জাতীয়

আসল-নকল চেনা দায়, প্রসাধনীর বাজারে নজর নেই বিএসটিআইয়ের

প্রসাধনীর বাজার এখন রমরমা। হাত বাড়ালেই পাওয়া যায় ব্র্যান্ড, নন-ব্র্যান্ড, দেশি-বিদেশি হাজারটা পণ্য। পা থেকে মাথা পর্যন্ত বিভিন্ন ধরনের পাঁচশর বেশি প্রসাধনী সামগ্রী রয়েছে দেশের বাজারে। তবে এসবের কোনটা আসল কোনটা নকল খোদ বিক্রেতাও জানেন না অনেক সময়।

Advertisement

এসব পণ্যের অধিকাংশেরই মান ঠিক করতে পারেনি জাতীয় মান প্রণয়নকারী ও মান নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই)। এতে ক্রেতারা তো প্রতারিত হচ্ছেনই আবার ভেজাল পণ্য ব্যবহারে বাড়ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দেশের বাজারে পাঁচশর বেশি ত্বক চর্চার পণ্য ও কালার কসমেটিকস ব্যবহার করা হলেও বিএসটিআইয়ের মান সনদ রয়েছে মাত্র ১০৬টির। নিম্নমানের প্রসাধনীতে ক্ষতিকর নানা উপাদান থাকলেও এখনও শুধু লেড ও মার্কারির মাত্রা নিয়ন্ত্রণের মধ্যে সীমাবদ্ধ বিএসটিআই। যেখানে এখন ক্ষতিকর বেনজোফেনন, আর্সেনিক, ক্যাডমিয়াম, রেটিনাইল পালমিটেট, মারকিউরাস ক্লোরাইড, ক্যালোমেলের মতো বেশকিছু ক্ষতিকর রাসায়নিকের ব্যবহার হচ্ছে হরহামেশা। লেড ও মার্কারিযুক্ত কিছু রং ফর্সাকারী ক্রিম নিষিদ্ধ করা ও বিক্রি বন্ধ করা ছাড়া কোনো নিত্যব্যবহার্য পণ্যের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া বা বিশেষ কোনো মান প্রণয়ন করার দিকে নজর নেই তাদের।

এসব বিষয়ে বিএসটিআইয়ের মান উইংয়ের পরিচালক সাইদুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘প্রসাধনীর বাজার দ্রুত বড় হচ্ছে। সেখানে আমাদের অন্য নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মান প্রণয়নের পাশাপাশি প্রসাধনীর মতো পণ্যগুলো নিয়ে যতটা গুরুত্ব দেওয়া উচিত, সেটা হয়তো হচ্ছে না। তবে এটা তদারকির বাইরে নেই।’

Advertisement

সাইদুল ইসলাম বলেন, ‘এ স্ট্যান্ডার্ড তৈরিও সময়সাপেক্ষ ও কমিটির মাধ্যমে অনুমোদনের বিষয় রয়েছে। যদি কোনো প্রসাধনীর বৈশ্বিক মান নির্ধারিত না থাকে বা কোনো দেশে স্ট্যান্ডার্ড না থাকে তাহলে সেটা আরও দেরি হয়।’

‘নিম্নমানের প্রসাধনীতে উচ্চমাত্রায় বিষাক্ত রাসায়নিকের ব্যবহার হয়। এগুলো নীরবে আমাদের স্বাস্থ্যের ক্ষতি করছে এবং আমাদের জীবন হুমকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে।’-এসডোর সিনিয়র টেকনিক্যাল অ্যাডভাইজার ড. মো. আবুল হাশেম

মাত্রাতিরিক্ত প্যারাবেন

এদিকে সম্প্রতি টুথপেস্ট, হ্যান্ডওয়াশের মতো নিত্যব্যবহার্য পণ্য এবং নিম্নমান ও নকল পণ্যের মধ্যে মাত্রাতিরিক্ত প্যারাবেন পাওয়া গেছে এক গবেষণায়। গত ফেব্রুয়ারি মাসে এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশনের (এসডো) এক গবেষণায় প্রসাধনীতে বিপজ্জনক মাত্রায় প্যারাবেন পাওয়ার বিষয়টি সামনে আসে। সংস্থাটি দক্ষিণ কোরিয়ার প্রতিষ্ঠান ওনজিন ইনস্টিটিউট ফর অকুপেশনাল অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল হেলথের (ডব্লিউআইওইএইচ) ল্যাব থেকে নমুনা পরীক্ষা করিয়ে এ ফলাফল জানায়। তবে এসব ক্ষতিকর রাসায়নিক পরীক্ষার কোনো ব্যবস্থা নেই বিএসটিআইয়ের কাছে।

আরও পড়ুন: দেশে প্রসাধনীর বড় বাজার, কালোবাজারিতে কম রাজস্ব দেশে নকল প্রসাধনী বাড়ার শঙ্কা ব্যবসায়ীদের নকলের ভিড়ে আসল প্রসাধনী চিনবেন যেভাবে

এসডো ওই গবেষণায় যেসব ব্র্যান্ডের পণ্যের নমুনা পরীক্ষা করেছিল সেগুলোর প্রায় সবগুলো নামিদামি ব্র্যান্ডের। তবে এর চেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ দেশে সয়লাব হওয়া নকল ও নিম্নমানের নিত্যব্যবহার্য পণ্য। ওই গবেষণার পর কোনো কার্যকর ব্যবস্থা অথবা বিদেশ থেকে পণ্য পরীক্ষা কিংবা প্যারাবেনসহ অন্য ক্ষতিকর রাসায়নিক মাত্রা বেঁধে দিতে দেখা যায়নি বিএসটিআইকে।

Advertisement

প্যারাবেন হলো প্রিজারভেটিভের মতো এক ধরনের রাসায়নিক, যা সাধারণত প্রসাধনী, পার্সোনাল কেয়ার প্রোডাক্ট এবং ওষুধপত্রের মেয়াদ বাড়ানোর জন্য ব্যবহৃত হয়। প্যারাবেন কম ব্যয়বহুল এবং সহজলভ্য হওয়ায় উৎপাদনকারীরা এটি বেশি পরিমাণে ব্যবহার করেন। এসব পণ্য নিয়মিত ব্যবহারে বাড়ছে ত্বকের ক্যানসারসহ নানান রোগের ঝুঁকি।

গবেষণা সংস্থা এসডোর সিনিয়র টেকনিক্যাল অ্যাডভাইজার ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মো. আবুল হাশেম জাগো নিউজকে বলেন, ‘নিম্নমানের প্রসাধনীতে উচ্চমাত্রায় বিষাক্ত রাসায়নিকের ব্যবহার হয়। এগুলো নীরবে আমাদের স্বাস্থ্যের ক্ষতি করছে এবং জীবন হুমকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘জনস্বাস্থ্য রক্ষার জন্য ভোক্তাদের পণ্যে প্যারাবেন ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে নীতিনির্ধারকদের আরও কঠোর হওয়া প্রয়োজন। এসব রাসায়নিকের ব্যবহার নিষিদ্ধ করার এখন সময় এসেছে। সে আহ্বান বাংলাদেশ সরকারের প্রতি জানানো হচ্ছে।’

‘বাংলাদেশের এমন কোনো কসমেটিকস পণ্য নেই, যা নকল হয় না। মোড়কজাত এসব পণ্য যখন বাংলাদেশে আসে, তখন অনেকগুলো ধাপ পার করতে হয়। এর মধ্যে প্রথম হচ্ছে পণ্যে আমদানিকারকের তথ্য থাকতে হবে। কিন্তু আপনারা দেখবেন বেশিরভাগ পণ্যের আমদানির তথ্য থাকে না।’- জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক এ এইচ এম সফিকুজ্জামান

৭০ শতাংশ কসমেটিকস নকল ও নিম্নমানের

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণা বলছে, দেশে যে পরিমাণ কসমেটিকসের চাহিদা, তার ১৫ শতাংশ পূরণ হচ্ছে দেশি কোম্পানির মাধ্যমে। ১৫ শতাংশ আমদানি করা হয়। বাকি ৭০ শতাংশ কসমেটিকস নকল ও নিম্নমানের ক্ষতিকারক উপাদান দিয়ে তৈরি হচ্ছে। পুরান ঢাকার চকবাজার, ইসলামপুর, কেরানীগঞ্জের জিনজিরা ও ঢাকার বাইরের বিভিন্ন জেলা শহরে এই ভেজাল কসমেটিকস তৈরির কারখানা গড়ে উঠেছে। জনস্বাস্থ্যের জন্য এগুলো চরম ক্ষতিকর।

আরও পড়ুন: নকল প্রসাধনীর বিরুদ্ধে অভিযানের নির্দেশ মানবাধিকার কমিশনের নকল প্রসাধনী তৈরি-বাজারজাত: এ ব্যবসায় যেন তাদের ঐতিহ্য নকল কসমেটিকসে প্রতারিত হচ্ছে গ্রাহক: জাতীয় ভোক্তা অধিদপ্তর

কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) তথ্য অনুযায়ী, বাজারে প্রতিষ্ঠিত অনেক ব্র্যান্ডের প্রসাধনীর লেবেল ও মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখ নেই। এক জরিপে দেখা গেছে, ৪৫ শতাংশ প্রসাধন পণ্যের বিএসটিআই সনদ নেই, ৭৫ শতাংশ পণ্যের উৎপাদক প্রতিষ্ঠানের ঠিকানা নেই।

ইউনিলিভার, স্কয়ার টয়লেট্রিজ, কোহিনূর কেমিক্যাল, লালবাগ কেমিক্যালের পাশাপাশি বিদেশ থেকে আমদানি করা বড় বড় ব্র্যান্ডের পণ্য প্রকাশ্যে নকল করে বাজারজাত করছে একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী। ফলে হাত বাড়ালেই মিলছে আসলের পরিবর্তে নকল আর ভেজাল পণ্য। যার মোড়ক বা ভেতরের পণ্য দেখে কারও বোঝার সাধ্য নেই কোনটি আসল, কোনটি নকল।

আবার বিদেশি আমদানি পণ্যের মোড়কেও বিখ্যাত সব ব্র্যান্ডের প্রসাধনী নকল করে তা বাজারজাত হচ্ছে বড় বড় সুপারশপ থেকে শুরু করে ব্র্যান্ড হাউজে। অনেক ক্ষেত্রে পরিত্যক্ত মোড়ক ও কৌটায় নকল প্রসাধনী ঢুকিয়েও বিক্রি করা হচ্ছে।

জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক (ডিজি) এবং শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব এ এইচ এম সফিকুজ্জামান জাগো নিউজকে বলেন, ‘বাংলাদেশের এমন কোনো কসমেটিকস পণ্য নেই যা নকল হয় না। মোড়কজাত এসব পণ্য যখন বাংলাদেশে আসে, তখন অনেকগুলো ধাপ পার করতে হয়। এর মধ্যে প্রথম হচ্ছে পণ্যে আমদানিকারকের তথ্য থাকতে হবে। কিন্তু আপনারা দেখবেন বেশিরভাগ পণ্যের আমদানির তথ্য থাকে না। এতে প্রমাণিত হয় এ কসমেটিকসগুলো আমদানির প্রোপার চ্যানেলে আসছে না। এগুলো অবৈধ পণ্য।’

সফিকুজ্জামান আরও বলেন, ‘এছাড়া দেশের আনাচে-কানাচে এখন নকল পণ্য তৈরির কারখানা হয়েছে। যারা নামিদামি ব্র্যান্ডের পণ্য নকল করছে। জনস্বাস্থ্যের জন্য যা মারাত্মক হুমকি।’

‘আমাদের যে পরিমাণ পণ্যের মান প্রণয়ন করা গেছে, তাতে প্রচলিত বেশিরভাগ প্রসাধনী রয়েছে। তবে এ বাজার প্রতিনিয়ত বড় হচ্ছে। ফলে স্বল্প পরিসরে কাজ কঠিন হয়ে পড়ে।’- বিএসটিআইয়ের মান উইংয়ের সহকারী পরিচালক (রসায়ণ) মঞ্জুরুল করিম

প্রসাধনীর যথার্থ মান প্রণয়নে গড়িমসি

এসব বিষয়ে কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহ-সভাপতি এস এম নাজের হোসাইন জাগো নিউজকে বলেন, এত সমস্যার পরেও প্রসাধনীর বাজারে শৃঙ্খলার ক্ষেত্রে যতটা গুরুত্ব দেওয়া দরকার ছিল, কখনো সরকার বা কেউ সেটা দেখায়নি। জাতীয় মান প্রণয়নকারী ও মান নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে এর দায় বিএসটিআই এড়িয়ে যেতে পারে না। তারা প্রসাধনীর যথার্থ মান প্রণয়নে গড়িমসি করেছে।

আরও পড়ুন: ইউরোপে বহু প্রসাধন সামগ্রীতে মিললো নিষিদ্ধ রাসায়নিক টুথপেস্ট-কসমেটিকসে ক্ষতিকর কেমিক্যাল, বাড়ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি

বিএসটিআই সনদ অনুমোদিত দেশে এখন কত ধরনের প্রসাধনী সামগ্রী রয়েছে বাজারে এ তথ্য নেই। তবে সংস্থাটি ধারণা করছে, সামগ্রিক উৎপাদনের ৩০ শতাংশ পণ্য বিএসটিআই মান সনদের আওতায় আনা সম্ভব হয়েছে। এখনও দেশের ৭০ শতাংশ পণ্য মান নিয়ন্ত্রণের বাইরে।

বিএসটিআইয়ের মান উইংয়ের সহকারী পরিচালক (রসায়ন) মঞ্জুরুল করিম বলেন, ‘আমাদের যে পরিমাণ পণ্যের মান প্রণয়ন করা গেছে, তাতে প্রচলিত বেশিরভাগ প্রসাধনী রয়েছে। তবে এ বাজার প্রতিনিয়ত বড় হচ্ছে। ফলে স্বল্প পরিসরে কাজ কঠিন হয়ে পড়ে।’

বারডেম হাসপাতালের ডায়াবেটিস ও হরমোন বিভাগের অধ্যাপক ডা. ফারুক পাঠান জাগো নিউজকে বলেন, মাঠ পর্যায়ে তদারকি সংস্থার নিষ্ক্রিয়তায় ব্যবসায়ীরা ইচ্ছেমতো ক্ষতিকর রাসায়নিক ব্যবহার করছে নিত্যব্যবহার্য পণ্যে। ফলে একসময় মানুষ না জেনেই হরমোন, থাইরয়েড, বন্ধ্যাত্বের মতো রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। এছাড়া দীর্ঘমেয়াদে ক্যানসারের মতো মারণব্যাধিতে আক্রান্তের হারও বাড়ছে। বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখা দরকার বলে মনে করেন তিনি।

এনএইচ/এসএনআর/এমএমএআর/এএসএম