সাহিত্য

কলঙ্কের দাগ

এককাপ রং চায়ে চুমুক দিতে দিতে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে থাকতে বেশ লাগছিল। পূর্ণ দৃষ্টিতে রূপসুধা পান করছিলাম। ছত্রিশ-চব্বিশ-ছত্রিশের কেবল উল্টোদিক দেখে ছত্রিশ-চব্বিশ বোঝা যাচ্ছিল। এই পরিমাপটা যেহেতু আজ পর্যন্ত নিজে মেপে দেখা হয়নি তাই মনে মনে আন্দাজ করে নেয়া।সে যাই হোক বৃষ্টির আশীর্বাদে চায়ের দোকানে বসে এমন একজন অতুলনীয়ার পেছন দিকটা পর্যবেক্ষণ করেই পুলকিত হচ্ছিলাম। পেছনের দিকটাই যার এত আকর্ষণীয় সামনের দিকটা না জানি আরো কত মোহনীয় হবে এ ভাবনায় তাড়িত হচ্ছিলাম। চুলগুলোও বাতাসে উড়ছে। মনে কুক্ষণেও মুখ আর বুক দেখার বাসনা জন্মেনি।এই একটা বিষয়ের মাধ্যমেই নিজেকে চরিত্রবান পুরুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত রেখেছি। কৌশলটা না বলে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়া ঠিক হবে না। মেয়েদের সবচেয়ে আকর্ষণীয় অঙ্গ একেকজন একেকটা বলতে পারে, তবে আমি বলবো ঠোঁট। লিপস্টিক আর লিপস্টিক ছাড়া শুষ্ক কিংবা তৈলাক্ত যাই হোক না কেন মেয়েদের ঠোঁটের দিকে তাকিয়ে কথা বললে নিজের মনের ভেতর যে ভাবেরই উদ্রেক হোক না কেন সুন্দরীর সামনে নিজেকে সৎ বলে প্রতিষ্ঠিত করা যায়! এছাড়া চোখ কিংবা বুকের দিকে তাকালে নিজের অসংলগ্ন ভাব সহজেই ধরা পড়ে যায়। সামনে থাকা রমণী টের পেয়ে যায় পুরুষ মনে কুমতলব জেগেছে।চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে রাজ্যের ভাবনাগুলো নাড়াচাড়া করছিলাম। মনটা আকুপাকু করছিল কখন ফিরে তাকাবে মেয়েটি। অন্যদিকে তারও দেখলাম তাড়া। হাতব্যাগটা বারবার হাতড়ে কি যেন খুঁজছিল। পাশের বিশ্ববিদ্যালয় কলেজটির ছাত্রী হবে এটা বোঝাই যায়। তার ক্ষোভের কারণটাও স্পষ্ট বুঝতে পারছি। মেয়েদের ওই জাদুর থলেতে নাকি সমুদ্দুরও ধরে! আমার দৃঢ় বিশ্বাস আজ বোধকরি ছাতাটা না আনাতেই সে আক্ষেপ করছে।মনে মনে হাসছিলাম, আমিও তো ছাতা না আনায় এই বৃষ্টির সময় মহল্লার এই চায়ের দোকানটিতে আশ্রয় নিয়েছি, আর তুমি সুন্দরী ছাতা না আনায় বেশ করেছ। তোমার পেছনের দিকটায় পুলকিত হয়েই তো সময় কাটছে বেশ।বারবার মনে হচ্ছিল- একটি বার সে ফিরে তাকাক। কিন্তু একটা বিষয়ে মনটা ভীষণ খুশি হচ্ছিল, এখানে মেয়ে অল্প কয়েকটা তবে বেজোড় মেয়ে ওই একটাই। অথচ তার সামনের দিকের কোনো পুরুষ তার দিকে আমার মত করে তাকাচ্ছে না। আহা সমাজটা ভদ্র মানুষে ভরে গেছে!এতসব ভাবনার মাঝে একটি নারী কণ্ঠের আওয়াজ পেলাম। যে সামনে দাঁড়িয়ে আমার নাম ধরে ডেকে বললো, ‘সিহাব ভাইয়া, কেমন আছেন?’রমণীর ডাকে তার দিকে তাকিয়ে আমি রীতিমত বিব্রত! যে মেয়েটার দিকে তাকিয়েছিলাম সেই মেয়েটাই। নাম ধরে ডাকছে অথচ আমি চিনতে পারছি না!মেয়েটি আমার সামনে বসে পড়লো। এরপর এককাপ চায়ের অর্ডার দিয়ে অভিমানী সুরে বললো, ‘ভাইয়া এখন চিনতেও পারছেন না!’তার নাম ধরে বললাম, ‘তোমাকে না চেনার কি আছে রোজিনা। কিন্তু চেহারার এত পরিবর্তন কেন?’‘কলঙ্কের দাগ লেগেছে ভাইয়া! তাই তো আপনি চিনতে পারছেন না। মন থেকে কোনোদিন আমার দিকে তাকাননি তো তাই এমন হচ্ছে।’ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে কথাগুলো বললো রোজিনা।বেশ বিব্রত হলাম। একটু আগের ‘নায়ক নায়ক ভাব নায়িকার অভাব’ বোধটাও কেটে গেছে! সত্যিই তার মোহনীয় রূপে এক সময় প্রায় পাগলই ছিলাম। আর এ কথা গোপন ছিলো না। আমার খালাদের প্রতিবেশী ওরা। তাই বিয়ের প্রস্তাবই দিয়েছিলাম। তখন একটা ছোট চাকরি করতাম। তাই ওর পরিবার প্রত্যাখান করে। তার সাথেও কথা হয়েছিল, সে তো গুরুত্বই দেয়নি।রোজিনার চা চলে আসায় আমার ঘোর কাটলো। আমিও হতাশার সুরে বললাম, ‘তুমিও তো আমাকে চাওনি। এখনো অাগের মতোই আছি।’ চায়ে চুমুক দিয়ে সে বললো, ‘কীভাবে আপনার কথা আলাদা করে ভাববো। তখন এতজন কাছে ভিড়তে চাইতো যে কাউকেই পাত্তা দিতাম না। একজনকে কিছুটা প্রশ্রয় দিয়েছিলাম তিনিও আমার এ অবস্থা মেনে নিতে নারাজ। এক সপ্তাহ আগে বিয়ে করেছেন।’‘তুমি কি জামাল ভাইয়ের কথা বলছো?’‘হ্যাঁ, ভাইয়া।’‘ও ওনার বিয়েতে তো আমিও ছিলাম। বিয়ের পর বেশ গর্ব করছিল বউয়ের রূপ নিয়ে। তার সঙ্গে তোমার সম্পর্ক ছিল জানতাম না তো। আর তার বউ তোমার চেয়ে বেশি সুন্দরী তো না। যদিও তোমার এই অবস্থা দেখে যে কেউ তাকেই সুন্দরী বলবে।’‘হ্যাঁ, সবাই কেবল সুন্দরী বউ চায়। অথচ বুঝতে চায় না রূপ চিরকাল থাকে না। এখন বাসার লোকেদের কাছেও আমার কদর কমেছে। আগে হাজারটা বিয়ের প্রস্তাব আসতো আর এখন...’‘আচ্ছা বাদ দাও তো রোজিনা, চলো তোমাদের বাসার দিকেই যাচ্ছি। খালাকে নিয়ে একটু ডাক্তারের কাছে যাব। ছোটখালু বাসায় নেই। পিচ্চিটা অসুস্থ। চলো বৃষ্টিও আর নেই।’পথ বেশি না তাই দু’জনে হাঁটা শুরু করলাম। বৃষ্টির পরের বিকেল বেশ ভালোই লাগছে। পথে যেতে যেতে দেখলাম- টুপিপড়া একদল লোক একটি কফিনসহ আমাদের দিকে আসছে। বিপরীত দিকে কিছুটা এগিয়ে গেলেই একটা গোরস্থান। সেদিকেই যাচ্ছে তারা।শবযাত্রার কারণে রোজিনা আর আমি রাস্তুার পাশে দাঁড়িয়ে গেলাম। কার কফিন? কথাটা পরিচিত একজনকে জিজ্ঞেস করতেই বললো, ‘মাহিনের’। যেন আকাশ ভেঙে মাথায় পড়লো। আমার কয়েক বছরে ছোট। ও নাকি কয়েকদিন আগে মোটরসাইকেল অ্যাকসিডেন্ট করেছে। কয়েকদিন হাসপাতালে থেকে আজ মারা গেছে।একটু আগে তাড়িত হওয়া যৌবন যেন বাসনা ভুলে গেল। একবার পাশে থাকা রমণী আর একবার কাঁধে বয়ে চলা কফিনের দিকে তাকালাম।আমার থমকে দাঁড়ানো দেখে রোজিনা বললো, ‘চলেন সিহাব ভাই দাঁড়ালেন কেন?’বেশ কিছুটা সময় কথা না বলে তার সঙ্গে হাঁটছিলাম। সে বোধকরি মনের অবস্থাটা বুঝতে পেরেছে তাই আর কথা বলেনি।তাদের বাসার কাছে আসতেই সে বললো, ‘বাসায় চলেন।’আমি বললাম, ‘আরেকদিন।’ এই বলে হাঁটা দিচ্ছিলাম। দেখি সে কেন যেন দাঁড়িয়ে আছে। আবার পেছন ফিরে তাকে বললাম, ‘রোজিনা এখন কোন ইয়ারে তুমি?’‘ভাইয়া, ফাইনাল ইয়ারে উঠলাম এবার।’‘আচ্ছা যতইচ্ছা পড়াশোনা বিয়ের পর করা যায় না?’সে মাথা নিচু করে হেসে বললো, ‘যাবে না কেন ভাইয়া?’মেজাজটা খারাপ হল! বললাম, ‘আমার কি কোনো নাম নেই? এই ‘ভাইয়া’ শব্দটা তোমার মুখ থেকে শুনতে ভালো লাগে না। আর হ্যাঁ, আজই খালার সঙ্গে আলাপ করবো। বেশি দেরি করতে চাই না। দাগ থাকতে থাকতেই কাজ সারতে হবে। শেষের দিকে হেসে উঠলাম।‘আমার আর কোনো আপত্তি নেই’ বলে লাজুক ভঙ্গিতে সে ভেতরে যাচ্ছিল। পিছু ডাকলাম। সে ফিরে তাকালো। বললাম, ‘সারা শরীরে বসন্তের দাগ নিয়ে এত দুঃখ করার কিছু নেই। কিছুদিন পরেই এগুলো আর থাকবে না। তাই দুর্ভাবনায় শরীর খারাপ করার দরকার নেই। স্বাভাবিকভাবেই চলবে। খাওয়া-দাওয়া ঠিকমত করবে।’তার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। হাসিমাখা মুখ আর অকৃত্রিম লাজুকতা নিয়ে বাসার ভেতরে ছুটে গেল। এসইউ/আরআইপি

Advertisement