সংবিধান ও রাষ্ট্রব্যবস্থার গণতান্ত্রিক সংস্কার এবং অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে গত বছরের ১৩ জুলাই ৩১ দফা ঘোষণা করে বিএনপি। এর এক বছর পর গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতার পটপরিবর্তন হয়। গঠন করা হয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। সেই সরকার এরই মধ্যে রাষ্ট্র সংস্কারে বিভিন্ন কমিশন গঠন করেছে। এ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে দেখা দিয়েছে নানা প্রশ্ন, বিতর্ক ও মতানৈক্য।
Advertisement
বিএনপি ঘোষিত ৩১ দফা নিয়ে অন্য রাজনৈতিক দলগুলো কী ভাবছে, তাদের প্রস্তাব বা পরামর্শ কী, সেসব কথাই উঠে এসেছে বিএনপি আয়োজিত এক সেমিনারে। যেখানে বিভিন্ন দলের নেতারা কথা বলেছেন ৩১ দফা নিয়ে।
বৃহস্পতিবার (১৪ নভেম্বর) রাজধানীর হোটেল লেকশোরে ‘৩১ দফা রাষ্ট্র কাঠামো মেরামতের রূপরেখা ও নাগরিক ভাবনা’ শীর্ষক ওই সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। তার দল ক্ষমতায় গেলে কী করতে চান, সেসব প্রতিশ্রুতিও ব্যক্ত করেন তিনি।
আরও পড়ুন
Advertisement
স্বাগত বক্তব্যে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার রাষ্ট্র সংস্কারের যে উদ্যোগ নিয়েছে, সেখানে বিএনপি ঘোষিত ৩১ দফার সঙ্গে অনেকটাই মিল রয়েছে।
৩১ দফার ওপর আলোচনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক মাহবুব উল্লাহ বলেন, সংবিধানের মূলনীতি হওয়া উচিত সাম্য, সামাজিক মর্যাদা ও ইনসাফ। এগুলোই ছিল আমাদের মুক্তিযুদ্ধকালীন মূলনীতি। বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব ও রাষ্ট্রীয় অখণ্ডতার জন্য প্রাদেশিক সরকার ব্যবস্থায় যাওয়া হবে বিপথগামী চিন্তা।
আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টির যুগ্ম সদস্যসচিব আসাদুজ্জামান ফুয়াদ বলেন, ৩১ দফার মধ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর সংস্কারের জন্য কোনো দফা নেই, সব দফা রাষ্ট্র সংস্কারের জন্য। সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ শুধু সংসদে চর্চা করলেই হবে না, এটি দলের অভ্যন্তরেও আলোচনা করার কালচার তৈরি করতে হবে।
জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল রফিকুল ইসলাম খান বলেন, ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবরের লগি-বইঠার হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের প্রতিটি সেক্টর ধ্বংস করে দিয়েছে ফ্যাসিবাদ, তাই রাষ্ট্র মেরামত করতে হবে। জামায়াত মনে করে, জাতির প্রয়োজনে যখন যতটুকু সংস্কার প্রয়োজন ততটুকু সংস্কার করতে হবে রাজনৈতিক ঐকমত্যের ভিত্তিতে। এমনকি সব সংস্কার হতে হবে জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে।
Advertisement
বিএনপির ৩১ দফায় কোনো নিরাপদ অধ্যায় নেই বলে মনে করেন জাতীয় পার্টির একাংশের চেয়ারম্যান মোস্তফা জামাল হায়দার।
নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন আমার দলের জন্য ভালো, বিএনপি জন্য লস। কারণ আমার দল ১/২ শতাংশ ভোট পেলে সংসদে ৩-৬টি আসন পাবে। কিন্তু বর্তমান পদ্ধতিতে আমার দল ৩০০ আসনের একটিতেও জিতবে না। তবে আমার ভয় হয়, সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন ব্যবস্থায় আওয়ামী ফ্যাসিবাদ আবার ফিরে আসে কি না।
বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, সংসদে ধর্মীয় সংখ্যালঘু, পাহাড়ি, সমতল, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ও উপজাতি জনগোষ্ঠী কীভাবে প্রতিনিধিত্ব করবে, বিএনপিকে সেটা নিশ্চিত করতে হবে। যারা নির্বাচনে হারবে তাদের ভয়েসটা কীভাবে সংসদে তুলে ধরা যায় সেটাও ভাবতে হবে। সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন যাওয়া উচিত কি না সেটা নিয়েও বিশদ আলোচনা দরকার।
সেমিনারে বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির (বিজেপি) চেয়ারম্যান আন্দালিব রহমান পার্থ বলেন, বিএনপির ৩১ দফাই শেষ কথা নয়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রয়োজনীয় আরও বিষয় যেন যুক্ত করা যায় সেটির সুযোগ রাখতে হবে।
লেবার পার্টির একাংশের চেয়ারম্যান মোস্তাফিজুর রহমান ইরান বলেন, সংবিধানে কিছু মীমাংসিত বিষয় আছে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, আল্লাহর ওপর আস্থা, বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম, এ বিষয়গুলো নিয়ে কোনো মঞ্চে আলোচনার প্রয়োজন নেই।
আরও পড়ুন
যা আছে বিএনপির ৩১ দফায়বিএনপির মিডিয়া সেলের সদস্য ফারজানা শারমিন পুতুল ও সাংগঠনিক সম্পাদক শামা ওবায়েদের সঞ্চালনায় এবং মির্জা ফখরুলের সভাপতিত্বে সেমিনারে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, সালাউদ্দিন আহমেদ, ড. আব্দুল মঈন খান, সেলিমা রহমান, হাফিজ উদ্দিন, নজরুল ইসলাম খান, ভাইস চেয়ারম্যান আলতাফ হোসেন চৌধুরী, উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, যুগ্ম মহাসচিব শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানি প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
এছাড়াও ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টির চেয়ারম্যান আবু তাহের, জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলন-এনডিএম চেয়ারম্যান ববি হাজ্জাজ ও গণফোরাম সভাপতি অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী সেমিনারে বক্তব্য রাখেন।
এতে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা মিস হুমা খান, পাকিস্তানের হাইকমিশনার সৈয়দ আহমেদ মারুফ, ভারতের ডেপুটি হাইকমিশনার বিনয় গরগে, জাপানের রাষ্ট্রদূত লাউয়ামা কিমিনরি, নরওয়ের রাষ্ট্রদূত এখন আর্লাদ গাল ব্রান্ডেশন, সুইজারল্যান্ডের ডেপুটি রাষ্ট্রদূত করনি হেন্স পিনানি, ইরানের রাষ্ট্রদূত মান সলোরচাভোসী, ইউরোপীয় ইউনিয়নের ডেপুটি রাষ্ট্রদূত ব্র্যান্ড স্পিনার, নেদারল্যান্ড দূতাবাসের চার্চ দ্য অ্যাফেয়ার্স সোনজা কুইপ, নেপাল দূতাবাসের ডেপুটি হেড অফ মিশন ললিতা সিলাওয়াল, ব্রুনাইয়ের হাইকমিশনের ডিফেন্স এডভাইজার হারিস বিন উথমান, অস্ট্রেলিয়া হাইকমিশনের ডিফেন্স এডভাইজার জন ডেমপেসি, কানাডিয়ান হাইকমিশনার হেড অফ পলিটিক্যাল ব্র্যাডলিক কোটচ, চীনা দূতাবাসের কাউন্সিলর ও পলিটিক্যাল প্রধান জিং উইসহ ৩৮টি দেশের কূটনীতিকরা উপস্থিত ছিলেন।
কেএইচ/এমকেআর/জেআইএম