বিনোদন

‘চলুন রামপুরা টিভি ভবন দখল করে ফেলি’

নির্মাতা হুমায়ূন আহমেদের অভাব গভীরভাবে অনুভব করছে চলচ্চিত্রাঙ্গন। নতুন ধরনের গান, গল্প, রসিকতায় ভরা সিনেমা যেন তার হাত ধরে চলে গেছে। ভাবলে বিস্মিত হতে হয়, অনেক সুযোগ-সুবিধা যখন ছিল না, তখনও সমৃদ্ধ সব সিনেমা বানিয়েছিলেন এই নির্মাতা। এসব আজ যেন নতুন সময়ের নির্মাতাদের পাঠ্য! 

Advertisement

নন্দিত এই নির্মাতার জন্মদিনে আজ স্মরণ করিয়ে দেওয়া যেতে পারে তার বানানো মুক্তিযুদ্ধের সিনেমা ‘আগুনের পরশমণি’ নিয়ে একটি ঘটনা। ছবিটি শুটিংয়ের সময় সেনাবাহিনীর একজন মেজরকে তিনি বলেছিলেন, ‘চলুন রামপুরা টিভি ভবন দখল করে ফেলি’।

মুক্তিযুদ্ধের সিনেমা ‘আগুনের পরশমণি’ নির্মিত হয় বিএনপি সরকারের আমলে। লেখা বাহুল্য, এটি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অন্যতম সেরা সিনেমা। সিনেমাটি বানানোর গল্প নিয়ে পরে বই লিখেছিলেন হুমায়ূন আহমেদ। ছবি বানানোর গল্প নামের সেই বইতে হুমায়ূন লিখেছেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের সময়কার অস্ত্রশস্ত্র জোগাড় করা আমার কাছে কোন সমস্যা বলে মনে হল না। পুলিশের কাছে সেই সময়কার সব অস্ত্রই আছে। তাদের কাছে চাইলে তারা নিশ্চয়ই দেবে। আমি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে গুছিয়ে একটি আবেদন করলাম। স্বাধীনতা যুদ্ধে পুলিশের মহান ভূমিকার কথা বললাম। সরকারী সহায়তায় মুক্তিযুদ্ধের ছবিতে আমার কিছু আসল অস্ত্রশস্ত্র দরকার, সেটা বিনয়ের সঙ্গে জানালাম।

দরখাস্ত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে নিজেই দিয়ে এলাম। আমি আবার আরেকটু বুদ্ধি খাটালাম দরখাস্তের ওপর তথ্য মন্ত্রণালয়ের সুপারিশ নিয়ে নিলাম। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলল, তারা ব্যাপারটি নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করে যথাশীঘ্র আমাকে জানাবে। কিছুদিন পর পর আমি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যাই, আমাকে বলা হয় ফাইল এক টেবিল থেকে আরেক টেবিলে যাচ্ছে।

Advertisement

কী করব বুঝতে পারলাম না। সেনাবাহিনীর কাছে যাব? পুলিশ বাহিনীরই যখন এই অবস্থা, সেনাবাহিনী না জানি কী অবস্থা। তবু একদিন অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে গেলাম, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর চিফ অব স্টাফ লেফটেন্যান্ট জেনারেল নূরউদ্দিন খান সাহেবের কাছে। তিনি খুব আন্তরিকতার সঙ্গে আমাকে বসালেন। আমার আবেদনপত্রটি পড়লেন। তারপর বললেন, আপনি বলুন আপনার কী কী চাই।

তাদের সেই কথপোকথনটি এ রকম –

আমি বললাম, গোটা দশেক স্টেইনগান।

দেয়া হল। আর কি?

Advertisement

কিছু গ্রেনেড।

দেয়া হল। আর কি?

মিলিটারী কনভয়। মেশিন গান বসানো থাকবে।

ঠিক আছে। আর কিছু?

শ দুই সেনাবাহিনীর জোয়ান।

আচ্ছা।

তাঁবু।

ঠিক আছে।

একটা ট্যাংক কি দেয়া সম্ভব?

হ্যা সম্ভব, তবে ট্যাংক শহরে নিতে পারবেন না। ট্যাংক থাকবে ক্যান্টনমেন্টের ভেতর।

কবে নাগাদ দিতে পারবেন?

আপনি যখন চাইবেন তখনি দেব। কিছু ফর্মালিটিজ আছে। প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার অনুমোদন লাগবে। সেই ব্যবস্থা আমরা করব। আপনি তা নিয়ে চিন্তা করবেন না।

আমি তখনো বিশ্বাস করতে পারছিলাম না এত সহজে সব ব্যবস্থা হবে। জেনারেল ভূঁইয়াকে (এম-এস-এ-ভূঁইয়া) দায়িত্ব দেয়া হল আমার সাহায্যের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করতে। তিনি হাসি মুখে এগিয়ে এলেন। বেগম খালেদা জিয়ার লিখিত অনুমতি তাঁরাই জোগাড় করে আমার কাছে পাঠিয়ে দিলেন।

ব্রিগেডিয়ার ইমামুজ্জামান বীর বিক্রম সেনাবাহিনীর সব রকম সহায়তা নিয়ে এগিয়ে এলেন। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের খন্ডযুদ্ধের বিষয়গুলি কীভাবে নেয়া হবে তাও তিনি ঠিক করলেন। তাঁর উপস্থিতি এবং পরামর্শ মতো সেই দৃশ্যগুলি ধারণ করা হল। ৪৬ সশস্ত্র পদাতিক ব্রিগেডকে আমার অনেক অনেক অভিনন্দন।

সেনাবাহিনী নিয়ে প্রথম দিন কাজ করার অভিজ্ঞতাটা বলি। সকাল এগারোটায় এফডিসির গেটে হেভী মেশিনগানে সজ্জিত বিরাট এক কনভয় উপস্থিত। সৈনিকরা সব যুদ্ধ সাজে সজ্জিত। এফডিসির সব গেট বন্ধ। আমার মাথা ঘুরে গেল। আবার সেই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের চক্কর। আমি এফডিসি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে দেখা করলাম। তাঁদের বুঝালাম স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর। প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনে সেনাবাহিনী এসেছে। কেন শুধু শুধু জটিলতা করছেন? তাছাড়া সেনাবাহিনী মাথা গরম টাইপ জিনিস। এদের গেটের বাইরে আটকে রেখেছেন, কে জানে ওরা রেগে যাচ্ছে কি-না।

এফডিসির গেট খোলা হল। বিশাল বহর ভেতরে প্রবেশ করল। সে এক দর্শনীয় দৃশ্য। যিনি দলটির নেতৃত্ব দিচ্ছেন তিনি পদাধিকার বলে একজন মেজর। আমি তাঁকে ধন্যবাদ দিলাম। তিনি বললেন, আমার যতক্ষণ ইচ্ছা দলটিকে রাখতে পারি। কাজ শেষ হলে তাঁকে বললেই হবে, তিনি দল নিয়ে চলে যাবেন। সৈনিকদের খাওয়া দাওয়া নিয়েও চিন্তা করতে হবে না। খাওয়া দাওয়া আসবে সেনানিবাস থেকে।

আমি গলার স্বর নিচু করে বললাম, ভাই আপনিতো বেশ সাইজেবল একটা দল নিয়ে এসেছেন। শুটিং এর শেষে চলুন রামপুরা টিভি ভবন দখল করে ফেলি। ‘আগুনের পরশমণি’ নতুন সরকার গঠন করেছে এমন একটা ঘোষণা দিয়ে ফেলি।

ভদ্রলোক চোখ সরু করে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। তাঁর চোখের পলক আর পড়ে না। আমি তাড়াতাড়ি বললাম, রসিকতা করছি। সেনাবাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে রসিকতাতো করা যায়, না-কি তাও করা যায় না? তিনি শুকনো গলায় বললেন, স্যার এই জাতীয় রসিকতায় আমরা অভ্যস্ত নই। আমার সঙ্গে যখন কাজ করছেন ইনশাআল্লাহ অভ্যস্ত হয়ে যাবেন।’

ওই বইতে আরেকটি রসিকতার উল্লেখ করেছেন হুমায়ূন আহমেদ। তিনি লিখেছেন, ‘সেনাবাহিনী প্রধান লে. জে. নূরউদ্দিন সাহেবের সঙ্গে যে রসিকতা করেছিলাম সেটাও বলে ফেলি। তাঁর সঙ্গে কথাবার্তা শেষ হল। চা খাওয়া হল। বিদায় নিয়ে চলে আসছি হঠাৎ বললাম, আপনাদের কোন পুরানো বা রিকন্ডিশন ট্যাংক আছে?

তিনি বিস্মিত হয়ে বললেন, কেন বলুনতো?

আমার একটা কেনার ইচ্ছা। ইউনিভার্সিটিতে ক্লাস নিতে হয়। ট্যাংকে করে গেলে অনেক সুবিধা। জেনারেল সাহেব হো হো করে হেসেছিলেন। সেনাবাহিনীর সদস্যরা রসিকতা বুঝতে পারেন না, এটা বোধ হয় ঠিক না।

আমার ছবিতে সেনাবাহিনীর সদস্যরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় অভিনয়ও করলেন। তাঁরা কেউই পেশাদার অভিনেতা নন, কিন্তু অভিনয় করলেন পেশাদারদের মতোই। সেনাবাহিনীর সদস্যদের সহায়তা না পেলে “আগুনের পরশমণি” নিয়ে আমি এগুতে পারতাম না। ছবি শেষ হবার পর সেনাবাহিনীর আরো কিছু দৃশ্য নতুন করে নেয়ার প্রয়োজন বাড়ল। আমি আবারো গেলাম সেনাবাহিনী প্রধানের কাছে। লেফটেন্যান্ট জেনারেল নূরউদ্দিন তখন নেই। তাঁর জায়গায় এসেছেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল আবু সালেহ মোহাম্মদ নাসিম বীর বিক্রম। তিনি আরো উৎসাহী। হাসিমুখে বললেন, মুক্তিযুদ্ধের ছবি হচ্ছে, এটা আমার জন্যে অত্যন্ত আনন্দের। ছবি শেষ হলে আমাকে দেখাবেন।’

আরএমডি/জেআইএম