হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ‘তৃতীয় টার্মিনাল: সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ’ বিষয়ক গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। এ বৈঠকে শাহজালাল বিমানবন্দরের টার্মিনাল-১ এবং টার্মিনাল-২-এ বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিং সেবা নিয়ে অসন্তুষ্টি এবং ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন অংশীজনেরা। বিমানের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক মানের প্রতিষ্ঠান দিয়ে গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিং সেবার নিশ্চিত করার দাবি জানিয়েছেন তারা।
Advertisement
সোমবার (২ ডিসেম্বর) দুপুরে রাজধানীর লা মেরিডিয়ান ঢাকায় এক এ গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ‘তৃতীয় টার্মিনাল: সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ’ বিষয়ক গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করে এভিয়েশন ও পর্যটন খাতের সাংবাদিকদের সংগঠন এভিয়েশন অ্যান্ড ট্যুরিজম জার্নালিস্ট ফোরাম (এটিজেএফবি)।
বৈঠকে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন এভিয়েশন অপারেটর'স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (এওএবি) সেক্রেটারি জেনারেল ও নভোএয়ার লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মফিজুর রহমান। বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন এটিজেএফবির সভাপতি তানজীম আনোয়ার।
বৈঠকে অন্তর্বর্তী সরকারের বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা হাসান আরিফ, বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মো. মঞ্জুর কবীর ভূঁইয়াসহ শাহজালাল বিমানবন্দরের অংশীজনেরা অংশগ্রহণ করেন।
Advertisement
বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা হাসান আরিফ বলেন, বিমানের গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিংয়ে সক্ষমতার বিষয়টি আমরা দেখবো। যদি বিমানের সক্ষমতার ঘাটতি হয় বিকল্পব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ সময় তিনি তৃতীয় টার্মিনাল চালু হতে আরও এক বছর লাগবে বলে জানান উপদেষ্টা।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ বিমানের তৃতীয় টার্মিনালের গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিংয়ের মতো সক্ষমতা আছে কি নেই, এটা প্রাথমিকভাবে পারসেপশনের একটি বিষয়। তার কারণ, বিমানের এতো দিন যে সার্ভিস আমরা পেয়ে আসছি সেটা মনপুত না। একটি কমন অভিযোগ, আমি টিকিট পাই না কিন্তু বিমানে উঠে দেখি পুরো বিমান ফাঁকা। বিমান যেহেতু এখন আমার দায়িত্বে, সক্ষমতা বৃদ্ধির ব্যাপারে কি কি পদক্ষেপ নিতে হবে সেগুলো নিয়ে গতকাল আলোচনা করেছি। শুধু আলোচনার মধ্যে সীমাবদ্ধ না, আমি এগুলোর ইনেশপেকশনে যাই। আমাকে আপনার মুভিং কন্ট্রোল রুম বলতে পারেন। যদি বিমানের সক্ষমতার অভাব হয়, সেটার বিকল্প ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য ব্যবস্থা করবো।
বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন উপদেষ্টা এ এফ হাসান আরিফ বলেছেন, এখন পর্যন্ত ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল তৈরিতে ২৩ হাজার কোটি খরচ হয়েছে। একটি কি-নোট পেপারে দেখলাম দুর্নীতি না হলে এত টাকা খরচ হওয়া কথা না। নিশ্চয়ই আমরা বিষয়টি খতিয়ে দেখবো।
তিনি বলেন, হাসান আরিফ বলেন, সব কিছুতেই সংস্কারের একটি বিষয় আসছে। দুদকও সংস্কার করার জন্য পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। প্রতিটি বিষয় যেটি বিগত সরকারের ১৭ বছরে ঘটেছে, সেগুলোর শ্বেতপত্র আসছে। সেভাবে বিমানেরও শ্বেতপত্র আসবে। শ্বেতপত্র মানে শুধু অভিযোগই আনা না, এটি আত্মশুদ্ধির একটি প্রক্রিয়া।
Advertisement
বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মো. মঞ্জুর কবীর ভূঁইয়া বলেন, শাহজালালের তৃতীয় টার্মিনালসহ দেশের সব টার্মিনালগুলোকে উন্নত করার জন্য বেবিচক কাজ করছে। এসব টার্মিনালের যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির জন্য উপদেষ্টার সাথে আমাদের কথা হয়েছে। এখন শাহজালালের তৃতীয় টার্মিনাল চালু জাতির কাছে একটা স্বপ্ন। তবে এজন্য বেবিচক বসে নেই। সংশ্লিষ্ট সবাই কাজ করে যাচ্ছেন।
এর আগে প্রবন্ধে এভিয়েশন অপারেটর'স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সেক্রেটারি জেনারেল ও নভোএয়ার লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মফিজুর রহমান বলেন, সম্প্রতি প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে বিমানের জিম্মায় তৃতীয় টার্মিনালের গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিং সেবা দুই বছরের জন্য প্রদানের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে জোর বিতর্ক চলমান এবং তা যৌক্তিক। তৃতীয় টার্মিনাল অপারেশনের ক্ষেত্রে যেন রাজনীতির উপর অপারেশনাল বিষয় প্রাধান্য পায় তার জোর দাবি রাখব। তিনি বলেন, তৃতীয় টার্মিনাল গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিং সেবা এবং টার্মিনাল অপারেশন উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে বর্তমানের গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিং মনোপলি ভেঙে একাধিক কোম্পানিকে দেওয়া হোক। এখানে বিমান প্রসঙ্গ নয়, বরঞ্চ গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিং সেবার মনোপলি ভাঙা সম্ভব হলে চূড়ান্ত বিচারে দেশ ও জাতি উপকৃত হবে। আর অন্য অপারেটরের সাথে যোগ্য বিবেচনা হলে বিমানকেও জাতীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিং সেবার দায়িত্ব দেওয়া যেতে পারে। এতে দেশ এবং জনগণ একধারে আর্থিকভাবে লাভবান হবে এবং উন্নত সেবা পাবে।
এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ ও বিমান পরিচালনা বোর্ডের সাবেক সদস্য কাজী ওয়াহিদুল আলম বলেন, বিশ্বের কোথাও রাজধানী বাস ঘরের ভিতর বিমানবন্দর নেই। সেখানে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর তথা তৃতীয় টার্মিনাল নির্মাণের সময় তার বিবেচনা করা হয়নি। এমন অপরিকল্পিত কার্যক্রমের জন্য ৫৪ বছরেও বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) অর্জন শূন্য।
তিনি বলেন, বিশ্বের কোথাও কোন একটি সংস্থা একক ভাবে বিমানবন্দর গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং করে না। সেখানে শাহজালাল বিমানবন্দরসহ দেশের সব দেশের সব বিমানবন্দর এককভাবে গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিং করছে বিমান। বিষয়ে সেবা দিতে গিয়ে বিমানের বিরুদ্ধে অভিযোগের অন্ত নেই। এখন তারা শাহজালাল বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনালের গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিং নেওয়ার জন্য চেষ্টা করছে। এটা তারা সঠিকভাবে পরিচালনা করতে পারবে তা বলা যায় না।
গোলটেবিলে শাহজালাল বিমানবন্দরের ১ এবং ২ নম্বর টার্মিনালের গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিং সেবার বিষয়ে বিদেশী এয়ারলাইন্সগুলো জানায়, শাহজালাল বিমানবন্দরে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিং দায়িত্বে থাকলেও প্রতিটি এয়ারলাইন্সকে ফ্লাইট অবতরণের পর এবং উড্ডয়নের আগে যাত্রীসেবা নিশ্চিত করতে গড়ে ১০ জন করে কর্মী নিয়োগ দিতে হচ্ছে। যেখানে বিমান গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিংয়ের দায়িত্বে, সেখানে এয়ারলাইন্সগুলো কেন নিজেদের লোক নিয়োগ দেবে।? এ সেবা দেওয়ার জন্য তো বিমান নির্ধারিত ফি পরিশোধ করছে। তাছাড়া বিমানের গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিং নিয়ে নানা সমস্যার কথা বলা হলেও তারা এগুলো আমলে নেয় না। অনেক বিষয় দীর্ঘ সময়ের জন্য পেন্ডিং রাখে। এই রীতি থেকে বের হয়ে আসতে হবে। এয়ারলাইন্সরা বিমানের গ্রাহক, তাদের সমস্যা সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে সমাধান করতে হবে।
এসময় অ্যাসোসিয়েশন অব ট্রাভেল এজেন্টস অব বাংলাদেশ (আটাব) সভাপতি আবদুস সালাম আরেফ বলেন, বাংলাদেশের জাতীয় পরিবহন করে বিদেশে এয়ারলাইন্সগুলো সন্তুষ্ট না। তারা জানিয়েছে বিশ্ব অন্যান্য যেকোনো দেশের তুলনায় শাহজালাল বিমানবন্দরে গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিং চার্জ বেশি। তাদের সন্তুষ্ট করতে হলে শাহাজালাল বিমানবন্দরকে এভিয়েশন হাব করতে হবে।
ইথিওপিয়ান এয়ারলাইন্সের জিএসএ রিদম গ্রুপের হেড অব বিজনেস মাসুদুজ্জামান বলেন, বিমান বাংলাদেশের জাতীয় এয়ারলাইন্স প্রতিষ্ঠান। আমরা চাই বিমান গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিং করুক। কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হলো তাদের কাজের প্রক্রিয়া দীর্ঘ। বাংলাদেশে ফ্লাইট পরিচালনার আগে বিমান থেকে গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিং সেবার অনুমতি নিতে ইথিওপিয়ান এয়ারলাইন্সের ৪ মাসে বেশি সময় ঘুরতে হয়েছে। তিনি বলেন,শাহজালালের নতুন কার্গো টার্মিনাল দেখার আমার সুযোগ হয়েছে। এ টার্মিনালটি বিশ্বের অন্যতম বড় ও আধুনিক। কিন্তু এখন যারা শাহজালাল বিমানবন্দরের কার্গো ব্যবস্থাপনা করছে, তাদের দিয়ে আদও তা ব্যবস্থাপনা করা সম্ভব হবে কিনা তা পর্যালোচনা জরুরী।
এয়ারলাইন্স অপারেটরস কমিটির ঢাকার (এওসি) চেয়ারপারসন দিলারা হোসেন বলেন, শাহজালাল বিমানবন্দরে আজ থেকে ৩০-৪০ বছর আগে যেসব অভিযোগ শুনেছি এখনো একই ধরনের অভিযোগ আসছে। এই বিমানবন্দরে ক্রমেই বিদেশি এয়ারলাইন্স বাড়ছে। কিন্তু গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিংয়ের সেবার মান বাড়ছে না।
গোল টেবিলে বেবিচকের সদস্য (অপারেশন্স অ্যান্ড প্ল্যানিং) এয়ার কমোডর আবু সাঈদ মেহবুব খান, শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নির্বাহী পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন কামরুল ইসলাম, বাংলাদেশ মনিটরের সম্পাদক কাজী ওয়াহিদুল আলম, এয়ার অ্যাস্ট্রার সিইও ইমরান আসিফ, কাতার এয়ারওয়েজের কার্গো ম্যানেজার সুহেদ আহমেদ চৌধুরী, বিশিষ্ট এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ উইং কমান্ডার এটিএম নজরুল ইসলাম, লা মেরিডিয়াল বাংলাদেশের জেনারেল ম্যানেজার কনস্টান্টিনোস গ্যাভরিয়েল, থাই এয়ারওয়েজের এয়ারপোর্ট সার্ভিস সুপারিন্টেনডেন্ট সৈয়দ ইয়াসেরুল আলম, এয়ার ইন্ডিয়ার এয়ারপোর্ট ম্যানেজার শয়নদেব ঘোষ, তার্কিশ এয়ারলাইন্সের স্টেশন ম্যানেজার সেরকান অ্যাকেন , ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের জিএম-জনসংযোগ কামরুল ইসলাম, বাংলাদেশ ফ্রেইট ফরওয়ার্ডার্স অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট কবির আহমেদ, এটিজেএফবির সহসভাপতি রাজীব ঘোষ, সাধারণ সম্পাদক বাতেন বিপ্লব, সাংগঠনিক সম্পাদক ইমরুল কাওসার ইমনসহ কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য ও সাধারণ সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন। এছাড়া দেশি-বিদেশি এয়ারলাইন্স, ট্যুর অপারেটর, ওটিএ’র প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।
এমএমএ/এমএএইচ/এমএস