ক্যাম্পাস

রাবির ৫০ বছরের মাস্টারপ্ল্যান: পারিবারিক নাম ব্যবহারের হিড়িক

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) শিক্ষার মান নিশ্চিত করতে ও ক্যাম্পাসের অবকাঠামোগত উন্নয়নে নেওয়া হয়েছিল ৫০ বছরের মাস্টারপ্ল্যান। ২০২০ সালের ১ অক্টোবর বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেটের ৫০১তম সভায় এই মাস্টারপ্ল্যানের অনুমোদন দেওয়া হয় এবং ৫০ বছর মেয়াদী (২০২০-৭০) মাস্টারপ্ল্যানের মডেল উন্মোচন করেন রাবির সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. এম আবদুস সোবহান।

Advertisement

এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের অবকাঠামোগত উন্নয়ন, কৌশলগত ও স্থানিক পরিকল্পনাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ৫ বছর অতিবাহিত হলেও মডেল উন্মোচনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের এ মহাপরিকল্পনার কাজ। গত পাঁচ বছরে মাস্টারপ্ল্যানের অধীনে তেমন কোনো উন্নয়ন লক্ষ্য করা যায়নি।

এদিকে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের গ্রহণ করা এ মাস্টারপ্ল্যানকে নিয়ে চলছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মাঝে নানা আলোচনা-সমালোচনা।

বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যেষ্ঠ অধ্যাপকরা বলছেন, ৫০ বছরের এ মাস্টারপ্ল্যান বিশ্ববিদ্যালয়ের মুষ্টিমেয় স্টেকহোল্ডারদের পরামর্শ নিয়ে করা হয়েছে। এখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৯৬২ সালের মাস্টারপ্ল্যানকে উপেক্ষা করে ৫০ বছরের মহাপরিকল্পনার নামে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন জায়গায় অযৌক্তিকভাবে স্থাপনা তৈরি করেছে বিগত প্রশাসন। শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হল, শেখ হাসিনা হল, শেখ রাসেল স্কুল এন্ড কলেজ এবং শহীদ কামরুজ্জামান হলসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপনায় পারিবারিক নাম ব্যবহার করতেই মূলত এ মাস্টারপ্ল্যান করেন তারা। এ মাস্টারপ্ল্যানকে আবারও নতুনভাবে করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে আহ্বান জানান তারা।

Advertisement

বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে, এই মহাপরিকল্পনার অধীনে ক্যাম্পাসের প্রায় ৭৫০ একর জমিকে পাঁচটি অঞ্চলে ভাগ করা হয়েছে। এতে অবকাঠামোগত উন্নয়ন, কৌশলগত ও স্থানিক পরিকল্পনাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। পরিকল্পনার মধ্যে রয়েছে একাডেমিক ও প্রশাসনিক অবকাঠামোর উন্নয়ন, গ্রন্থাগার আধুনিকীকরণ ও আবাসিক ব্যবস্থার উন্নয়ন। গুণগত শিক্ষার পরিবেশ নিশ্চিত করতে এই মাস্টারপ্ল্যানে রয়েছে একাডেমিক ও প্রশাসনিক অবকাঠামোর উন্নয়ন, গ্রন্থাগার আধুনিকীকরণ, শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আবাসিক ব্যবস্থার উন্নয়ন, রাস্তা-ঘাট ও উন্মুক্ত স্থানের যথার্থ ব্যবহার নিশ্চিতকরণ, পরিবহন ব্যবস্থার আধুনিকায়ন, আধুনিক জিমনেসিয়াম স্থাপন, পানি ও বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থার উন্নয়ন, ড্রেনেজ, বর্জ্য ও পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থার উন্নয়ন, জলবায়ু পরিবর্তন ও প্রাকৃতিক দূর্যোগ মোকাবিলা ব্যবস্থার উন্নয়ন ও শিক্ষার্থীদের জন্য ১০তলা বিশিষ্ট দুটি আবাসিক হল।

বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হলের পশ্চিম দিকে ১০তলা বিশিষ্ট শিক্ষকদের জন্য একটি আবাসিক ভবন নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। প্রতি বছর পর্যায়ক্রমে অনুষদ ও বিভাগ সংখ্যা বৃদ্ধি করার পরিকল্পনাও নেওয়া হয়। এজন্য ২০ তলা বিশিষ্ট একটি একাডেমিক ভবন নিমার্ণের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের পশ্চিম দিকে নির্মাণ করা হবে ১০তলা বিশিষ্ট একটি প্রশাসনিক ভবন। বিজ্ঞান, প্রকৌশল ও কৃষি অনুষদের জন্য আলাদা একটি ডিন্স কমপ্লেক্স গবেষণার জন্য ল্যাব নির্মাণের বিষয়টি মাস্টারপ্ল্যানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

খোঁজ নিয়ে আরও জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের মিলনায়তন, স্টেডিয়াম ও সুইমিং পুলের কাঠামোগত উন্নয়নের পরিকল্পনা নেওয়া হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ সংরক্ষণ, সৌন্দর্য্য বৃদ্ধি ও জীববৈচিত্র সংরক্ষণের জন্য নতুন গাছ লাগানো, রাস্তা সংস্কার, ফুটওয়ে নির্মাণ, গাড়ি পার্কিং স্থান নির্মাণসহ বিভিন্ন পরিকল্পনা নেয়া হয়। এছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস স্ট্যান্ড প্রাঙ্গণকে আধুনিক করার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান নিটোল টাটার তত্ত্বাবধায়নে একটি আধুনিক মানের বাসস্ট্যান্ড ডিজাইন প্রস্তুত করা হয়ে। এই ডিজাইনে বাসস্ট্যান্ড প্রাঙ্গণ সম্পূর্ণ পাকা করার কথা বলা হয়। প্রতি ১০ বছর অন্তর অন্তর নতুন গাড়ি ও চালক সংখ্যা বৃদ্ধি এবং পুরো ক্যাম্পাস ড্রেনেজ সিস্টেমের আওতায় আনার পরিকল্পনাও নেওয়া হয়।

এদিকে মাস্টারপ্ল্যান হাতে নেওয়ার পাঁচ বছর অতিবাহিত হলেও পরিকল্পনা মোতাবেক বিশ্ববিদ্যালয়ের তেমন কোনো উন্নয়ন এখনও দৃশ্যমান হয়নি। শেখ হাসিনা হল, কামরুজ্জামান হল, শেখ রাসেল স্কুল ও বিজ্ঞান ভবনের কাজ ছাড়া চোখে পড়ার মতো তেমন কোনো উন্নয়ন কাজ শুরু করতে পারেনি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।

Advertisement

বিগত প্রশাসনের করা এ মাস্টারপ্ল্যানের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে রাবি শিক্ষক সমিতির সাবেক সভাপতি ও ফাইন্যান্স বিভাগের জ্যেষ্ঠ অধ্যাপক ড. আমজাদ হোসেন বলেন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৯৬২ সালের মাস্টারপ্ল্যানকে উপেক্ষা করে ৫০ বছরের নতুন মাস্টারপ্ল্যান করেছে বিগত প্রশাসন। নতুন মাস্টারপ্ল্যানে শেখ হাসিনা হল, বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হল, শহীদ কামরুজ্জামান হল ও শেখ রাসেল স্কুল অ্যান্ড কলেজসহ বিভিন্ন স্থাপনা তৈরি করা হয়েছে- যা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেকের পরামর্শ ছাড়াই করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপনায় পারিবারিক নাম ব্যবহার করতেই মূলত এ মাস্টারপ্ল্যান করে বিগত প্রশাসন।

এ বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে ব্যবসা শিক্ষা অনুষদের সাবেক ডিন ও মার্কেটিং বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. ফরিদুল ইসলাম বলেন, ১৯৬২ সালের মাস্টারপ্ল্যানকে উপেক্ষা করে বিশ্ববিদ্যালয়ের মুষ্টিমেয় কিছু স্টেকহোল্ডাদের পরামর্শক্রমে ৫০ বছরের মাস্টারপ্ল্যান করা হয়েছে। যেহেতু এখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বার্থ জড়িত ফলে বিগত প্রশাসনের অবশ্যই উচিত ছিল ছাত্র-শিক্ষক এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্বপূর্ণ সংশ্লিষ্ট সকলের পরামর্শক্রমে এ পরিকল্পনা গ্রহণ করা।

মাস্টারপ্ল্যান রিভিউ হওয়া প্রয়োজন জানিয়ে কলা অনুষদের সাবেক ডিন অধ্যাপক ড. মো. ফজলুল হক বলেন, ৫০ বছরের মাস্টারপ্ল্যান যেহেতু বিশ্ববিদ্যালয়ের বড় একটি সিদ্ধান্ত, সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে জড়িত সকল বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিদের পরামর্শের ভিত্তিতে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত। তবে এ মহাপরিকল্পনায় একটি মহলের স্বার্থ প্রতিফলিত হয়েছে। তাই আমরা ৫০ বছরের এ মহাপরিকল্পনাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের পরামর্শের ভিত্তিতে পুনরায় পরিকল্পনা গ্রহণ করা উচিত বলে আমি মনে করি।

তবে এ মাস্টারপ্ল্যান অনুযায়ী কাজ করার আগ্রহ প্রকাশ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. সালেহ হাসান নকীব বলেন, বিগত প্রশাসনের ৫০ বছরের মাস্টারপ্ল্যানে আমি নিজেও সম্পৃক্ত ছিলাম। অনেক চেষ্টা করে এ মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। বর্তমান মাস্টারপ্ল্যানটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক কল্যাণের জন্য গ্রহণ করা হয়েছে। আমরা এ মাস্টারপ্ল্যানকে সামনে রেখে কাজ করতে চাই।

এফএ/জেআইএম