জাতীয়

১৪০ থানা-ফাঁড়ি নির্মাণ প্রস্তাবের ব্যয় নিয়ে প্রশ্ন

অস্থায়ীভাবে পরিত্যক্ত জরাজীর্ণ ভবন, স্কুল, ইউনিয়ন পরিষদ, ভাড়া বাড়িতে কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে পুলিশের কয়েকশ থানা, ফাঁড়ি, চেকপোস্ট সেন্টার, আউটপোস্ট প্রভৃতির। এর মধ্যে ১৪০টি সংস্কার ও নতুন করে নির্মাণের প্রস্তাব করেছে বাংলাদেশ পুলিশ। ভবন নির্মাণে যে ব্যয় প্রস্তাব করা হয়েছে তাতে সন্তুষ্ট নয় পরিকল্পনা কমিশন।

Advertisement

‘দেশের বিভিন্ন স্থানে ফাঁড়ি/তদন্ত কেন্দ্র, ক্যাম্প, নৌ-পুলিশ কেন্দ্র, রেলওয়ে পুলিশ থানা ও আউটপোস্ট, ট্যুরিস্ট পুলিশ সেন্টার এবং হাইওয়ে পুলিশের জন্য থানা আউটপোস্ট নির্মাণ’ প্রকল্পের আওতায় এ কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হবে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের উদ্যোগে বাংলাদেশ পুলিশ প্রকল্পটি ৭৩০ কোটি ৫৭ লাখ ৯৮ হাজার টাকায় বাস্তবায়নের প্রস্তাব দিয়েছে।

চলতি সময় থেকে জুন ২০২৭ মেয়াদে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করার কথা। চলতি বছরের ২১ অক্টোবর পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটি (পিইসি) সভা করেছে পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগ। ভৌত অবকাঠামো বিভাগের সদস্য (সচিব) সোলেমান খানের সভাপতিত্বে এ সভা অনুষ্ঠিত হয়।

সভায় পরিকল্পনা কমিশন, পরিকল্পনা বিভাগ, অর্থ বিভাগ, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ, বাংলাদেশ পুলিশ, পুলিশ অধিদপ্তর, জিইডি, আইএমইডিসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। প্রকল্পের কিছু ব্যয় নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে কমিশন। এসব ব্যয় কমিয়ে যৌক্তিক পর্যায়ে নামিয়ে আনতে হবে। প্রকল্পটি পুনরায় সংশোধন করে কমিশনে পাঠানোর পরই পরবর্তী পদক্ষেপ নেবে কমিশন।

Advertisement

পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (ভৌত পরিকল্পনা, পানি সরবরাহ ও গৃহায়ন উইং-১) মো. রফিকুল আলম জাগো নিউজকে বলেন, ‘দেশের বিভিন্ন স্থানে ফাঁড়ি তদন্ত কেন্দ্র, ক্যাম্প, নৌ-পুলিশ কেন্দ্র, রেলওয়ে পুলিশ থানা ও আউটপোস্ট, ট্যুরিস্ট পুলিশ সেন্টার এবং হাইওয়ে পুলিশের আউটপোস্ট জরাজীর্ণ অবস্থায় রয়েছে। এগুলো নির্মাণ জরুরি। সেজন্যই মূলত প্রকল্পটি আমাদের কাছে পাঠানো হয়েছে। প্রকল্পটি নিয়ে আমরা পিইসি সভা করেছি। সভায় সংশ্লিষ্ট সবাই উপস্থিত ছিলেন। আমরা কিছু ব্যয় নিয়ে প্রশ্ন তুলেছি। এসব ব্যয় কমিয়ে পুনরায় সংশোধন করলেই পরবর্তী পদক্ষেপ নেবো।’

যে কারণে নির্মাণ জরুরি

সভায় পুলিশ অধিদপ্তর জানায়, বাংলাদেশের পরিবহন ব্যবস্থার নিরাপত্তা, জাতীয় অর্থনীতির উন্নয়ন ও বিকাশে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতিদিন সড়ক ও জনপদগুলোতে মানুষ চলাচল, পণ্য পরিবহনের মাত্রা আগের তুলনায় অনেকাংশে বেড়েছে। কিন্তু যথাযথ ভৌত অবকাঠামো, অফিস ও যানবাহনের অপ্রতুলতার কারণে কাঙ্ক্ষিত সেবায় বিঘ্ন ঘটছে।

হাইওয়ে পুলিশের সক্ষমতা বাড়াতে অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো প্রয়োজন। নদীমাতৃক বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকার সঙ্গে রাজধানী ঢাকার একটি বিশাল নৌ-পথ নেটওয়ার্ক রয়েছে। এজন্য নৌ-পুলিশের অবকাঠামোগত সংস্কার ও উন্নয়নের বিকল্প নেই। বিদ্যমান রেল পুলিশের থানা ও ফাঁড়িগুলো জরাজীর্ণ।

আরও পড়ুন কাজ ফেলে চলে গেছেন ভারতীয়রা, অনিশ্চয়তায় ১২ হাইটেক পার্ক ৩৭৮ কোটি টাকা খরচের খবর নেই, আরও ৩৪৫ কোটি আবদার পুরান ঢাকায় ভবন ভাঙা-গড়া নিয়ে জটিলতা, ঝুঁকি নিয়ে বসবাস

রেলের থানা ফাঁড়ির জন্য কোনো ভবন না থাকায় রেলস্টেশনে স্বল্প পরিসরে কার্যক্রম পরিচালিত হতো। জনবল বাড়ার কারণে রেল পুলিশে কর্মরত জনবলের আবাসন এবং নিরাপত্তার জন্য নতুন স্থাপনা নির্মাণ ও সংস্কার খুবই জরুরি। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের পর্যটকদের ট্যুরিস্ট পুলিশ নিরাপত্তা দেয়। পর্যটকদের সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন সেক্টরের কর্মপরিধি দ্রুত বাড়ছে। কিন্তু অত্যন্ত সীমিত অবকাঠামো ও লজিস্টিক দিয়ে পর্যটন শিল্পের এ বিকাশমান অগ্রযাত্রার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে কাজ করতে ট্যুরিস্ট পুলিশকে অসুবিধায় পড়তে হচ্ছে।

Advertisement

প্রস্তাবিত নির্মাণকাজ

চারতলা ভিতবিশিষ্ট ৪ হাজার ২শ বর্গফুট আয়তনের দোতলা ফাঁড়ি ও ক্যাম্প, নৌ-পুলিশ, রেলওয়ে পুলিশ ফাঁড়ি, চারতলা ভিতবিশিষ্ট ৫ হাজার ৫শ বর্গফুট আয়তনের দোতলা রেলওয়ে পুলিশ থানা ও চারতলা ভিতবিশিষ্ট ৪২শ বর্গফুট আয়তনের ট্যুরিস্ট পুলিশ সেন্টার, চারতলা ভিতবিশিষ্ট ৫ হাজার ৫৫০ বর্গফুট আয়তনের হাইওয়ে পুলিশ সদর দপ্তর, ১০তলা ভিতবিশিষ্ট ১৫ হাজার বর্গফুট আয়তনের ছয়তলা ট্যুরিস্ট পুলিশ সদর দপ্তর নির্মাণে প্রকল্পটির প্রস্তাব করা হয়েছে। পরিকল্পনা কমিশনের পক্ষ থেকে উল্লেখ করা হয়, পুলিশ, নৌ-পুলিশ, রেল পুলিশ ফাঁড়ি/তদন্ত কেন্দ্র/আউটপোস্টের জন্য আট হাজার ৪শ বর্গফুটের দোতলা ভবন, রেল পুলিশ থানার জন্য ১১ হাজার বর্গফুটের দোতলা ভবন, হাইওয়ে থানা/আউটপোস্টের জন্য ২২ হাজার ২শ বর্গফুটের চারতলা ভবন এবং ট্যুরিস্ট পুলিশ থানার জন্য ১২ হাজার ৬শ বর্গফুট ভবনের প্রস্তাব করা হয়েছে। কিন্তু ডিপিপিতে (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা) কোন অফিসে কোন পর্যায়ের কতজন অনুমোদিত জনবল রয়েছে তার বিবরণ নেই। এছাড়া ফ্লোর ইউজ প্ল্যান ডিপিপিতে সংযুক্ত নেই। গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের প্রাধিকার নীতিমালার প্রাপ্যতা অনুযায়ী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অফিস ও আবাসন স্পেস নির্ধারণের বাধ্যবাধকতা রয়েছে।

এ প্রসঙ্গে পুলিশ অধিদপ্তর জানায়, বিভিন্ন ক্যাটাগরির মোট ১৪০টি স্থাপনা নির্মাণের প্রস্তাব করা হয়েছে। পিইসি সভায় ভৌত অবকাঠামো বিভাগের প্রধান বলেন, বাংলাদেশ রেলওয়ে পুলিশ স্টেশন নির্মাণের বিষয়ে বাংলাদেশ রেলওয়ের সম্মতিপত্র ডিপিপিতে সংযুক্ত করা প্রয়োজন।

কমিশনের প্রশ্ন ও সুপারিশ

পরিকল্পনা কমিশন জানায়, একাধিক ভবনের কাজ একই ঠিকাদার করার ক্ষেত্রে বিভিন্ন কারণে অনেক সময় কাজে বিলম্ব হয়। আলাদাভাবে প্যাকেজ করলে দ্রুততার সঙ্গে কাজ সম্পন্ন করা সম্ভব হয়। প্রস্তাবিত ক্রয় পরিকল্পনায় প্যাকেজ সংখ্যা কেন্দ্র, সেন্টার, থানাভিত্তিক না করে জেলাভিত্তিক করে প্যাকেজ সংখ্যা কমানোর সুপারিশ করে কমিশন।

পরিকল্পনা কমিশনের পক্ষ থেকে উল্লেখ করা হয়, প্রকল্প দপ্তরের জন্য আসবাবপত্র ও তৈজসপত্র বাবদ ৩৬ লাখ টাকা, মাটি পরীক্ষা বাবদ ২ কোটি ১০ লাখ, রাজস্ব খাতে ছাপানো বাঁধাই কোডে মোট ১ কোটি ১০ লাখ, সম্মানি ১ কোটি ২৭ লাখ, ওয়াসা, সিটি করপোরেশন, টিঅ্যান্ডটি, পল্লী বিদ্যুৎ, পিডিবি, ডেসা, ডেসকোর সার্ভিস চার্জ বাবদ ৪ কোটি ২০ লাখ, প্রকল্প দপ্তরের জন্য টেলিফোন বিল বাবদ ১৮ লাখ টাকা রাখা হয়েছে, যা অনেক বেশি। এসব ব্যয় কমানোর সুপারিশ করেছে কমিশন।

অর্থ বিভাগের প্রতিনিধি বলেন, প্রকল্পের আওতায় মোট আটজন জনবল সরাসরি নিয়োগের প্রস্তাব করা হয়েছে। কিন্তু জনবল কমিটির সুপারিশ গ্রহণ করা হয়েছে কি না তা স্পষ্ট নয়।

এ প্রসঙ্গে জননিরাপত্তা বিভাগের প্রতিনিধি বলেন, জনবল কমিটির সুপারিশ গ্রহণের জন্য প্রস্তাব ইতোমধ্যে অর্থ বিভাগে পাঠানো হয়েছে। সুপারিশ পাওয়া গেলে তা পুনর্গঠিত ডিপিপিতে সংযুক্ত করা হবে। অর্থ বিভাগের জনবল কমিটির সুপারিশ গ্রহণ করে তা পুনর্গঠিত ডিপিপিতে সংযুক্ত করা এবং সে অনুযায়ী জনবলের সংখ্যা ও এ খাতের ব্যয় নির্ধারণের বিষয়ে উপস্থিত সবাই একমত পোষণ করেন। পরিকল্পনা কমিশনের পক্ষ থেকে বলা হয়, প্রস্তাবিত প্রকল্পে দোতলা পুলিশ ফাঁড়ি নির্মাণ বাবদ বর্গফুটপ্রতি খরচ ৫ হাজার ২২১ টাকা, তিনতলা ট্যুরিস্ট পুলিশ সেন্টারের বর্গফুটপ্রতি ব্যয় প্রায় ৪ হাজার ৪৪৩ টাকা, চারতলা ফাউন্ডেশনে দোতলা নৌ-পুলিশ কেন্দ্রের বর্গফুটপ্রতি নির্মাণ খরচ ৫ হাজার ২২১ টাকা, চারতলা ফাউন্ডেশনের দোতলা রেল পুলিশ থানার বর্গফুটপ্রতি নির্মাণ খরচ ৫ হাজার ২৪ এবং চারতলা ফাউন্ডেশনে চারতলা হাইওয়ে পুলিশ থানার বর্গফুটপ্রতি নির্মাণ খরচ ৪ হাজার ২৩৬ টাকা। এ নির্মাণব্যয় অনেক বেশি। ব্যয় কমাতে হবে।

এমওএস/এএসএ/এএসএম