নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের (নাসিক) ২ নাম্বার ওয়ার্ড ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা হিসেবে পরিচিত। এখানে স্থায়ীর চেয়ে অস্থায়ী বাসিন্দা বেশি। একসময়ে এ ওয়ার্ডে কৃষিজমি ছিল। সেসব জমিতে চাষাবাদ করতে দেখা যেত। তবে অতিরিক্ত ভবন গড়ে ওঠায় এখন কৃষিজমি নেই বললেই চলে। শীতের মৌসুমে পুরো ওয়ার্ড ঘুরে মো. জসিম ও মো. মজিবুর রহমান নামে দুই কৃষককে ব্যস্ত সময় পার করতে দেখা গেছে। অথচ এখানে প্রায় ৮০ হাজার মানুষের বসবাস।
Advertisement
সরেজমিনে জানা যায়, ৩৭ বছর বয়সী মো. জসিম। কখনো নিজে ফসল তুলছেন আবার কখনো কর্মচারীদের দিকনির্দেশনা দিচ্ছেন। শীতকালীন সবজি উত্তোলনে ব্যস্ত সময় পার করতে দেখা গেছে তাকে। দীর্ঘ ২০ বছর ধরে বিভিন্ন মালিকানা জমি লিজ নিয়ে চাষাবাদ করছেন। তবে পুরো বছরে শীতকালীন যে কোনো ফসলে বেশি লাভবান হন বলে জানান তিনি। সেই লক্ষ্যে প্রতি বছরের ন্যায় এবারও সবজি চাষে লাভের স্বপ্ন বুনছেন। এবার ৯০ শতাংশ জমিতে রোপণ করেছেন লালশাক, লাউশাক আর মুলাশাক। তার রোপণকৃত ফসলে ছেয়ে গেছে কৃষিজমি।
পটুয়াখালী জেলার দশমিনা উপজেলার আব্দুর রাজ্জাকের ছেলে জসিম। পড়াশোনায় অমনোযোগী হওয়ায় তরুণ বয়সে ঢাকা ঘেঁষা নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ এসে বড় ভাইয়ের সঙ্গে কৃষকের খাতায় নাম লেখান। বড় ভাই শাহজাহানের অনুপস্থিতিতে ফসলি জমির দায়িত্বভার তার কাছে থাকে। এ পেশায় স্বাবলম্বী হয়ে পরিবার নিয়ে সুখে দিনযাপন করে যাচ্ছেন। সবজি ক্ষেতের ফসল দেখভালের জন্য বছর চুক্তিতে ১৫ হাজার টাকা বেতনে দুজন কর্মচারীও রেখেছেন। বর্তমানে তিনি এবং তার দুই কর্মচারী ফসল উত্তোলনে ব্যস্ত সময় পার করছেন।
নাসিক ২ নাম্বার ওয়ার্ডের মিজমিজি কালুহাজী সড়ক ঘেঁষা পাশাপাশি ৩টি ফসলি ক্ষেতে চাষাবাদ করছেন ৯ নাম্বার ওয়ার্ডের জালকুড়ি উত্তরপাড়া এলাকার অস্থায়ী বাসিন্দা জসিম। তিনি বলেন, ‘১ বছরের চুক্তিতে লিজ নিয়ে ৯০ শতাংশের পাশাপাশি ৩টি জমি নিয়ে চাষ করছি। এবারের শীতের মৌসুমে রোপণ করেছি তিন ধরনের শাক। যা তুলে বাজারে বিক্রি করার প্রস্তুতি নিচ্ছি। এই জমিতে বীজ রোপণ থেকে শুরু করে ফসল বড় হওয়া পর্যন্ত মোট ৫০ হাজার টাকা ব্যয় হয়েছে। এসব ফলন উত্তোলন করে বাজারে তুললে অন্তত ১ লাখ ২০ হাজার টাকা বিক্রি করা সম্ভব।’
Advertisement
তিনি বলেন, ‘জমিতে বীজ রোপণ পরবর্তী লালশাক আর মুলাশাকে ২০-২২ দিন এবং লাউশাকে ১ মাস সময় নিয়েছে ফসল বড় হতে। এগুলো তোলা শেষে আবারও নতুন বীজ ফেলবো। ফসলে জৈব, ইউরিয়া আর টিএসপি সার প্রয়োগ করেছি। পাশাপাশি প্রতি ১০-১২ দিন পরপর ক্ষেতে পানি দিতাম। মূলত আমরা পারিবারিক ভাবে কৃষক। বড় ভাইয়ের অন্য স্থানে আরও কয়েকটি ফসলি জমি আছে।’
আরও পড়ুনসোনারগাঁয়ে ফুলকপি চাষে স্বাবলম্বী আসাদুল্লাহতিস্তার বালুচরে ভুট্টার বীজ বুনছেন কৃষকেরাএকই ওয়ার্ডের মিজমিজি দক্ষিণপাড়া এলাকার মৃত রজ্জব আলীর ছেলে মো. মজিবুর রহমান। ৫৫ বছর বয়সী এই কৃষক দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে চাষাবাদ করছেন। তিনিও এ মৌসুমে ৪টি ক্ষেতের ১৫০ শতাংশ জমি লিজে নিয়ে কুমড়াশাক, পালংশাক, লালশাক এবং কলমিশাক রোপণ করেছেন। ৭০ হাজার টাকার বীজ ফেলেছেন। সব মিলিয়ে মোট খরচ হয়েছে ৯০ হাজারের মতো। তিনি আশাবাদী, এই ফসল বাজারে ২ লাখ টাকা বিক্রি করতে পারবেন।
কৃষক মজিবুর রহমান বলেন, ‘অন্য বছর আরও বেশি জমিতে চাষাবাদ করতাম। এ বছর লিজে বেশি জমি পাইনি। তাই ৪টি ক্ষেতে শাকের বীজ ফেলেছি। একাই ফসলের দেখভাল করি। এরই মধ্যে ৩০ হাজার টাকার শাক বিক্রি করেছি। দুই ছেলে গার্মেন্টস কর্মী হওয়ায় নিজেই ক্ষেতের যত্ন নিয়ে থাকি।’
কৃষক জসিম ও মজিবুরের প্রশংসা করে স্থানীয়রা বলেন, ‘১০-১২ বছর আগে ২ নাম্বার ওয়ার্ড ক্যানেলপাড় অংশে অনেক কৃষিজমিতে চাষাবাদ করা হতো। ২০১১ সালে সিদ্ধিরগঞ্জ সিটি করপোরেশনের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পরই জমির দাম বেড়ে যায়। ফলে চারপাশে দালান-কোঠা গড়ে উঠেছে। জমির দাম বেড়ে যাওয়ায় কৃষিক্ষেতের সংখ্যা কমেছে। তবুও এ সময়ে এ দুজন কৃষক চাষাবাদ করে যাচ্ছেন।’
Advertisement
নাসিক ২ নাম্বার ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর ইকবাল হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানা গেছে, তার ওয়ার্ডে ২৪ হাজার ভোটার এবং বাসিন্দা রয়েছে প্রায় ৮০ হাজারেরও বেশি। তার মতে, ‘কৃষিজমি কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে মানুষেরা খালি জমিকে ভরাট করে ভবন নির্মাণ আর প্রতিষ্ঠান তৈরি করে বেশি লাভবান হচ্ছেন। সেজন্যই কৃষিজমি কমেছে।’
নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মাহমুদা হাসনাত বলেন, ‘সিদ্ধিরগঞ্জে মোট ৫৪৪ হেক্টর জমিতে কৃষকেরা চাষাবাদ করছেন। নতুন নতুন কৃষিপ্রযুক্তি সম্প্রসারণ, প্রকল্পভিত্তিক বরাদ্দ এবং সরকারি বরাদ্দ সাপেক্ষে কৃষকদের মাঝে আমরা উপকরণ বিতরণসহ নানারকম পরামর্শ দিয়ে থাকি। তাদের সঙ্গে আমাদের নিয়মিত যোগাযোগ আছে।’
এসইউ/জেআইএম