দ্রুত বর্ধমান ভোগ্যপণ্যের (ফাস্ট মুভিং কনজিউমার গুডস বা এফএমসিজি) বিশাল সম্ভাবনাময় বাজার বাংলাদেশ। খাদ্য, পানীয়, দুধসহ নিত্যব্যবহার্য এফএমসিজি তুলনামূলক সস্তা, কিন্তু দ্রুত বিক্রি হয়। এ খাতে আগে থেকেই অংশীদারত্ব থাকলেও আরও বড় বিনিয়োগ করছে প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ।
Advertisement
এফএমসিজির জন্য গাজীপুরের কালীগঞ্জ ইকোনমিক জোনে একটি শিল্পপার্ক গড়ে তুলেছে দেশের শীর্ষস্থানীয় প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্যের প্রতিষ্ঠান ‘প্রাণ’। নতুন এ শিল্পপার্কে এরই মধ্যে চালু হয়েছে সর্বাধুনিক প্রযুক্তির ফ্লাওয়ার মিল। প্রতিদিন ৫শ টন উৎপাদন সক্ষমতার এ কারখানায় হাতের কোনো স্পর্শ ছাড়াই সম্পূর্ণ অটোমেটিক মেশিনে আটা-ময়দা ও সুজি উৎপাদন শুরু করেছে প্রতিষ্ঠানটি।
পণ্যের গুণগতমান বজায় রাখার জন্য কয়েকটি ধাপে কারখানায় আটা-ময়দা-সুজি তৈরি করা হচ্ছে। আমদানি করা গম মাদার ভেসেল থেকে লাইটারের মাধ্যমে সরাসরি সাইলোতে নেওয়া হয়। কাঁচামাল রাখার জন্য কারখানায় প্রতিটি ১০ হাজার টন সক্ষমতার ছয়টি এবং এক হাজার টন সক্ষমতার তিনটি সাইলো রয়েছে।- প্রাণ-এর নির্বাহী পরিচালক নাসের আহমেদ
এ শিল্পপার্ক নিয়ে বড় পরিকল্পনা রয়েছে প্রাণ-আরএফএফ গ্রুপের। আগামীতে এ শিল্পপার্কে ভোজ্যতেল, লবণ, ডাল, স্টার্চ, পোল্ট্রি ফিড, মসলা, বেভারেজ, নুডলস, বিস্কুট, কনফেকশনারি ও ফ্লেক্সিবল প্যাকেজিংসহ বিভিন্ন পণ্য উৎপাদনের লক্ষ্য রেখে এগিয়ে যাচ্ছে প্রাণ। প্রাথমিকভাবে বিনিয়োগ ১৫শ কোটি টাকা। এখন পর্যন্ত প্রায় ৭১৫ কোটি টাকা বিনিয়োগ সম্পন্ন হয়েছে।
Advertisement
১৮০ বিঘা জমিতে শিল্পপার্ক গড়ে তুলেছে প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ। এর মধ্যে আটা-ময়দা-সুজির জন্য ২১ বিঘা জায়গায় প্রায় ১০ তলা সমান সর্বাধুনিক প্রযুক্তির অটোমেটেড ফ্লাওয়ার মিল রয়েছে। এ কারখানার সম্পূর্ণ যন্ত্রাংশ ও প্রযুক্তি ইউরোপ থেকে আনা। ডিজিটাল মেশিনে পুরো কারখানা নিয়ন্ত্রণ ও উৎপাদন প্রক্রিয়া পরিচালনা করা হচ্ছে। সম্পূর্ণ অটোমেটেড এ কারখানায় কাঁচামাল আনলোড থেকে শুরু করে পণ্য প্যাকেজিং ও ক্রেতার হাতে পণ্য পৌঁছানোর আগ পর্যন্ত সবকিছুই হচ্ছে স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে।
আটা-ময়দার মিলের জন্য শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে সারিবদ্ধভাবে ছয়টি বিশাল উঁচু স্টিল সাইলো করা হয়েছে। পাশে আছে আরও ছোট তিনটি। যেগুলোতে গম প্রবেশ করে মেশিনে প্যাকেটজাত আটা হয়ে বেরিয়ে সরাসরি যাচ্ছে পণ্যবাহী ট্রাকে।
এ শিল্পপার্কে ফিডমিল চালু রয়েছে, যা প্রোটিন সেক্টরে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। আমরা ভোগ্যপণ্যের বাজারে ভালো অবস্থান তৈরি করতে চাই। এজন্য সিড ক্র্যাশিং, ভোজ্যতেল, লবণসহ বেশ কয়েকটি পণ্য উৎপাদনের লক্ষ্যে কারখানায় কাজ চলমান।- প্রাণ গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইলিয়াছ মৃধা
এছাড়া ওই শিল্পের কাঁচামাল দিয়ে প্রাণের পোল্ট্রিফিড আলো ব্র্যান্ডের উৎপাদন কার্যক্রমও চলছে। অন্য আরও দু-তিনটি কারখানায় উৎপাদন কার্যক্রম পরীক্ষামূলকভাবে শুরু হয়েছে। কয়েকটি কারখানার যন্ত্রপাতি বসানো প্রায় শেষ দিকে। আবার কয়েকটি কারখানার নির্মাণ এখনো চলছে।
Advertisement
পাশাপাশি দ্রুত চালু করা হবে, এমন পণ্যগুলোর ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ শিল্প হিসেবে পানীয়-বেভারেজের বোতলসহ অন্য সব পণ্যের ফ্লেক্সিবল প্যাকেজিং কারখানা এখন চলমান। লবণ ও ডাল কারখানার কাজ প্রায় শেষ। পাশাপাশি পণ্য আনা-নেওয়ার জন্য শিল্পপার্কে নিজস্ব জেটি স্থাপনের কাজ চলছে। এটি পার্কের শেষ প্রান্তে শীতলক্ষ্যা নদীতে।
শিল্পপার্কের রাস্তা, প্রতিটি পণ্যের জন্য আলাদা অ্যাক্রিডিটেশন ল্যাব, ডরমিটরির কাজ প্রায় শেষ। আগামী বছর নাগাদ সবগুলো কারখানা চালুর পরিকল্পনা রয়েছে গ্রুপটির।
এ শিল্পপার্কে প্রায় ৯শ লোকের কর্মসংস্থানের সুযোগ হয়েছে। পুরোদমে চালু হলে তিন হাজার লোকের কাজের সুযোগ তৈরি হবে।
সেখানে কথা হয় প্রাণ গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইলিয়াছ মৃধার সঙ্গে। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘ভোগ্যপণ্যের বাজারের এখন এফএমসিজি অনেক সম্ভাবনাময়। দেশে প্রতিনিয়ত জনসংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে খাদ্যের চাহিদাও বাড়ছে। প্রাণ নিজেও নিজস্ব বিভিন্ন পণ্য উৎপাদন করার জন্য দেশের এককভাবে সর্বোচ্চ বড় ক্রেতা। ফলে উৎপাদনের ৫০ শতাংশ নিজেরা ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ পণ্য হিসেবে এবং বাকিটা ভোক্তার কাছে বিক্রি করা যাবে।’
আরও পড়ুন সর্বাধুনিক মেশিনে আটা-ময়দা-সুজি উৎপাদন শুরু করলো প্রাণ দ্রুত বর্ধমান ভোগ্যপণ্যের বাজারে মন্দা দেশে প্রসাধনীর বড় বাজার, কালোবাজারিতে কম রাজস্বতিনি বলেন, ‘করোনা এরপর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের সময় আমরা নিজেদের উৎপাদন কার্যক্রম চালু রাখার জন্য যখন আটা-ময়দাসহ নানা ধরনের কাঁচামাল কিনতে গিয়েছি, তখন বেশি দামে কিনতে হয়েছে। অনেক সময় সংকটও দেখেছি। যে কারণে এসব কারখানা আমাদের নিজস্ব পণ্যের ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ আরও শক্তিশালী করবে।’
দৈনিক ৫০০ টন আটা, ময়দা ও সুজিনতুন শিল্পপার্কে আধুনিক প্রযুক্তির ফ্লাওয়ার মিলে দৈনিক ৫শ টন আটা, ময়দা ও সুজি উৎপাদনের সক্ষমতা আছে। আটা-ময়দার সর্বোচ্চ গুণগতমান নিশ্চিতের জন্য রাশিয়া, ইউক্রেনের পাশাপাশি কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্র থেকে গম আমদানি করা হচ্ছে বলে জানান প্রাণ-এর নির্বাহী পরিচালক নাসের আহমেদ।
তিনি বলেন, ‘এসব অঞ্চলের গমে প্রোটিনের মাত্রা ভালো থাকে। তবে স্থানীয়ভাবেও লালমনিরহাট, দিনাজপুর, কুড়িগ্রাম, পঞ্চগড়সহ কয়েকটি জেলা থেকেও গম সংগ্রহ করা হবে। এছাড়া প্রাণ নিজেরাই জমি লিজ নিয়ে ভালো প্রোটিন পাওয়া যায় এমন গম উৎপাদন করবে। প্রাণ এরই মধ্যে গমসহ অন্য ফসল উৎপাদনের লক্ষ্যে উত্তরাঞ্চলে ৬শ একর জমি লিজ নিয়েছে।’
নাসের আহমেদ বলেন, ‘পণ্যের গুণগতমান বজায় রাখার জন্য কয়েকটি ধাপে কারখানায় আটা-ময়দা সুজি তৈরি করা হচ্ছে। আমদানি করা গম মাদার ভেসেল থেকে লাইটারের মাধ্যমে সরাসরি সাইলোতে নেওয়া হয়। কাঁচামাল রাখার জন্য কারখানায় প্রতিটি ১০ হাজার টন সক্ষমতার ছয়টি এবং এক হাজার টন সক্ষমতার তিনটি সাইলো রয়েছে। এছাড়া আরও ছয়টি সাইলো বসানো হবে।’
গমের পুষ্টি পরিমাপের জন্য কারখানায় রয়েছে অত্যাধুনিক ল্যাব, যার মাধ্যমে গমের গুণগতমান পর্যবেক্ষণ করা হয়। শুরুতে প্রাণ গ্রুপের উৎপাদিত ৫০ কেজির বস্তা নিজস্ব ডিলারের মাধ্যমে পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতার দোকানে পৌঁছে যাচ্ছে। প্রাণ ব্র্যান্ডের এক কেজি ও দুই কেজির প্যাকেটেরও পরীক্ষামূলক প্যাকেজিং চালু হয়েছে। দেশের বাজারে শিগগিরই সর্বত্র মিলবে প্রাণ ব্র্যান্ডের এই আটা-ময়দা ও সুজি।
প্রাণ গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইলিয়াছ মৃধা বলেন, ‘শুধু ফ্লাওয়ার মিলের মেশিনারি ও অন্য বিল্ডিং নির্মাণে এখন পর্যন্ত বিনিয়োগ হয়েছে প্রায় ১১০ কোটি টাকা। শিগগিরই উৎপাদন সক্ষমতা দ্বিগুণ করা হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘এ শিল্পপার্কে ফিডমিল চালু রয়েছে, যা প্রোটিন সেক্টরে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। আমরা ভোগ্যপণ্যের বাজারে ভালো অবস্থান তৈরি করতে চাই। এজন্য সিড ক্র্যাশিং, ভোজ্যতেল, লবণসহ বেশ কয়েকটি পণ্য উৎপাদনের লক্ষ্যে কারখানায় কাজ চলমান। আশা করছি আগামী দুই বছরের মধ্যে ভোক্তারা প্রাণ-এর বিভিন্ন ধরনের ভোগ্যপণ্য হাতে পাবেন।’
শুরু হচ্ছে লবণ ও ডাল উৎপাদনপ্রতিদিন ৫শ টন উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন লবণ কারখানার কাজ প্রায় শেষ। আটা-ময়দা-সুজির পরে প্রাণ ও বঙ্গ সল্ট ব্র্যান্ড নিয়ে বাজারে আসবে লবণ। সেজন্য স্পেনের মেশিনারিজ দিয়ে সবচেয়ে আধুনিক প্রযুক্তির কারখানা হচ্ছে।
প্রাণ-এর নির্বাহী পরিচালক নাসের আহমেদ বলেন, ‘দেশে লবণের বাজারে অনেক প্রতিযোগী থাকলেও সর্বাধুনিক প্রযুক্তি নিয়ে আমরা আসছি। এটি বাজারের সেরা ও সর্বোচ্চ মানের পরিশোধিত লবণ হবে।’
এছাড়া প্রাণ ও মেট্রো নামে দুটি ব্র্যান্ডের মসুর এবং মুগডাল উৎপাদন শুরু হয়েছে মার্চে, যা বড় পরিসরে আসছে। প্রতিদিন ৬০ মেট্রিক টন ডাল উৎপাদনের সক্ষমতা রয়েছে ওই শিল্পপার্কের কারখানায়। পাশাপাশি মরিচ-হলুদসহ নানা ধরনের মসলা ও মিক্স মসলার কারখানার কাজ চলছে। প্রতিদিন এখানে ৬০ টন মসলা উৎপাদন সম্ভব হবে, যা পুরোপুরি রপ্তানিনির্ভর বলে জানান ইলিয়াছ মৃধা।
বাংলাদেশে এফএমসিজির বাজারে বিদেশি ব্র্যান্ডের চেয়ে এগিয়ে দেশি ব্র্যান্ডগুলো। প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ ছাড়াও সিটি, মেঘনা, এসিআই, স্কয়ার, টিকে, আবুল খায়ের গ্রুপসহ নানা দেশি প্রতিষ্ঠানের পণ্যের ব্র্যান্ড সংখ্যা বেশি। বিদেশি কোম্পানিগুলোর মধ্যে এগিয়ে আছে ইউনিলিভার বাংলাদেশ।
এছাড়া ব্র্যান্ডভিত্তিক বেশকিছু দেশি-বিদেশি ব্র্যান্ড এফএমসিজির বাজারের বড় অংশীদার। যেমন ভোজ্যতেলে বড় ব্র্যান্ড রূপচাঁদা, নেসলের ম্যাগি নুডলস, চায়ে ইস্পাহানি, দুগ্ধপণ্যের মধ্যে ডিপ্লোমা, ডানো, মিল্ক ভিটা, পানীয় শ্রেণিতে কোকাকোলা-সেভেন আপসহ বেশকিছু ব্র্যান্ড।
এমন পরিস্থিতিতে দেশে এ খাতে বড় বিনিয়োগ প্রসঙ্গে ইলিয়াছ মৃধা জাগো নিউজকে বলেন, ‘বাজারে প্রতিযোগী যত বাড়বে, পণ্যের মান ও দাম ততটা প্রতিযোগী হবে। এতে ভোক্তারা সুবিধা পাবে।’
তিনি বলেন, ‘আর প্রাণ-আরএফএলের বড় শক্তি ব্র্যান্ডভ্যালু। দেশের ক্রেতাদের আমাদের পণ্যের ওপর আস্থা প্রচুর। এছাড়া আমাদের রয়েছে শক্তিশালী সরবরাহ ব্যবস্থা। ফলে অন্য প্রতিযোগীদের সঙ্গে ভালোভাবে ব্যবসা করতে পারবো বলে বিশ্বাস করি।’
এনএইচ/এএসএ/জিকেএস