অর্থনীতি

আবাসন ব্যবসায় ধস, বেড়েছে পুরোনো ফ্ল্যাটের কদর

বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ) ও নির্মাণসামগ্রীর অস্বাভাবিক দাম ধস নামিয়েছে দেশের আবাসন ব্যবসায়। কমছে নতুন প্রকল্প, বিক্রিতেও খরা। গত তিন মাস বিক্রি প্রায় শূন্যের কোঠায়। কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ করে পথে বসার উপক্রম ব্যবসায়ীদের। দাম কিছুটা কম হওয়ায় কদর বেড়েছে পুরোনো ফ্ল্যাটের।

Advertisement

গত ১৫ বছর ফ্ল্যাট-অ্যাপার্টমেন্টের বিক্রি

রিহ্যাব সূত্র বলছে, ২০১০-২০১২ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর গড়ে বিক্রি ছিল ১৫ হাজারের কাছাকাছি ফ্ল্যাট-অ্যাপার্টমেন্ট। ২০১৩-২০১৬ পর্যন্ত প্রতি বছর গড়ে ১২ হাজারের বেশি ফ্ল্যাট বিক্রি হয়। ২০১৭-২০২০ পর্যন্ত প্রতি বছর গড়ে বিক্রি হয় ১৪ হাজার ফ্ল্যাট-অ্যাপার্টমেন্ট। ২০২০ সালের জুলাই-২০২২ সালের জুন পর্যন্ত প্রতি বছর বিক্রি হয় ১৫ হাজারের কাছাকাছি।

এরপর ড্যাপ বাস্তবায়ন আর নির্মাণ উপকরণের মূল্যবৃদ্ধিতে বিক্রি কমতে থাকে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে ১০ হাজারের কাছাকাছি বিক্রি হয়। সদ্য বিদায়ী ২০২৩-২৪ অর্থবছরে আরও কমে সেটি ১০ হাজারের নিচে নেমেছে। তবে চলতি বছরের শুরু থেকে ড্যাপ বাস্তবায়নের প্রভাবের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে রাজনৈতিক অস্থিরতা। প্রতি মাসে গড়ে সাড়ে ৮০০ ফ্ল্যাট বিক্রি হওয়ার কথা থাকলেও তা শূন্যে নেমেছে চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে (জুলাই-আগস্ট-সেপ্টেম্বর)। শুধু আগের ফ্ল্যাট হ্যান্ডওভার ছাড়া কোনো বিক্রি নেই। শূন্যের কোঠায় নেমেছে বুকিং।

নির্মাণের সিজন শুরু হয় অক্টোবর-নভেম্বর থেকে। এসময়ে নির্মাণ উপকরণের দাম কিছুটা বেড়ে যায়, তবে এবার রড-সিমেন্টে উল্টো। দাম কমেছে এগুলোর। তবে বিপরীতে বালু এবং পাথরের দাম বেড়েছে। তাছাড়া ইট, খোয়াসহ অন্যগুলোর দাম এখনো বেশি।- বিক্রেতা আমিনুল ইসলাম

Advertisement

আবাসন ব্যবসায়ী ও ভবন মালিকরা বলছেন, নতুন ড্যাপ বৈষম্যমূলক এবং অস্পষ্ট। এ কারণে নতুন প্রজেক্ট নেই, চলমান প্রজেক্টেও বিক্রি খুবই কম।

উদ্যোক্তা ও আবাসান ব্যবসায়ী কামরুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘ড্যাপের কারণে নতুন প্ল্যান পাস না হওয়ায় বুকিং নেই। আগের বুকিং দেওয়া রেডি ফ্ল্যাট হস্তান্তর ছাড়া বিক্রিও নেই। নির্মাণ উপকরণের দাম বেশি হওয়ায় এর প্রভাব পড়েছে ফ্ল্যাট-অ্যাপার্টমেন্টের ওপরে। এ কারণে চলমান কিংবা রেডি ফ্ল্যাট বিক্রিতে ভাটা পড়েছে।’

ড্যাপ ও ফার

ঢাকা শহরকে বাসযোগ্য করতে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) নতুন বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা বা ড্যাপ (২০২২-২০৩৫) তৈরি করেছে। গত বছরের আগস্টে যা কার্যকর হয়। ঢাকাসহ আশপাশের এক হাজার ৫২৮ বর্গকিলোমিটার এলাকা নিয়ে এ মহাপরিকল্পনা। যেখানে জনঘনত্ব ও অন্য নাগরিক সুযোগ-সুবিধা বিবেচনায় নিয়ে ভবনের উচ্চতা বেঁধে দেওয়া হয়েছে।

যখন সাধ্যের ভেতরে আবাসনের স্বপ্ন থাকে না তখন মানুষ তো কম দামেরটাই বেছে নেবেন। এখন যেহেতু নতুন প্রকল্প বন্ধ, চলমানের উচ্চমূল্য, তাই অনেকেই পুরাতন বেছে নিচ্ছেন। এজন্য মূলত ড্যাপই দায়ী।- ব্যবসায়ী লিয়াকত আলী ভুঁইয়া

Advertisement

আরও পড়ুন বাড়তি করের চাপে আবাসন খাত  ‘ফার’র মারপ্যাঁচে আবাসন খাত  ত্রিমুখী চাপে রড-সিমেন্ট খাত, লোকসানে বিক্রি 

তবে সমালোচনার কারণে ওই ব্যবস্থা থেকে সরে এসে ফ্লোর এরিয়া রেশিওর (ফার) ভিত্তিতে ভবনের আয়তন নির্ধারণের সুপারিশ করা হয়। এতে পরিকল্পিত এলাকার তুলনায় অন্য এলাকায় ভবনের আয়তন কমে যায়। উদ্যোক্তাদের সমালোচনায় কিছু জায়গায় সংশোধনের কথা জানায় রাজউক। যদিও পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি এখনো।

কামরুল ইসলাম একটি আবাসন কোম্পানির প্রধান নির্বাহী। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘এখন ড্যাপের কারণে প্ল্যান পাস বন্ধ। এটার একটা সমাধান না হলে আমাদের ব্যসা গুটিয়ে নিতে হবে। চলমান প্রজেক্টে কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ করে অলস সময় পার করতে হচ্ছে। নির্মাণ উপকরণের দাম বেশি হওয়ায় বিক্রিও এখন শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে। এখন লোকসান গুনতে হচ্ছে বিক্রির আশায়।’

বেড়েছে সব ধরনের ফ্ল্যাট ও অ্যাপার্টমেন্টের দাম

লোকেশন, চাহিদা আর কোম্পানিভেদে ফ্ল্যাট ও অ্যাপার্টমেন্টের দাম বেড়েছে প্রতি স্কয়ার ফিটে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত। আবাসন ব্যবসায়ীদের সংগঠন রিহ্যাব সূত্র জানায়, দু-তিন বছর আগে গুলশান এলাকায় প্রতি স্কয়ার ফিট ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা ছিল। সেটি বেড়ে এখন বিক্রি হচ্ছে ২৬ থেকে ৩৫ হাজার টাকা পর্যন্ত।

বনানী এলাকায় বর্তমানে ২০ হাজার থেকে ২৫ হাজার টাকার মধ্যে রয়েছে, যা বিগত আড়াই থেকে তিন বছর আগেও বিক্রি হয়েছে ১৬ থেকে ২০ হাজার টাকায়। ধানমন্ডি এলাকায় প্রতি স্কয়ার ফিটে দাম বেড়ে এখন বিক্রি হচ্ছে ১৭ থেকে ২৫ হাজার টাকার মধ্যে, যা আড়াই থেকে তিন বছর আগে বিক্রি হয়েছে ১২ থেকে ১৮ হাজার টাকার মধ্যে।

এছাড়া মিরপুর এলাকায় প্রতি স্কয়ার ফিট বিক্রি হচ্ছে ৬ থেকে ৯ হাজার টাকার মধ্যে। এর আগে যেটা বিক্রি হয়েছে ৪ থেকে ৫ হাজার বা ক্ষেত্রবিশেষে সাড়ে পাঁচ হাজারের মধ্যে। বনশ্রী-আফতাবনগর এলাকায় বিক্রি হচ্ছে ৮ থেকে ১০ হাজার টাকা প্রতি স্কয়ার ফিট। আড়াই থেকে তিন বছর আগেও যেটা বিক্রি হয়েছে সাড়ে পাঁচ থেকে সাত হাজার টাকার মধ্যে। উত্তরা (সেক্টর ১-৭) প্রতি স্কয়ার ফিট বিক্রি হচ্ছে সাড়ে ৮ থেকে ১৩ হাজার টাকায়। নতুন উত্তরা এলাকায় ৭ থেকে ৯ হাজার টাকার মধ্যে।

আবাসন ব্যবসায়ীরা বলছেন, গুলশান, বনানী ও ধানমন্ডি এলাকায় জমি সংকট। অন্যদিকে বড় গ্রাহক বা ক্রেতার পছন্দের জায়গা এই তিন এলাকায়। এতে এখানে ফ্ল্যাটের দাম অনেক বেশি, আগামীতে কমার সম্ভাবনা কম। অন্য এলাকায়ও দাম বাড়ছে ফ্ল্যাটের। নির্মাণ খরচ বেশি, উপকরণের উচ্চমূল্য আর ড্যাপের কারণে নতুন প্ল্যান পাস না হওয়ায় দাম আগামীতে আরও বাড়তে পারে।

সাবিহা তন্ময় একটি প্রতিষ্ঠানের নির্বাহী পদে কর্মরত। প্রায় ১০ বছরের বেশি সময় ধরে চাকরি করছেন তিনি। থাকছেন ভাড়া বাসায়। তিনি সম্প্রতি বেশ কয়েকটি আবাসন কোম্পানির সঙ্গে কথা বলেন ফ্ল্যাট কেনার জন্য। তবে তার সঞ্চয় আর দামের সঙ্গে সামঞ্জস্য না হওয়ায় ফ্ল্যাটের স্বপ্ন পূরণ হয়নি। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘আশা ছিল জমানো সঞ্চয়ে রাজধানীতে একটা ফ্ল্যাট কিনবো, অন্তত বাসা ভাড়া বেচে যাবে। কিন্তু বাড়তি দামের কারণে এখন সেই স্বপ্ন আর পূরণ হবে না। বাড়তি দামে ফ্ল্যাটের স্বপ্ন দেখলে বাচ্চাদের পড়াশোনা করানো কঠিন।’

ফ্ল্যাট বা অ্যাপার্টমেন্টের দাম বাড়ার কথা স্বীকার করছেন আবাসন ব্যবসায়ীরাও। তারা জানান, নির্মাণ উপকরণের দাম কমলে ঘুরে দাঁড়াবে ব্যবসা। নির্মাণ উপকরণের অতিরিক্ত দাম বাড়ার ফলে ছোট ফ্ল্যাটের খরচই এখন ৭৫ লাখ টাকার বেশি পড়ছে। বড় বা মাঝারি ফ্ল্যাটের খরচ আরও বেশি। যদিও নির্মাণের প্রধান উপকরণ রড ও সিমেন্টের দাম কিছুটা কমেছে।

এ বিষয়ে রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (রিহ্যাব) সিনিয়র সহ-সভাপতি লিয়াকত আলী ভুঁইয়া জাগো নিউজকে বলেন, ‘গত আগস্ট থেকে কার্যকর হওয়া ড্যাপে পরিকল্পিত ও অপরিকল্পিত এলাকার জন্য আলাদাভাবে ভবন নির্মাণের যে ফার নির্ধারণ করা হয়েছে, সেটি বৈষম্যমূলক। ড্যাপে বিদ্যমান বৈষম্য ও ক্ষেত্রবিশেষে অস্পষ্টতা দেখা দিয়েছে। বেশির ভাগ এলাকায় আগে ভবনের যে আয়তন পাওয়া যেত, সে তুলনায় এখন ৬০ শতাংশ পাওয়া যাবে। এতে জমির মালিক ও ফ্ল্যাটের ক্রেতা, ব্যবসায়ীসহ (বিক্রেতা) সবাই ক্ষতির মুখে পড়বেন।’

কিছুটা কমেছে রড-সিমেন্টের দাম

বাজারে এখন নির্মাণের প্রধান উপকরণ রড-সিমেন্টের দাম কিছুটা কমেছে। রডের ক্ষেত্রে প্রতি টনে পাঁচ থেকে সাত হাজার টাকা পর্যন্ত কমেছে। আর সিমেন্টে প্রতি ব্যাগে কমেছে ১০ থেকে ১৫ টাকা পর্যন্ত।

আল্লাহর দান ট্রেডার্সের স্বত্বাধিকারী আমিনুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘নির্মাণের সিজন শুরু হয় অক্টোবর-নভেম্বর থেকে। এসময়ে নির্মাণ উপকরণের দাম কিছুটা বেড়ে যায়, তবে এবার রড-সিমেন্টে উল্টো। দাম কমেছে এগুলোর। তবে বিপরীতে বালু এবং পাথরের দাম বেড়েছে। তাছাড়া ইট, খোয়াসহ অন্যগুলোর দাম এখনো বেশি।’

চাহিদা বেড়েছে পুরাতন ফ্ল্যাট-অ্যাপার্টমেন্টের

সার্বিক পরিস্থিতিতে চাহিদা বেড়েছে পুরাতন ফ্ল্যাটের। বিশেষ করে মিরপুরের মণিপুর, বাড্ডা, উত্তরখানসহ গ্যাস সংযোগ রয়েছে এবং বিদ্যুতের সমস্যা নেই এমন ফ্ল্যাটের কদর বেড়েছে। মূলত দাম তুলনামূলক কম হওয়ায় এটা বেছে নিচ্ছেন তারা। ব্যাংকার আহসান আহমেদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমার চাকরির অর্ধেক টাকাই চলে যায় বাসা ভাড়ায়। এখন পরিবারের সদস্য বাড়লেও আয় বাড়ছে না। আবার চাইলে নতুন ফ্ল্যাট নিতে পারছি না। এ কারণে ঋণ ও সঞ্চয় দিয়ে পুরাতন একটি ফ্ল্যাট কেনা হলো।’

রড-সিমেন্টের প্রভাব ফ্ল্যাটে না পড়ার বিষয়ে আবাসন খাতের উদ্যোক্তা লিয়াকত আলী ভুঁইয়া বলেন, ‘রড ও সিমেন্টের দাম কিছুটা কমলেও অন্যগুলোর দাম আকাশচুম্বী। তাছাড়া নতুন প্ল্যানও পাস হচ্ছে না। এতে দাম কমছে না।’

পুরাতন ফ্ল্যাট বেচাকেনার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘যখন সাধ্যের ভেতরে আবাসনের স্বপ্ন থাকে না তখন মানুষ তো কম দামেরটাই বেছে নেবেন। এখন যেহেতু নতুন প্রকল্প বন্ধ, চলমানের উচ্চমূল্য, তাই অনেকেই পুরাতন বেছে নিচ্ছেন। এজন্য মূলত ড্যাপই দায়ী।’

ইএআর/এএসএ/জিকেএস