যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়ী হয়ে ৪৭তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নিতে যাচ্ছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। এ নিয়ে তৃতীয় বারের মতো নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন তিনি এবং দুবার জয় পেয়েছেন এই রিপাবলিকান প্রার্থী। চার বছর আগে জো বাইডেনের কাছে পরাজয় স্বীকার করে নিলেও এবার ট্রাম্পের অসাধারণ প্রত্যাবর্তন দেখেছে সারাবিশ্ব।
Advertisement
২০২০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জো বাইডেনের কাছে হেরে গেলেও শুরুতে তা মানতে নারাজ ছিলেন ট্রাম্প। ফলে তার সমর্থকরা ক্যাপিটল হিলে দাঙ্গায় জড়িয়ে পড়েন। নির্বাচনে হারার পরও প্রেসিডেন্ট হিসেবে থাকার জন্য সেবার তিনি যে পদক্ষেপ নিয়েছিলেন, সেসব কার্যক্রমের সমালোচনা এখনো মানুষের মুখে মুখে ফেরে।
২০২১ সালের ৬ জানুয়ারি ক্যাপিটল হিলের ওই সহিংস হামলার দায়ে তার বিরুদ্ধে মামলা চলমান রয়েছে। পাশাপাশি, ব্যবসায়িক নথি জাল করার দায়ে গত বছর অভিযুক্ত হওয়ায় তিনি প্রথম মার্কিন প্রেসিডেন্ট হয়ে ইতিহাস গড়েছেন যাকে আদালত অপরাধী হিসেবে রায় দিয়েছে। এবারের নির্বাচনেও ট্রাম্পের প্রচারণায় বেশ কিছু নাটকীয় ঘটনা ঘটেছে।
কাজেই ট্রাম্পকে নিয়ে তীব্র বিতর্ক তৈরি হওয়ার বিষয়টি খুব একটা অবাক হওয়ার মত বিষয় নয়। প্রচারণার পুরোটা সময় ট্রাম্প বিদ্বেষমূলক মন্তব্য করেছেন, তার রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের হেয় করে কৌতুক করেছেন ও প্রতিদ্বন্দ্বীদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেওয়ার হুমকি দিয়েছেন।
Advertisement
গত ১৩ জুলাই নির্বাচনী সমাবেশে ট্রাম্পের ওপর হামলা চালানো হয়। পেনসিলভানিয়া অঙ্গরাজ্যের বাটলারে এক নির্বাচনী জনসভায় বক্তৃতা দেওয়ার সময় হামলার শিকার হন তিনি। তার কানে গুলি লাগে। তবে সে যাত্রায় অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে যান এই রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট প্রার্থী।
সে সময় তার কানে গুলি লেগেছিল এবং হামলার পরপরই তিনি মাটিতে পড়ে যান, তার মুখমণ্ডলে রক্ত দেখা যায়। এই ঘটনার পর পরই সিক্রেট সার্ভিসের সদস্যরা হামলাকারীকে গুলি করলে তিনি নিহত হন।
গত সেপ্টেম্বরেও ট্রাম্পের ওপর হামলার চেষ্টা হয়। গত ১৫ সেপ্টেম্বর ওয়েস্ট পাম বিচে ঘনিষ্ঠ বন্ধু স্টিভ উইটকফের সঙ্গে ট্রাম্প ইন্টারন্যাশনাল গলফ ক্লাবে সময় কাটানোর সময় তার ওপর হামলার চেষ্টা করেন এক ব্যক্তি।
ওই ঘটনার পর ডোনাল্ড ট্রাম্প এক বিবৃতিতে বলেছিলেন, ভয় পাবেন না। আমি ভালো আছি এবং কেউ আঘাতপ্রাপ্ত হননি। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ। তবে দুনিয়ায় এমন মানুষ আছে যারা আমাদের থামাতে যেকোনো কিছু করতে পারে। আমি আপনাদের জন্য লড়াই থামাবো না। আমি কখনো আত্মসমর্পণ করবো না। আমাকে সমর্থনের জন্য আপনাদের সবসময় ভালোবাসবো। আমাদের একতার মাধ্যমেই আমরা আমেরিকাকে আবারও মহান করবো। জয়ী হওয়ার পর ট্রাম্প আগের কথা স্মরণ করে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, আমেরিকাকে বাঁচানোর জন্যই ঈশ্বর আমাকে নতুন জীবন দিয়েছেন।
Advertisement
এসব কারণে এবারের নির্বাচনী প্রচারণার পর্বকে ইতিহাসের অংশ বললে কম বলা হবে না। প্রথম দিকে বাইডেন এবং ট্রাম্পের মধ্যে নির্বাচনী লড়াই হওয়ার কথা থাকলেও তা হয়নি। নির্বাচনের কয়েক মাস আগেই সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দেন বাইডেন। পরবর্তীতে কমলা হ্যারিসকে ডেমোক্র্যাট প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয়। তার নাম ঘোষণার পর থেকেই পরিস্থিতি অনেকটাই বদলে যেতে শুরু করে। এমনকি হ্যারিস শেষের দিকে বেশ জনপ্রিয়ও হয়ে ওঠেন। ফলে তার জয়ের সম্ভাবনাও বেশ বাড়ছিল। নির্বাচনেও এই দুই প্রার্থীর মধ্যে বেশ হাড্ডাহাড্ডি লড়াই উপভোগ করেছেন ভোটাররা। তবে ভোটারদের অনেকেই ট্রাম্পকে ভোট দেওয়ার পেছনে অর্থনীতি এবং অভিবাসনের মতো ইস্যুগুলোর কথা উল্লেখ করেছেন।
যুক্তরাষ্ট্রে স্থানীয় সময় ৫ নভেম্বর ভোরে শুরু হয় ৪৭তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। এতে বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনায় ভোট দিতে দেখা যায় ভোটারদের। ভোটের প্রাথমিক ফলাফল সামনে আসতে শুরু করলে ট্রাম্পের বিজয়ী হওয়ার সম্ভাবনা ক্রমেই স্পষ্ট হতে থাকে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে তার দলের ইলেকটোরাল ভোটের পাল্লা।
গত নির্বাচনে দোদুল্যমান রাজ্যগুলোতে বিশেষ সুবিধা করতে পারেননি ট্রাম্প। ফলে নির্বাচনে দ্বিতীয় বারের মতো জয়ী হওয়ার আশা ভঙ্গ হয় তার। কিন্তু এবার সেসব রাজ্যে দারুণভাবে ‘কামব্যাক’ করেছেন সাবেক এই প্রেসিডেন্ট। জয় ছিনিয়ে এনেছেন বেশিরভাগ ব্যাটেলগ্রাউন্ডে।
বুধবার উইসকনসিনে জয়ের সঙ্গে সঙ্গেই প্রেসিডেন্ট পদে জয়ী হওয়ার পথ পরিষ্কার হয়ে যায়। প্রেসিডেন্ট হতে প্রয়োজন ছিল ২৭০ ইলেকটোরাল ভোট। তিনি মিশিগানেও কমলাকে হারিয়েছেন এমনকি পেনসিলভানিয়ায় গতবারের নির্বাচনে জো বাইডেন জিতলেও এবার সেখানে ট্রাম্প কমলাকে হারিয়ে জয় ছিনিয়ে এনেছেন। ২০১৬ সালেও ওই অঙ্গরাজ্যে ট্রাম্পই জয়ী হয়েছিলেন।
বেশিরভাগ অঙ্গরাজ্যই প্রতিটা নির্বাচনে ধারাবাহিকভাবে একই দলকে ভোট দিয়ে আসে। কিন্তু কিছু রাজ্য আছে সেখানে কখনও ডেমোক্র্যাট আবার কখনও রিপাবলিকানরা জয়ী হয়। আমেরিকার নির্বাচনে রিপাবলিকান দুর্গ বলে পরিচিত অঙ্গরাজ্যগুলোকে বলা হয় ‘রেড স্টেট’ বা ‘লাল রাজ্য’ আর ডেমোক্র্যাটদের প্রাধান্য পাওয়া স্টেটগুলোকে বলা হয় ‘ব্লু স্টেট’ বা ‘নীল রাজ্য’।
ফলে এসব রাজ্য নিয়ে প্রার্থীদের খুব বেশি চিন্তা করতে হয় না বা মনোযোগ দিতে হয় না। হাতে গোনা যে রাজ্যগুলোর ভোট প্রার্থীদের কারণে যে কোনো শিবিরে যেতে পারে সেগুলোকে ‘সুইং স্টেট’ বলে। মূলত প্রার্থীরা এসব রাজ্যের দিকেই বেশি মনোযোগী থাকেন। কারণ সেখানে ভোট কোন পার্টির পক্ষে যাবে, তা নির্দিষ্ট করে বোঝা যায় না।
এগুলোই হলো আমেরিকান নির্বাচনের ব্যাটলগ্রাউন্ড বা নির্বাচনী রণক্ষেত্র। এগুলোকেই অনেকে বলে থাকে ‘বেগুনি রাজ্য’। প্রার্থীদের কাছে এসব অঙ্গরাজ্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়। আর এই অঙ্গরাজ্যগুলোর ভোটই শেষ পর্যন্ত হয়ে দাঁড়ায় জয় পরাজয়ের মূল চাবিকাঠি। এই রাজ্যগুলোতেই হয় মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা।
এ বছরের নির্বাচনে সুইং স্টেট হিসাবে পরিচিত পাওয়া রাজ্যগুলোর মধ্যে ছিল অ্যারিজোনা, পেনসিলভানিয়া, জর্জিয়া, উইসকনসিন, মিশিগান, নর্থ ক্যারোলাইনা এবং নেভাদা। ২০১৬ সালেও এই অঙ্গরাজ্যগুলো ‘ব্যাটল-গ্রাউন্ড স্টেট’ হয়ে উঠেছিল।
প্রত্যেক নির্বাচনের সময় দেখা গেছে যেসব রাজ্যের ভোট বেশি, প্রার্থীরা সেসব রাজ্যে নির্বাচনী প্রচারণার পেছনে অনেক বেশি সময় ও অর্থ ব্যয় করে থাকেন।
অ্যারিজোনায় ২০২০ সালে জো বাইডেনের কাছে হেরে যান ডোনাল্ড ট্রাম্প। কিন্তু এবারের নির্বাচনে ওই অঙ্গরাজ্যে কমলা হ্যারিসের চেয়ে এগিয়ে আছেন এই রিপাবলিকান প্রার্থী। সেখানে এখন পর্যন্ত ৭০ দশমিক ৩ শতাংশ ভোট গণনা হয়েছে। এর মধ্যে ট্রাম্প পেয়েছেন ৫২ দশমিক ৩ শতাংশ ভোট এবং কমলা হ্যারিস পেয়েছেন ৪৬ দশমিক ৮ শতাংশ ভোট।
পেনসিলভানিয়ায় ২০২০ সালে জো বাইডেন জয়ী হলেও এবার ডেমোক্র্যাট প্রার্থী কমলা হ্যারিস সেখানে জয় ছিনিয়ে আনতে পারেননি। তাকে হারিয়েছে এবার সেখানে জয়ী হয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। সেখানে ট্রাম্প পেয়েছেন ৫০ দশমিক ৪ শতাংশ ভোট এবং কমলা হ্যারিস পেয়েছেন ৪৮ দশমিক ৫ শতাংশ ভোট। ২০১৬ সালের নির্বাচনে ট্রাম্প হিলারিকে হারিয়ে ওই রাজ্যে জয় পান।
জর্জিয়ায় গত বারের নির্বাচনে বাইডেনের কাছে হেরে গেলেও এবার কমলাকে হারিয়েছেন ট্রাম্প। সেখানে ট্রাম্প পেয়েছেন ৫০ দশমিক ৭ শতাংশ ভোট এবং কমলা হ্যারিস পেয়েছেন ৪৮ দশমিক ৫ শতাংশ ভোট। তবে ওই অঙ্গরাজ্যে ২০১৬ সালের নির্বাচনেও জয়ী হয়েছিলেন ট্রাম্প। সে সময় তিনি হিলারিকে পরাজিত করে জয় ছিনিয়ে আনেন।
এছাড়া এবারের নির্বাচনে উইসকনসিন, মিশিগান এবং নর্থ ক্যারোলাইনাতেও কমলাকে হারিয়ে জয় নিশ্চিত করেছেন ট্রাম্প। উইসকনসিন এবং মিশিগানে ২০১৬ সালে হিলারিকে হারিয়ে জয় নিশ্চিত করলেও গতবারের নির্বাচনে জো বাইডেনের কাছে হেরে যান ট্রাম্প। কিন্তু এই দুই রাজ্যে এবার বেশ দারুণ প্রত্যাবর্তন ঘটেছে তার। উইসকনসিনে ট্রাম্প ৪৯ দশমিক ৬ শতাংশ ভোট পেয়েছেন এবং কমলা হ্যারিস পেয়েছেন ৪৮ দশমিক ৮ ভোট। মিশিগানে ট্রাম্প ৪৯ দশমিক ৮ শতাংশ এবং কমলা হ্যারিস ৪৮ দশমিক ৩ শতাংশ ভোট পেয়েছেন।
এদিকে নর্থ ক্যারোলাইনাতে ৫১ দশমিক ভোট পেয়েছেন ট্রাম্প এবং কমলা পেয়েছেন ৪৭ দশমিক ৭ শতাংশ ভোট। অপরদিকে নেভাদায় গত নির্বাচনে বাইডেনের কাছে হেরে গেলেও এবার কমলাকে পরাজিত করেছেন ট্রাম্প। সেখানে এখন পর্যন্ত ৯১ দশমিক ১ শতাংশ ভোট গণনা শেষ হয়েছে। ট্রাম্প পেয়েছেন ৫১ দশমিক ৫ শতাংশ ভোট এবং কমলা হ্যারিস পেয়েছেন ৪৬ দশমিক ৭ শতাংশ ভোট।
মূলত এবার সুইং স্টেটগুলোতে দারুণভাবে সাফল্য ছিনিয়ে আনার কারণেই প্রেসিডেন্ট পদে জয় নিশ্চিত হয়েছে ট্রাম্পের। ২০১৬ সালে জয়ী হয়েছেন এমন অনেক অঙ্গরাজ্যেই ২০২০ সালে বাইডেনের কাছে হেরে যান তিনি। কিন্তু সেই পরাজয়কেই এবার অসাধারণ সাফল্যে বদলে ফেলেছেন ট্রাম্প। ফলে দ্বিতীয় বারের মতো হোয়াইট হাউজের দায়িত্ব নেওয়ার অপেক্ষায় আছেন এই রিপাবলিকান প্রার্থী।
টিটিএন