বিশ্বের অন্যতম দীর্ঘ অখণ্ড সৈকত নগরী কক্সবাজার। সাগরের তীর ঘেঁষে পূর্বপাশে রক্ষিত বনের সবুজ পাহাড়। সাগর আর পাহাড়ের সম্মিলনস্থলে দুই দশক আগে গড়ে উঠে মেরিন ড্রাইভ সড়ক।
Advertisement
একপাশে সাগরের ঢেউ, অপর পাশে বনে প্রাণীর কোলাহল- এই দুই মিলে মেরিন ড্রাইভ দিয়ে যাওয়া ভ্রমণকারীদের আন্দোলিত করে। অথচ সেই রক্ষিত বনের দরিয়ানগর-হিমছড়ি এলাকার ৭০০ একর জমি জনপ্রশাসন ক্যাডারদের প্রশিক্ষণ একাডেমির নামে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল।
আওয়ামী লীগ সরকারের সময় প্রতিবেশ সংকটাপন্ন এ ভূমি বন্দোবস্তর অনুমতি দিয়েছিলেন শেখ হাসিনা। যার নাম দেওয়া হয়েছিল ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব একাডেমি অব পাবলিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন’। পরিবেশবাদীদের প্রতিবাদের মুখেও ভূমি বরাদ্দের অনুমতি দিয়েছিলেন তিনি। তবে সেসময় নথিতে ‘রক্ষিত বন’ কথাটি আড়াল করা হয়। ২০২১ সালে নেওয়া সেই বনভূমির বরাদ্দ অবশেষে বাতিল করেছে অন্তর্বর্তী সরকার।
সমুদ্রের তীর ঘেঁষে গড়ে ওঠা প্রাকৃতিক বনকে স্থাপনার হাত থেকে রক্ষা করায় স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছে কক্সবাজারবাসী। তাদের দাবি, প্রকৃতি অক্ষুণ্ণ রেখেই পর্যটন ও উন্নয়ন বিকাশ করতে হবে।
Advertisement
সূত্রের তথ্যমতে, বরাদ্দ দেওয়া এ জমির সরকার নির্ধারিত মূল্য প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা। অথচ ‘খাস’ জমি দেখিয়ে মাত্র এক লাখ টাকায় সরকারের কাছ থেকে বরাদ্দ নিয়েছিল প্রশাসন ক্যাডার। সেখানে উহ্য রাখা হয় ‘রক্ষিত বন’ শব্দটি। তাই শুরু থেকে এ বন্দোবস্তর বিরোধিতা করে এসেছে কক্সবাজার নাগরিক ফোরাম। ভূমির বন্দোবস্ত বাতিল চেয়ে হাইকোর্টে রিট করেন সংগঠনের পক্ষে সভাপতি আ ন ম হেলাল উদ্দিন।
পরে হাইকোর্ট বিভাগ এই বন্দোবস্তের বিষয়ে স্থগিতাদেশ দেন। যা আপিল বিভাগে বহাল। রিটের পাশাপাশি এসময় বিভিন্ন ফোরামে কথা বলে পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা)।
৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকারের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা হন সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। এরপর তিনি জনপ্রশাসনকে দেওয়া ৭০০ একর রক্ষিত বনভূমি বরাদ্দ বাতিলের অনুরোধ জানিয়ে ভূমি মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা এ এফ হাসান আরিফকে চিঠি দেন। সেই অনুরোধ ও বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতেই বরাদ্দ বাতিল করা হয়।
সোমবার (১১ নভেম্বর) এ বিষয়ে একটি বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়। যাতে ভূমি মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব আমিনুর রহমান সই করা পত্রের মাধ্যমে উল্লিখিত বিষয়ে যথাযথ কার্যক্রম গ্রহণ করে ভূমি মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন প্রেরণের জন্য কক্সবাজারের জেলা প্রশাসককে অনুরোধ জানানো হয়।
Advertisement
কক্সবাজার নাগরিক ফোরাম সভাপতি আ ন ম হেলাল উদ্দিন বলেন, নব্বই দশকের পর পর্যটন বিকশিত হওয়ার পাশাপাশি কক্সবাজারে আবাসন বাড়ছে। বাসস্থান ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান গড়তে গিয়ে ধীরে ধীরে ধ্বংস করা হচ্ছে প্রকৃতি। এখন অল্প যা অক্ষত রয়েছে সেসবও ধ্বংস হলে কক্সবাজারে প্রকৃতি বলে কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না। তাই সামনের দিনে প্রকৃতি অক্ষুণ্ণ রেখেই পর্যটন বিকাশ ও উন্নয়ন তরান্বিত করতে হবে। ৭০০ একর রক্ষিত বনের বরাদ্দ বাতিল আদেশ, প্রতিবেশ ও পরিবেশ রক্ষায় আমাদের আন্দোলনকে আরও বেগবান করবে।
বনভূমি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের অন্যতম সমৃদ্ধ জীববৈচিত্র্যপূর্ণ ওই বনে প্রাকৃতিকভাবে জন্মানো গাছপালা রয়েছে। বন্যপ্রাণীদের অন্যতম নিরাপদ আবাসও ওই এলাকা। বিশেষ করে পৃথিবীর অন্যতম মহাবিপন্ন প্রজাতির এশীয় বন্য হাতির একটি দল নিয়মিতই ওই অঞ্চলে বিচরণ করে। বিশেষ প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য- যেমন নরম মাটি, ছড়া ও মিঠা পানির আধার এবং সমুদ্র উপকূলবর্তী আবহাওয়ার কারণে সেখানে বৈচিত্র্যপূর্ণ বৃক্ষরাজি জন্মেছে।
কক্সবাজারের প্রকৃতি বিশেষজ্ঞ সাংবাদিক আহমদ গিয়াস বলেন, শুকনাছড়ির পাহাড়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অনুকূলে বরাদ্দ ৭০০ একর বনভূমির বন্দোবস্ত বাতিল এবং দেশে পলিথিন নিষিদ্ধের পদক্ষেপ- পরিবেশ রক্ষায় অন্তর্বর্তী সরকারের দৃঢ় অঙ্গীকার প্রকাশ পেয়েছে। কক্সবাজারের প্রকৃতিপ্রেমীরা সরকারের এ পদক্ষেপকে স্বাগত ও অভিনন্দন জানায়। তবে এর পরিণতি কলাতলীর ৫১ একর পাহাড়ের আবাসন প্রকল্পের মতো যেন না হয়।
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় সূত্রমতে, ১৯৯৯ সালে কক্সবাজারের ঝিলংজা মৌজার বনভূমিসহ কক্সবাজার সদর ও সৈকত তীরকে প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা (ইসিএ) ঘোষণা করা হয়। পরিবেশ সংরক্ষণ আইন-২০১০ অনুসারে ইসিএ এলাকায় কোনো ধরনের অবকাঠামো নির্মাণ, প্রতিবেশ-পরিবেশের ক্ষতি হয় এমন কোনো তৎপরতা চালানো নিষেধ। কিন্তু ২০২১ সালে ওই বনভূমিকে খাসজমি দেখিয়ে ভূমি মন্ত্রণালয় কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে প্রশিক্ষণ একাডেমি নির্মাণের জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল।
সায়ীদ আলমগীর/জেডএইচ/এএসএম