriateness” or “brightness” অর্থাৎ ভালো মন্দের তফাৎ নির্ণয় করার সক্ষমতা এবং ভাল বা উত্তমকে গ্রহণ করার নামই Morality বা নৈতিকতা।

Advertisement

সংস্কারের প্রথম ও প্রধান উপাদানই হল Morality বা নৈতিকতা সম্বলিত মানব-মানবী। নৈতিকতাই ব্যক্তিগত জীবনে আসল সংস্কার। নৈতিকতা বিবর্জিত মানুষ পশুর সমান। পশুকে দিয়ে সমাজের মানুষের কল্যাণ আনা যায় না। মানুষের প্রবৃত্তি যদি পশুর মতোই হয়, যদি তার হীনতায় সে নিজে লজ্জিত না হয় , তবে কেন তাকে সৃষ্টিকর্তা পশুর আকার দেয় নাই? মনীষীগণ বলেন যদি রাজ্য হারিয়ে যায় দুঃখ করো না, যদি তোমার পরম আত্মীয়গণ তোমাকে ত্যাগ করেন, তাতেও তুমি দুঃখ করো না।

কিন্তু যদি তোমার প্রবৃত্তি নীচ হয়, যদি ইতর পশুর স্বভাবের ন্যায় তোমার আত্মার অবনতি ঘটে, তখন অবশ্য লজ্জিত হও।

অনৈতিক মানুষ নিজের দোষ চোখে দেখে না। পরের দোষ অম্লান বদনে সমালোচান করে, নিজের হাজার দোষ ক্রটি ছাই চাপা দিয়ে রাখেন। মানুষ তোমার ঘুষ গ্রহণ করতে না দেখলেও তুমি তো জান। তোমার আত্মা জানে তুমি ঘুষ গ্রহণ, অনৈতিক কাজে লিপ্ত। এক সময়ে তুমি সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত ঘুষখোর। তাতে তোমার লজ্জাবোধ হওয়া উচিৎ নয় কি? তাই নিজ গৃহ, নিজ পরিবার, নিজ আত্মা শুদ্ধ করার জন্য সংস্কার শুরু কর। তোমার সন্তানকে শেখাও “সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি সারাদিন আমি যেন ভাল হয়ে চলি”। পরিবারের সকল সদস্য প্রতিদিন প্রাতঃরাশ করার আগে, খাবার টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে দু’ হাত উঠিয়ে শপথ গ্রহণ করি “সদা সত্য কথা বলিব, মিথ্যা কথা বলিব না, মিথ্যা বলা মহাপাপ”।

সন্তান এবং পরিবারের প্রত্যেক সদস্যের আত্মার মাঝে শুধু মাত্র সৎগুণ যদি সন্নিবেশিত থাকে, তাহলেই সত্যিকারের মানুষ হিসেবে সমাজে মাথা তোলে, শিরদাঁড়া সোজা করে দাড়াতে পারবে। ব্যক্তি ও সমাজ দুর্নীতির বিরুদ্ধে দুর্দমনীয় প্রতিবাদ করার মত প্রচণ্ড সাহসী হয়ে উঠবে। তাই মনীষী হাইরোক্লিসের উক্তি এখানে প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছেন, “সংস্কার নিজের অন্তর থেকে হতে হবে। আপন আত্মার দিকে প্রথমেই তাকাও। তারপর পরের কথা ভেবো। নিজেকেই প্রথমে প্রেম করো। নিজের জাহাজ ভেঙ্গেছে, সেই কথা আগে ভাব, সেটি দ্রুত মেরামতের ব্যবস্থা কর, অন্যের জাহাজের ক্ষতির চিন্তা কর না। তাহলে নিজে ডুবে মরবে।”

প্রত্যেকে তার নিজের পঙ্কিল আত্মার সংস্কার করতে প্রয়াসী হলেই, সমাজ সংস্কারে আমরা সফল হব। পঙ্কিল, ক্লেদাক্ত আত্মা নিয়ে মানবের কল্যাণ করা বাতুলতা মাত্র, অচিন্ত্যনীয়, তামাশা ছাড়া আর কিছুই না। আত্মা-বিশুদ্ধ হলেই, মানুষ-মানুষ হিসেবে পরিচয় দিতে গর্ববোধ করে। সবার উপরে মানুষ সত্য, এ কথা প্রতিভাত হবে। মলিন আত্মা, পাপাত্মা সম্বলিত মানুষ হয়ে মানুষের উপর অত্যাচার, নিপীড়ন করে, মানুষকে আঘাত দিয়ে, মানুষকে বিচূর্ণ করে, রক্তের হলি-খেলা করে, পাশবিক আনন্দ করে, মায়া-মমতাহীন, প্রেমহীন, নিষ্ঠুর, কাপুরুষ, নীচ-হীন, মিথ্যাচারী, আত্ম-মর্যাদা জ্ঞানহীন, নিন্দুক, ঘাতক, বিশ্বাসঘাতক- এদের মানুষ বলা যায় না। যেমন ছিল ফেসিস্ট শেখ হাসিনা ও তাঁর দোসররা। এর চেয়ে প্রকৃষ্ট উদাহরণ আর নেই।

বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার রাষ্ট্র সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছেন। নিঃসন্দেহে এটি একটি মহতী উদ্যোগ। রাষ্ট্রের বর্তমান দুর্দশাগ্রস্ত অবস্থা থেকে উত্তরনের সংস্কারই একমাত্র পথ। কিন্তু এ পথ খুব সহজ নয়, কন্টকময়। রাষ্ট্রকে যদি পর্বত-গিরিশৃঙ্গ চিন্তা করি এবং সেই পর্বতের পাদমূল থেকে শিরচূড়া পর্যন্ত যদি পচন ধরে, তাহলে কি করতে হবে? বিশাল এ পর্বতের মূলোৎপাটান ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু রাষ্ট্রকে মূলোৎপাটন করা সম্ভব নয়।

রাষ্ট্রকে একসাথে ভাঙ্গা যায় না, কাজেই এটাকে পুনঃনির্মাণ বা ঢেলে পুনঃনির্মাণ করতে গেলে, এর ভিত্তিমূল থেকে সংস্কার শুরু করতে হবে। সেটি হল বর্তমান ধসে পড়া শিক্ষা ব্যবস্থা। এর মূলভিত্তি প্রাথমিক শিক্ষা, নীতি নৈতিকতা, শৃঙ্খলাবোধ, দেশ-প্রেম। কাজেই ‘সংস্কার’ শিক্ষা থেকে শুরু করতে হবে। বিশেষত: নৈতিক শিক্ষা Morality, Ethics ইত্যাদি। চাকুরি প্রার্থীদের গোয়েন্দা তদন্ত রাজনৈতিক বিবেচনায় হওয়া প্রয়োজন নেই। ব্যক্তি ও পরিবারের চরিত্র সত্যবাদিতা, নৈতিকতা, সামাজিক মূল্যবোধ কেমন, এ বিষয়ে গোপন তদন্ত খুব গুরুত্বপূর্ণ।

প্রাথমিক শিক্ষাতেই শিক্ষার্থীকে জানতে দেয়া উচিত ভালো-মন্দ কি? ভালো মন্দের পার্থক্য নির্ণয় করা। ধর্মীয় মূল্যবোধের উপর গুরুত্ব দেয়া। ধর্মীয় শিক্ষার অন্যতম শিক্ষা, ন্যায় বিচার, সুশাসন ইত্যাদি বিষয়। “Allah (God) is the fountain of justice, from God spring all-pervading love and justice for mankind.” এসব জানতে হবে বাল্যকাল থেকেই। রাষ্ট্র সংস্কারের প্রস্তাব বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল অনেক আগে অবতারণা করেছে। দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান সুস্পষ্টভাবে রাষ্ট্র সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা এবং কোথায় কিভাবে তা করতে হবে তাঁর দিক নির্দেশনা দিয়েছেন এর কৌশল ৩১ দফায় সুস্পষ্টভাবে বিধৃত আছে। বর্তমান সরকার সেটি অনুসরণ করলে রাষ্ট্র সংস্কারের কাজে সহায়তা হবে বলে আমার বিশ্বাস।

লেখক : সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও চেয়ারম্যান বাংলাদেশ হাউজ বিল্ডিং ফাইনান্স কর্পোরেশন।asmabdulhalim.2022@gmail.com

এইচআর/এএসএম