কর্ণফুলী পানি সরবরাহ প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে নগরবাসীর ৭০ শতাংশ পানির চাহিদা পূরণের স্বপ্ন দেখাচ্ছিল চট্টগ্রাম ওয়াসা। ২০০৯ সালে প্রকল্পটির কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও দীর্ঘ ছয় বছরেও শেষ হয়নি কাজ। তবে কাজে না থাকলেও কথায় পটু আছে ওয়াসা কর্তৃপক্ষ। নগরবাসীকে নিরবচ্ছিন্ন পানি সরবরাহের স্বপ্ন দেখানো শুরু করে ২০১৫ সালের শুরু থেকে ব্যাপক প্রচারে নামে কর্তৃপক্ষ। প্রকল্পের পানি ২০১৫ সালের জুনের মধ্যে নগরীতে সরবরাহের কথা প্রচার করলেও কয়েক মাস পর তা বাড়িয়ে ডিসেম্বরের কথা বলা হয়। ডিসেম্বরের কাছাকাছি আসলে তা মার্চে এবং সর্বশেষ চলতি জুনে কাজ শেষ করার কথা ফলাও করে প্রচার করা হয়।তবে এ জুনেও কথা ঠিক রাখতে পারছে না ওয়াসা। প্রকল্পের পানি আসতে আরো দুই-এক মাস সময় বৃদ্ধি হতে পারে বলে ইতোমধ্যে প্রচারণা শুরু করেছে ওয়াসা কর্তৃপক্ষ। ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টের একটি যন্ত্রাংশের অভাবে এ সময় বৃদ্ধি করতে হচ্ছে। এতে বাস্তবে এ প্রকল্পের পানি নগরীতে কখন আসবে তা নিয়েও যথেষ্ট সন্দেহ সৃষ্টি হয়েছে।এ বিষয়ে ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ইঞ্জিনিয়ার একেএম ফজুলুল্লাহ বলেন, কর্ণফুলী পানি সরবরাহ প্রকল্পটি কাজ শেষ পর্যায়ে। শেষ সময়ে এসে এখন একটা প্যাচ লেগে গেছে। ‘ফিল্টার মিডিয়া’ পাওয়া যাচ্ছে না। দেশে একটি মাত্র কোম্পানি সেটা উৎপাদন করে। তারা সেটা সরবরাহ করতে পারছে না। ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টের জন্য এটা প্রয়োজন। এটা পাওয়া না গেলে কিছুটা সমস্যা হতে পারে।তিনি বলেন, যদি দেশীয় প্রতিষ্ঠান থেকে নিতে না পারে তাহলে ঠিকাদার বাইরে থেকে সেটা এনে দেবে। আশা করছি দেরি হবে না। জুনের মধ্যেই কাজ শেষ করার জন্য আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।কর্ণফুলী পানি সরবরাহ প্রকল্পের কাজ ২০০৬ সালে শুরু হয়ে ২০০৯ সালে শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু শুরুতেই প্রকল্পটিতে অশুভ ছায়া ভর করে। যার কারণে বারবার বাড়ানো হয় সময়, বাড়ে ব্যয়ও। এ অবস্থায় কাজের কিছুটা অগ্রগতি দেখে ২০১৫ সালের শুরু থেকেই প্রচারণায় নামে ওয়াসা। ডিসেম্বরেই নগরবাসীর পানির চাহিদা পূরণের স্বপ্ন দেখাতে শুরু করেন ওয়াসা এমডি।মার্চে সংবাদিকদের প্রকল্পের মূল পয়েন্টে নিয়ে যাওয়া হয়। জোর গলায় ঘোষণা করা হয় যে কোনো পরিস্থিতিতে ডিসেম্বরের আগেই নগরবাসী এ প্রকল্পের পানি পাবে। কিন্তু সময় যখন ঘনিয়ে আসে, তখন ওয়াসা কর্তৃপক্ষ বাহানা পাল্টায়। সমস্যার দোহাই দিয়ে মার্চে পানি পাওয়ার আশ্বাস দেয়া শুরু করে। এরপর আবার জুনে পানি পাওয়ার নিশ্চয়তা প্রদান করে।তবে বারবার সময় পেছানো হলেও এখনো সঠিক কোনো সময় নির্ধারণ করতে পারেনি ওয়াসা কর্তৃপক্ষ। কখন নগরীর হাহাকারের মধ্যে পানি আসবে তা নিয়ে এখনো সন্দিহান ওয়াসা কর্তৃপক্ষ। আপাতত এতটুকু নিশ্চিত চলতি জুনেও পানির সংকট কাটছে না নগরবাসীর। এ বিষয়ে কথা হলে চট্টগ্রাম ওয়াসার প্রধান প্রকৌশলী আবদুল করিম চৌধুরী বলেন, কর্ণফুলী পানি সরবরাহ প্রকল্পের কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। ফিল্টার মিডিয়ার সংকট আছে। সেটা ঠিকাদার সরবরাহ করবে। তারা দেশীয় প্রতিষ্ঠান থেকে করবে, নাকি বিদেশি প্রতিষ্ঠান থেকে করবে সেটা তাদের বিষয়। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে আমাদের বুঝিয়ে দিলেই হলো।এ অবস্থায় জুনে উৎপাদনে যাওয়া যাবে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান কাজ শেষ করে আমাদের বুঝিয়ে দেবে। তারা এখন পর্যন্ত সময় বৃদ্ধির জন্য আমাদের কাছে কোনো আবেদন করেনি। যদি সময় বৃদ্ধির জন্য আবেদন করে তখন বলতে পারতাম, দুই মাস বেশি লাগবে। আপাতত ধরে রাখছি জুনে কাজ শেষ হচ্ছে।ওয়াসা সূত্র মতে, চাহিদার সঙ্গে সরবরাহের বিরাট ফারাক হওয়াতে ২০০৬ সালে ওয়াসা কর্ণফুলী পানি সরবরাহ প্রকল্প হাতে নেয়। চট্টগ্রাম শহর থেকে ২৮ কিলোমিটার উত্তরে কর্ণফুলী নদীর পারে প্রকল্পটির অবস্থান ঠিক করা হয়। জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা-জাইকার আর্থিক সহযোগিতায় এ প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছিল ৯৬৩ কোটি টাকা। চায়না ন্যাশনাল টেকনিক্যাল ইম্পোর্ট অ্যান্ড এক্সপোর্ট কর্পোরেশন (সিএনটিআইইসি) ও বেইজিং সাউন্ড এনভায়রনমেন্টাল ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি (বিএসইইসি) কে কাজ দেয়া হয়।২০০৯ সালে প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু প্রকল্পের কাজ শুরু করতেই লেগে যায় ২০১০ সাল পর্যন্ত সময়। চার বছরেও ঠিকাদার কাজ শুরু করতে না পারায় ২০১০ সালে আবার এ প্রকল্প রিভাইজড বা সংশোধন করা হয়। এতে প্রকল্প ব্যয় বাড়িয়ে ধরা হয় ১ হাজার ৫১০ কোটি টাকা। সংশোধিত প্রকল্প মেয়াদ অনুযায়ী ২০১২ সালের জুনে কাজ শেষ করার কথা। কিন্তু দেখা গেছে, এ মেয়াদেও কাজ শুরু করতে পারেনি মূল ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সিএনটিআইইসি ও বিএসইইসি।ফলে তারা ২০১১ সালে এসে সাব কন্ট্রাক্টে ওই প্রকল্পের পরিকাঠামো উন্নয়নে বাংলাদেশি কোম্পানি প্রজেক্ট বিল্ডার্স লিমিটেডকে (পিবিএল) সাব-কন্ট্রাক্ট দেয়। শর্ত অনুযায়ী, ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে তাদের কাজ শেষ করার কথা ছিল। কিন্তু এই সময়ের মধ্যে পিবিএল মাত্র ২৫ শতাংশ কাজ সম্পন্ন করে। চুক্তির শর্ত অনুযায়ী কাজ শেষ করতে না পারায় সাব-কন্ট্রাক্টর পিবিএলকে বরখাস্ত করা হয় এবং চুক্তির নিয়মানুযায়ী ১৪ দিনের মধ্যে প্রকল্প এলাকা থেকে তাদের মালামাল সরিয়ে নিতে বলে মূল ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। এতে মামলা ঠুকে দেয় পিবিএল। ফলে বন্ধ হয়ে যায় কাজ। সব সংকট কাটিয়ে ২০১৪ সালে আবার কাজ শুরু করা হয়। এদিকে গত সেপ্টেম্বরে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় কর্ণফুলী পানি সরবরাহ প্রকল্পের আরডিপিপি (২য় সংশোধিত) অনুমোদন দেয়া হয়। একনেকে এ প্রকল্পের মোট ব্যয় ১৮৪৮ দশমিক ৫২ কোটি টাকা অনুমোদন দেয়া হয়। যার মধ্যে জাইকা ৯৪০.৩০ কোটি টাকা, বাংলাদেশ সরকার ৮৮৪.২২ কোটি টাকা এবং চট্টগ্রাম ওয়াসা ২৪.০০ কোটি টাকা ব্যয় করবে। ওই প্রকল্পের আওতায় রাংগুনিয়ার পোমরায় দৈনিক ১৪ কোটি লিটার ক্ষমতাসম্পন্ন একটি পানি শোধনাগার, ৬৯ কিলোমিটার ট্রান্সমিশন ও ডিস্ট্রিবিউশন পাইপ লাইন এবং তিনটি জলাধার নির্মাণ করার কথা রয়েছে।তিন পর্বে ভাগ করা প্রকল্প কাজের মধ্যে পানি শোধন প্ল্যান্টের কাজ করছে চীনা প্রতিষ্ঠান চায়না ন্যাশনাল টেকনিক্যাল ইমপোর্ট অ্যান্ড এক্সপোর্ট কর্পোরেশন। নগরীর নাসিরাবাদে জলাধার নির্মাণের কাজ করছে কোরিয়ান প্রতিষ্ঠান কোলন গ্লোবাল কর্পোরেশন। আর প্রায় ৬০ কিলোমিটার পাইপলাইন বসানোর কাজ করছে জাপানি দুই প্রতিষ্ঠান কুবুতা ও মারুবিনি কনসোর্টিয়াম। এর মধ্যে পানি রাখার ট্যাঙ্ক ও পাইপলাইন স্থাপনের কাজ শেষ। রাংগুনিয়ার পোমড়া এলাকায় ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টের কিছু কাজ শুধু বাকি আছে। এদিকে সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিন বলেন, ওয়াসার কর্ণফুলী পানি সরবরাহ প্রকল্পের পানি আসছে দুই বছর ধরে। পানির স্বপ্ন দেখতে দেখতেই দুই বছর চলে গেছে। এখন বলছে জুনে আসবে। আমি বলছি, ‘আর কোনো অজুহাত দেখানো যাবে না’। কাজ করতে গিয়ে নতুন রাস্তা নষ্ট হচ্ছে। জনগণ আমাকে দোষারোপ করছে। তারপরও আমি চাই সবাই পানি পাক।সূত্র মতে, বর্তমানে ওয়াসা মোহরা পানি শোধনাগার প্রকল্প ও ৯৫টি গভীর নলকূপ থেকে নগরবাসীর পানির চাহিদা পূরণের চেষ্টা করে আসছে ওয়াসা। ১৯৮৭ সালে মোহরা পানি শোধনাগার প্রকল্পটি চালুর ২৬ বছর পেরিয়ে গেলেও নতুন কোনো প্রকল্প চালু করতে পরেনি ওয়াসা।এ অবস্থায় চট্টগ্রাম নগরজুড়ে পানির তীব্র সংকট চলছে। নগরীতে বর্তমানে পানির চাহিদা রয়েছে ৫৫ কোটি লিটার। ওয়াসা সরবরাহ করছে প্রায় ২০ কোটি লিটার। প্রতিদিন ৩৫ লিটার পানির সংকট থাকে যাচ্ছে। ওয়াসা কর্তৃপক্ষ রেশনিং করে সংকট ঘুচানোর চেষ্টা করলেও পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হয়নি। নগরীর বিভিন্ন এলাকায় চাহিদা অনুযায়ী পানি জোটে না। দিনের বেলায় অনেক এলাকার পাইপে পানি থাকে না। তাই রাত জেগে পানি সংগ্রহ করতে হয়। সরবরাহ লাইনে মোটর লাগিয়ে পানি টেনে নেয়ার কারণে অপেক্ষাকৃত নিচের দিকে পানি থাকে না। এসএইচএস/পিআর
Advertisement