রাজশাহীর কাটাখালীর আদর্শ ডিগ্রী কলেজের অধ্যক্ষকে তাড়িয়ে চেয়ার দখল করেছেন কলেজের সহকারী অধ্যাপক ও বিএনপির বহিষ্কৃত নেতা সিরাজুল হক। তিনি রাজশাহী জেলা বিএনপির সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন। গত এপ্রিলে দলীয় সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে কাটাখালী পৌরসভার উপ-নির্বাচনে মেয়র পদের প্রার্থী হওয়ায় দল থেকে বহিষ্কার করা হয় তাকে।
Advertisement
সিরাজুল হকের বিরুদ্ধে অভিযোগ, গত ৯ আগস্ট তিনি কলেজের অধ্যক্ষ জয়নাল আবেদীনকে তার কার্যালয়ে ঢুকতে দেননি। সন্ত্রাসী বাহিনী নিয়ে গিয়ে হামলা চালিয়েছেন অধ্যক্ষ জয়নাল আবেদীনের বাড়িতেও। ফলে ভয়ে জয়নাল কলেজে যেতে পারেননি। কলেজে ঢুকতে বাধা দেওয়া ও বাড়িতে হামলা চালানোর অভিযোগে জয়নাল আবেদীন থানায় আলাদা দুটি সাধারণ ডায়রিও (জিডি) করেছেন। তবে প্রাণভয়ে তিনি কলেজে যেতে পারেননি।
এ অবস্থায় কলেজ গভর্নিং বডির সভাপতি ও পবা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সোহরাব হোসেন কলেজের এক শিক্ষককে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব দেন। কিন্তু পরদিনই অধ্যক্ষের চেয়ার দখল করে নেন সিরাজুল হক। এখন কলেজটিতে অধ্যক্ষের পদ নিয়ে জটিলতা চলছে। এ নিয়ে গত ২৮ অক্টোবর ইউএনও সোহরাব হোসেন জেলা প্রশাসকের কাছে একটি প্রতিবেদন দিয়েছেন।
এর আগে অধ্যক্ষ জয়নাল আবেদীনকে কলেজে ঢুকতে না দেওয়া ও তার বাড়িতে হামলার ঘটনায় ২০ অক্টোবর তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত জেলা প্রশাসক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশের (আরএমপি) কমিশনারকে চিঠি দেন। কিন্তু এখনও কলেজে যেতে পারেননি জয়নাল আবেদীন। দায়িত্ব নিতে পারেননি ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ বদরুল আমিন সরকারও। অধ্যক্ষের চেয়ার দখল করে আছেন ভূগোলের শিক্ষক সিরাজুল হক।
Advertisement
কলেজের অধ্যক্ষ জয়নাল আবেদীন বলেন, আমি আওয়ামী লীগের সমর্থকও না। বরং আমার শ্বশুরবাড়ির লোকজন সবাই বিএনপি করে। আমার কলেজের সভাপতি ছিলেন এলাকার সাবেক এমপি আয়েন উদ্দিন। তাই তার কাছে আমাকে যেতে হয়েছে। এখন সিরাজুল হক বলে বেড়াচ্ছেন, আমি নাকি আওয়ামী লীগ করেছি। গত ৯ আগস্ট তিনি বহিরাগতদের নিয়ে এসে আমাকে কলেজে ঢুকতে দেননি। আমার বাড়িতেও হামলা চালিয়েছেন। কলেজে গেলে মেরে ফেলা হবে বলে ভয় দেখানো হয়েছে। তাই আমি কলেজে যেতে পারি না। এখন শুনছি সিরাজুল হক অধ্যক্ষের চেয়ার দখল করে নিয়েছেন।
গত ২৮ অক্টোবর কলেজের সভাপতি ও ইউএনও সোহরাব হোসেন জেলা প্রশাসকের কাছে যে প্রতিবেদন দিয়েছেন তাতে বলা হয়েছে- ‘অধ্যক্ষ জয়নাল আবেদীন অনুপস্থিত রয়েছেন। তাই কলেজের কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার স্বার্থে ২৩ অক্টোবর গণিতের জ্যেষ্ঠ প্রভাষক বদরুল আমিন সরকারকে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হওয়ার আগেই পরদিন ২৪ অক্টোবর ভূগোলের শিক্ষক সিরাজুল হক সকল শিক্ষককে ভয়ভীতি দেখিয়ে সম্মতিসূচক স্বাক্ষর নিয়ে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব নেন। এর আগে অধ্যক্ষ জয়নাল আবেদীনকে ঢুকতে না দিয়ে গত ১১ সেপ্টেম্বর তিনি চেয়ার দখল করে নিজেকে অধ্যক্ষ বলে ঘোষণা দেন।’
কলেজের শিক্ষকরা জানান, ১১ আগস্ট সিরাজুল হক নিজেকে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ ঘোষণা করলে পরে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে তারা ইউএনওর কাছে বলেছিলেন। কিন্তু বিষয়টির কোনো সুরাহা হয়নি। কথাবার্তার ফাঁকে ফাঁকে সিরাজুল হক উত্তেজিত হয়ে মারমুখী আচরণ করেন। এ সময় শিক্ষকরা জয়নাল আবেদীন ও সিরাজুল হককে বাদ দিয়ে অন্য কাউকে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ করার আবেদন করেন। তখন পাঁচজন জ্যেষ্ঠ শিক্ষকের যেকোনো একজনকে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ করার সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু ভীতসন্ত্রস্ত অন্য চারজন শিক্ষক দায়িত্ব নিতে চাননি। রাজি হয়েছিলেন বদরুল আমিন সরকার। কিন্তু পরদিনই সিরাজুল হক অধ্যক্ষের চেয়ার দখল করেন। কার্যালয়ে লাগিয়ে দেন আলাদা তালা। ফলে বদরুলও দায়িত্ব পাননি।
শিক্ষকরা আরও জানান, সিরাজুল হকের অধ্যক্ষ হওয়ার খায়েশ নতুন নয়। অধ্যক্ষের চেয়ারে বসতে অধ্যক্ষ জয়নাল আবেদীনকে দীর্ঘদিন ধরেই নানাভাবে হয়রানি করে আসছিলেন সিরাজুল। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সুযোগে চেয়ার দখল করেছেন তিনি। অথচ ওই শিক্ষকের বিরুদ্ধেও রয়েছে ছাত্রীর শ্লীলতাহানিসহ ডজন খানেক অভিযোগ। থানায় মামলা রয়েছে ছয়টি।
Advertisement
অধ্যক্ষের চেয়ার দখলের অভিযোগ প্রসঙ্গে সিরাজুল হক বলেন, এলাকার লোকজন ও শিক্ষক-শিক্ষার্থী আমাকে এই সম্মান দিয়েছেন। তাদের অনুমতিক্রমেই আমি দায়িত্ব নিয়েছি। অধ্যক্ষ পালিয়ে থাকলেতো কলেজ চলে না। তাই স্বেচ্ছায় এই দায়িত্ব পালন করছি।
তিনি দাবি করেন, তার বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দায়ের করা হয়েছিল। তিনি রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের শিকার।
সিরাজুল হকের বিরুদ্ধে কলেজের এক ছাত্রীর মা ২০১৯ সালের ৬ সেপ্টেম্বর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা করেছিলেন। ওই মামলায় তিনি গ্রেফতারও হয়েছিলেন। মামলার অভিযোগে ওই ছাত্রীর মা উল্লেখ করেন, ২০১৯ সালের ২২ আগস্ট সকালে তার মেয়ে কলেজে গেলে শিক্ষক সিরাজুল তাকে তার কক্ষে ডেকে নেন। এরপর কথাবার্তা বলার একপর্যায়ে কুপ্রস্তাব দেন। এ সময় তার মেয়ে দ্রুত বাড়ি চলে গিয়ে কান্নাকাটি করে সমস্ত বিষয় খুলে বলে। সিরাজুলের বিরুদ্ধে অন্তত ১০ জন ছাত্রীকে কুপ্রস্তাব দেয়ার অভিযোগ রয়েছে বলে শিক্ষকরা জানান।
এভাবে অধ্যক্ষকে ঢুকতে না দিয়ে সিরাজুল হকের চেয়ার দখলের বিষয়ে বিএনপির ত্রাণ ও পুনর্বাসন বিষয়ক সহ-সম্পাদক ও রাজশাহী মহানগরের সাধারণ সম্পাদক শফিকুল হক মিলন বলেন, বিএনপি কখনো অবৈধ ও অনৈতিক কাজকে সাপোর্ট করে না। কেন্দ্রীয়ভাবেও সতর্ক করা হয়েছে, দলের নাম ব্যবহার করে কোনো ধরনের অনৈতিক কাজ করার সুযোগ নেই। এরইমধ্যে কয়েকজনকে বহিষ্কার করা হয়েছে। তবে ব্যক্তি স্বাধীনতা সব সদস্যের আছে। তিনি কারও ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে মন্তব্য করবেন না।
সার্বিক বিষয় নিয়ে কলেজের সভাপতি ও পবার ইউএনও সোহরাব হোসেন বলেন, ‘অধ্যক্ষ অনুপস্থিত থাকার কারণে আমরা একজনকে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব দিতে চাই। তখন জ্যেষ্ঠ পাঁচজনের নাম আনা হলে তিনজনই দায়িত্ব নিতে অপরাগতা প্রকাশ করেন। আর সিরাজুল হক জ্যেষ্ঠ শিক্ষক হলেও তার বিরুদ্ধে ছাত্রী নিপীড়নসহ ছয়টি মামলা আছে। তাই আমরা তাকে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ না করে অন্যজনকে করি। কিন্তু পরদিনই সিরাজুল হক নিজেই অধ্যক্ষের চেয়ারে বসে গেছেন। এ পরিস্থিতিতে জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে।
এফএ/এএসএম