দেশজুড়ে

ছাত্রলীগ থেকে শুরু, হয়ে ওঠেন কয়রার ত্রাস

গ্রামের সাধারণ পরিবারে বেড়ে ওঠা এসএম বাহারুল ইসলাম সদ্য নিষিদ্ধ হওয়া ছাত্রলীগের কয়রা উপজেলা সভাপতি হয়েই বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। দুর্ধর্ষ বাহারুলের নেতৃত্বে এলাকায় গড়ে ওঠে পেটুয়া বাহিনী। শুরু করেন দখল ও চাঁদাবাজি। এলাকায় সৃষ্টি করেন ত্রাস।

Advertisement

তার বিরুদ্ধে কেউ কথা বলার সাহস পেতো না। বিরোধ করলেই পেটুয়া বাহিনী দিয়ে শায়েস্তা করতেন তিনি। কয়েক বছরের মধ্যেই আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়ে কোটিপতি বনে যান। একাধিকবার খবরের শিরোনাম হন। বিভিন্ন মামলার আসামি হওয়ার পাশাপাশি শিক্ষক পেটানোর ঘটনায় জেলও খাটেন। তবে কমেনি তার প্রভাব। বহাল ছিল তার রাজকীয় জীবন-যাপন।

বেপরোয়া বাহারুল খুলনা কয়রা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও কয়রা সদর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান। তিনি সাবেক সংসদ সদস্য মো. আক্তারুজ্জামান বাবুর আস্থাভাজন।

৫ আগস্ট আওয়ামী সরকার পতনের পর থেকে সপরিবারে বাহারুল আত্মগোপনে ছিলেন। ওইদিন তার বাড়ি ভাঙচুর ও প্রাইভেটকার আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয় বিক্ষুদ্ধ জনগণ। প্রায় চার মাস আত্মগোপনের পর গত ২৭ নভেম্বর মালয়েশিয়ায় পালিয়ে যাওয়ার সময় ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে গ্রেফতারহন। পরে ২৮ নভেম্বর খুলনার পাইকগাছা সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে পাঠালে আদালত তাকে জেলহাজতে পাঠান। পাইকগাছার আগড়ঘাটা এলাকায় ট্রলারে হামলার অভিযোগে গত ২৬ আগস্ট ফসিয়ার রহমান নামে এক ব্যক্তির করা মামলার আসামি তিনি।

Advertisement

যেভাবে দুর্ধর্ষ হয়ে ওঠেন বাহারুল

এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এস এম বাহারুল ইসলাম নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে ছিলেন। অভাব-অনটনের মধ্যে তার বেড়ে ওঠা। স্কুল জীবনে পড়াশুনায় তেমন ভালো ছিলেন না। কয়রা কপোতাক্ষ মহাবিদ্যালয়ে এইচএসসি পড়ার সময় ২০০২ সালের দিকে ছাত্রলীগের মাধ্যমে রাজনীতিতে হাতেখড়ি। পরে তিনি সরকারি ব্রজলাল (বিএল) কলেজে স্নাতক পড়াকালীন ২০০৯ সালে কয়রা উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি হন।

আওয়ামী লীগ তখন দেশের সরকার গঠন করে। সেই থেকে তার বেপরোয়া জীবন শুরু। ১২ থেকে ১৪ জন উচ্ছৃঙ্খল যুবক সব সময় তার সঙ্গে থাকতো। ইউনিয়ন ভিত্তিক সন্ত্রাসী গ্যাং গড়ে তোলেন। ওই সময়ে উপজেলার ৬৫টি মৎস্য ঘের দখলের অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে। ওই ঘটনায় তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন পত্রিকায় প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার পর সশস্ত্র দলবল নিয়ে হামলা চালান কয়রা উপজেলা প্রেসক্লাবে। ২০১৩ সালে কয়রার উত্তর বেদকাশি কাছারি বাড়ির ঐতিহাসিক বৃক্ষমেলায় পুলিশের সঙ্গে ছাত্রলীগের গুলির ঘটনা ঘটে। ওই ঘটনার মামলার প্রধান আসামি ছিলেন বাহারুল ইসলাম। পরে মামলা আলোর মুখ দেখেনি।

২০১৪ সালে বাহারুল ইসলাম হামলা চালিয়েছিলেন কয়রা উপজেলার সাবেক মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার ও সংবাদকর্মী মাওলা বকসের ওপর। ২০১৪ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে এলাকার বিরোধী রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে হামলা চালায় বাহারুলের বাহিনী। ২০১৬ সালে উপজেলার আরেক সাবেক মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মতিউর রহমান বাহারুলের হামলার শিকার হয়েছিলেন। ২০১৮ সালে কয়রা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক হওয়ার পরে ক্ষমতা আরও বেড়ে যায়। একের পর এক অপরাধ কর্মকাণ্ড ঘটানোর পাশাপাশি উপজেলা প্রশাসনের ওপর খবরদারি করতে থাকেন।

২০২২ সালে উপজেলার উত্তর চক মাদরাসার ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মাসুদুল আলমকে তুলে এনে বাহারুলের অফিস কক্ষে বেঁধে মারধর করা হয়। এতে ওই অধ্যক্ষের একটি চোখ নষ্ট হওয়ার উপক্রম হয়। এ ঘটনায় বাহারুল গ্রেফতার হন। পরে মামলা মুখ থুবড়ে পড়ে।

Advertisement

সুন্দরবনে বিষ দিয়ে মাছ ধরার সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ নিয়ে মহারাজপুরের চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহ-আল মাহমুদের সঙ্গেও বিরোধ হয়। বিষ সিন্ডিকেটের কয়েকজনকে ধরে পুলিশে দিলে কয়রা আদালত প্রাঙ্গণে বাহারুল দলবল নিয়ে মাহমুদের ওপর চড়াও হন। কয়রার প্রতিটি ইউনিয়নে তার সহযোগী গ্যাং ছিল। তাদের সহযোগিতায় বেশিরভাগ চাঁদাবাজি ও দখলদারিত্ব কর্মকাণ্ড পরিচালিত হতো। কয়রা সদর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান হলেও চুক্তিতে সমগ্র কয়রা উপজেলার সালিশ করে অনেক নিরীহ ব্যক্তির মৎস্য ঘের ও জমি তার অনুসারীদের দ্বারা দখল করে নায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়।

সরকারি ত্রাণ বিক্রি, টাকার বিনিময়ে ৪০ দিনের কর্মসূচি শ্রমিক নেওয়া, ভাতাভোগীদের কার্ড দিতেন বাহারুল। বিভিন্ন এনজিও কর্মকর্তাদের চাপ দিয়ে স্কুল ভিত্তিক সাইক্লোন শেল্টার নির্মাণ কাজসহ নানা সুবিধা বাগিয়ে নিতেন। বেদকাশি দেওয়ান খালি জলমহলসহ বিভিন্ন খাল দখল বাণিজ্য করতেন। ২০১২ সালে বাহারুলসহ তার লোকজন শেখ জাহাঙ্গীর কবির টুলু নামের এক সংবাদকর্মীকে মারধর করেন।

যেভাবে জনপ্রতিনিধি হন বাহারুল

কয়রা উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি পদ থেকে অব্যাহতির পর ২০১৬ সালে সদর ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে বাহারুল নৌকা প্রতীক পান। এ নির্বাচনে উপজেলা যুবলীগের সভাপতি ও তৎকালীন ইউপি চেয়ারম্যান বাহারুলের চাচাতো ভাই এসএম শফিকুল ইসলাম বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে বিজয়ী হন। এই নির্বাচন নিয়ে চাচাতো ভাইয়ের সঙ্গে দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে আসে। আর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি জিএম মোহসিন রেজার আস্থাভাজন হয়। পরে ২০১৯ সালে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের জিএম মোহসিন রেজার সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে এসএম শফিকুল ইসলাম ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান থেকে অব্যহতি নেন। তবে ২০১৯ সালের উপ-নির্বাচনে বাহারুল দলীয় মনোনয়ন না পেয়ে ইউপি নির্বাচনে অংশ নেননি। পরবর্তীতে ২০২১ সালে ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে পুনরায় নৌকা প্রতীক পান বাহারুল ইসলাম। এ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের প্রচারণায় বাধাসহ ভোটের দিনে কেন্দ্র দখলের অভিযোগ উঠেছিল তার বিরুদ্ধে। গোলোযোগের কারণে একটি কেন্দ্রের ফলাফল স্থগিত করা হয়। ওই নির্বাচনে বাহারুল ইউপি চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়।

বাবার টিনের ঘর থেকে অঢেল সম্পদের পাহাড়

বাহারুলের বাবার আর্থিক অবস্থা ভালো ছিল না। টিনের একটি ঘর ছিল। তার বাবা ফজর আলী সানা জমি পরিমাপকারী (আমিন)। বাহারুল ছাত্রলীগের উপজেলা সভাপতি হওয়ার পর থেকে চাঁদাবাজী, অবৈধভাবে জমি দখল, ঘের দখলসহ নানাভাবে সম্পদ বাড়তে থাকেন। জনপ্রতিনিধি হওয়ার পরে উন্নয়নমূলক কাজে অনিয়ম, সরকারি ত্রাণ বিক্রি, বিভিন্ন ভাতার কার্ড বিক্রি, ৪০ দিনের কাজে অনিয়ম, বিচারের নামে অর্থ লেনদেনসহ বিভিন্নভাবে অবৈধ টাকা উপার্জন করতেন। এছাড়া কয়রা থানার সামনে তিন একর জমিতে শেখ রাসেল প্রতিবন্ধী স্কুল প্রতিষ্ঠা করে চাকরি দেওয়ার নামে বিভিন্ন মানুষের কাছ থেকে জনপ্রতি তিন থেকে পাঁচ লাখ টাকা নেন। স্কুল এমপিওভূক্তের মাধ্যমে বেতন পাইয়ে দেওয়ার কথা বলে অনেকের থেকে টাকা নিয়েছেন। অনেকে কয়েক মাস বিনা বেতনে চাকরি করে অন্যত্র চলে গেলেও টাকা ফেরত না দিয়ে অন্যজনকে নিয়োগ দেন।

এছাড়া কয়েকজনকে বের করে পুনরায় টাকার বিনিময়ে অন্যজনকে নেন। এক মাদরাসা শিক্ষকের জমি জবর-দখল করে সেখানে ওই স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন বলে অভিযোগ আছে। তাছাড়া কাবিটা-কাবিখা-টিআর’র প্রকল্প নিয়েও নামমাত্র কাজ করে অর্থ আত্মসাৎ করার অভিযোগ রয়েছে। স্বাস্থ্যসেবার নামে দুটি লাইসেন্সবিহীন হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেন। কয়রা সদরে হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার নামে চারতলা ভবন নির্মাণাধীন রয়েছে। অবৈধভাবে দখলের মাধ্যমে সরকারি ও কয়রা উপজেলা বিএনপি নেতা মো. রফিকুল ইসলামের জমি জবর-দখলের মাধ্যমে ওই পাঁচ তলা ভবন নির্মাণ করছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

কয়রা সদর ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের ভিপি তালিকাভুক্ত ৪০ বিঘা জমি তার বাবার নামে ডিসিআর কাটেন। ওই জমির শ্রেণি পরিবর্তন করে ৩ থেকে ৫ লাখ টাকা করে প্লট আকারে বিক্রি করেন। কয়রা সদরে হিন্দুদের ১০ কাঠা জমি দখল করে ১৭টি দোকান করে ভাড়া দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া লবণ পানির ঘের বন্ধের দাবি করে অনেকের পাইপ ভেঙে তাদের কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা নিয়ে ফের ঘের করার ব্যবস্থা করে দেন।

সুন্দরবন থেকে বিষ দিয়ে মাছ শিকার করা সিন্ডিকেট পরিচালনার মাধ্যমে খুলনা শহরে কয়েক খণ্ড জমি কিনেছেন। ২৫ লাখ টাকা দামের প্রাইভেটকার ছিল তার, যেটা পুড়িয়ে দেয় বিক্ষুদ্ধ জনতা। বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন ছাড়া ক্ষুদ্র ঋণের নামে কোটি টাকার সুদের ব্যবসারও অভিযোগ রয়েছে এই আওয়ামী লীগ নেতার বিরুদ্ধে।

বাহারুল আত্মগোপনের পর থেকে কয়রা সদর ইউনিয়ন পরিষদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যনের দায়িত্ব পালন করছেন ইউপি সদস্য লুৎফর রহমান। তিনি বলেন, তার (বাহারুল) বিরুদ্ধে প্রতিনিয়ত অভিযোগ আসছে। আমরা ভুক্তভোগীদের স্থানীয় প্রশাসনের কাছে অভিযোগ করার পরামর্শ দিচ্ছি।

কয়রা উপজেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক জিএম রফিকুল ইসলাম বলেন, আমরা ২০০১ সালে কয়রা কপোতাক্ষ কলেজ হোস্টেলের সামনে ৩৩ শতক জমি কিনি। পরে আরও ১০ শতক জমি কিনি। জমি কেনার পরে টিনের ঘর নির্মাণ করি। ২০২২ সালে আকস্মিক বাহারুল তার দলবল নিয়ে দখল করে নেয়। একপর্যায়ে দখলের বিষয়ে জানতে গেলে ভয় দেখিয়ে জোর করে কোনো টাকা ছাড়াই ৬ শতক জমি দলিল করে নেয়। তখন ভয়ে মুখ খুলতে পারিনি।

কয়রা উপজেলা প্রেসক্লাবের সভাপতি মো. শরিফুল আলম বলেন, বাহারুল উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি হওয়ার পর জমি ও খাল দখল করায় তার বিরুদ্ধে প্রতিবেদন করেন কয়েকজন সংবাদকর্মী। এজন্য প্রেসক্লাবে সন্ত্রাসী হামলার মাধ্যমে ভাঙচুর করেন ও আমাকেসহ অন্যান্য সংবাদকর্মীদের ব্যাপক মারধর করেন। তখন প্রশাসনের কোনো সহযোগিতা পাইনি।

বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, কয়রা উপজেলা শাখার আহ্বায়ক মো. মাওলা বকস বলেন, বাহারুল বাহিনী আমাকে ব্যাপক মারধর করে। দুই মাস হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে স্বাভাবিক হই। আওয়ামী সরকারের সহযোগিতায় বাহারুল কয়রায় ত্রাস সৃষ্টির মাধ্যমে চাঁদাবাজি ও দখলবাজি করে কোটিপতি হয়েছে।

মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা পাইকগাছা থানা পুলিশের উপ-পরিদর্শক মো. মোস্তফা শওকত জামান বলেন, পাইকগাছার ৮/১২০ নম্বর মামলার আসামি ছিলেন বাহারুল। মালয়েশিয়ায় পালিয়ে যাওয়ার সময় ঢাকার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে তাকে গ্রেফতার করে ইমিগ্রেশন পুলিশ। পরে পাইকগাছার সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে পাঠানো হয়। আদালত তাকে জেলহাজতে পাঠান। আদালতে ৭ দিনের রিমান্ডের আবেদন করা হয়েছে। এখনও শুনানি হয়নি।

এফএ/জেআইএম