প্রশাসনের সতর্ক নজরদারির পরও উত্তরের মোকামগুলোতে কমছে না চালের দাম। এখনো অস্থির রয়েছে বাজার। সব ধরনের চালের দামই কেজিতে তিন থেকে ছয় টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। চালের পাইকারি বাজার খ্যাত নওগাঁ ও বগুড়ার তালোড়া ও শেরপুরে খোঁজ নিয়ে মিলেছে এই তথ্য।
Advertisement
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, উত্তরের বৃহৎ চালের মোকাম নওগাঁ ও বগুড়ায় বিভিন্ন ব্যবসায়ীর গুদামে সংরক্ষিত রয়েছে হাজার হাজার মণ চাল। এগুলো গুদামজাত করে সরবরাহ কমিয়ে বাজারে কৃত্রিমভাবে দাম বাড়ানোর অভিযোগ রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মোকামগুলোতে দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় খুচরায় এর প্রভাব পড়েছে। খুচরা বিক্রেতারা বলছেন, মোকামে দাম বাড়ায় তাদের বেশি দামে বিক্রি করতে হচ্ছে। আর মিল মালিকরা বলছেন, হাটে ধানের সরবরাহ কমায় দাম বেড়েছে প্রতিমণে দুইশ টাকা। স্বাভাবিক কারণে অন্য খরচগুলো যোগ দিয়ে তাদের চাল রূপান্তরে খরচ পড়ছে বেশি। এ কারণে এই বাড়তি দাম।
সপ্তাহ খানেক আগেও বগুড়া শহরের নামাজগড় ও শেরপুরের বিভিন্ন খুচরা দোকানে ২৮ জাতের চাল প্রতি কেজি বিক্রি হয়েছে ৫৪ টাকা আর কাটারি ৬৪ টাকায়। সেই চাল বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে ৬০-৬২ টাকা এবং ৭০-৭২ টাকা দরে। একইসঙ্গে মোটা ও হাইব্রিড জাতের চালের দাম ঠেকেছে ৫৮-৬০ টাকায়।
Advertisement
নওগাঁর খুচরা বাজারে প্রতি কেজি কাটারিভোগ ৭০-৭১ টাকা, জিরাশাইল ৬৭-৬৮ টাকা, সুভলতা ৬০-৬২ টাকা, পারিজা ৫৮-৬০ টাকা, ব্রি আর- ২৮ ও ২৯ চাল ৬০-৬২ টাকা এবং স্বর্না-৫ জাতের চাল ৬০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়েছে। আর বস্তার হিসাবে এক সপ্তাহের ব্যবধানে (৫০ কেজি) চালে ২৫০ টাকা থেকে ৩০০ টাকা পর্যন্ত দাম বেড়েছে।
রোববার (৩ নভেম্বর) বগুড়ার শেরপুর উপজেলার বিভিন্ন হাট-বাজারে কথা হয় ধান-চাল ব্যবসায়ীদের সঙ্গে। তারা দাবি করেন, এসিআই, রূপচাঁদা, আকিজ, পুষ্টিসহ আরও বেশকিছু কোম্পানি চালের দামে ফায়দা লুটছে। এসব কোম্পানি ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে কম দামে চাল কিনে নিয়ে গুদামজাত করে। পরে তাদের সুবিধামতো সময়ে নিজ নিজ ব্র্যান্ডের প্যাকেটে মোড়কজাত করে বেশি দামে বিক্রি করছে।
অন্যদিকে নওগাঁর ব্যবসায়ীরাও বলেছেন, তাদের চাল দিয়ে দেশের একটি বড় অংশের চাহিদা মেটে। সেখানে নিজ এলাকাতেই প্রতিদিন চালের দাম বেড়ে যাওয়ার পেছনে সিন্ডিকেটই দায়ী।
বন্ধ হয়নি চালের মজুতদারিসরেজমিন নওগাঁর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে তথ্য নিয়ে দেখা গেছে, সেখানে অবৈধভাবে বিপুল পরিমাণ চাল মজুত করে রাখা হয়েছে। চালকল মালিক এবং চাল ব্যবসায়ীরা তাদের নিজস্ব গুদামে এবং বাইরের বিভিন্ন গুদামে হাজার হাজার মেট্রিক টন চাল অবৈধভাবে মজুত করে রেখেছেন। এই মজুদদারির মধ্যে রয়েছে সুলতানপুর-কালীতলা রোডের শফিকুল ইসলাম নাঠুর সুফিয়া অটো রাইস মিল ও লস্করপুর এলাকার দ্বিজেন্দ্র নাথ ঘোষের ঘোষ অটো রাইস মিল। এই দ্বিজেন্দ্র নাথই আবার পরিতোষ নামে এক ব্যবসায়ীর নওগাঁ শহর এবং তিলকপুর রোডে একাধিক গুদামে চাল গুদামজাত করে রেখেছেন।
Advertisement
এছাড়া আলুপট্টির চাল ব্যবসায়ী মনোরঞ্জন ওরফে মনা বাবুর বেশকিছু গুদামেও অবৈধভাবে চালের মজুত রয়েছে। মনোরঞ্জন হলেন সাবেক খাদ্যমন্ত্রীর ছোট ভাই। খাদ্য বিভাগে এখনো তার অদৃশ্য ইশারায় অনেক কাজ হয়।
এছাড়াও রয়েছে শহরের সুলতানপুর এলাকায় নিরব বরণ সাহা চন্দনের একতা রাইস মিল, চকোরির দুলাল বাবু ও আনন্দনগর এলাকায় নওগাঁ জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি সাবেক উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলামের এমআর রাইস মিল, নওগাঁর সান্তাহার সীমান্তে সাহাপুর এলাকায় স্বপনের নাইট অটোমেটিক মিল, একই এলাকায় সিরাজুল অটোরাইস মিল, বাইপাস কোমাইগাড়ি এলাকার মাহবুব অটোমেটিক রাইসমিল, বাইপাস বিজিবি ক্যাম্প এলাকার তছির উদ্দিনের তোছিরন অটোরাইস মিল, মাদার মোল্লা এলাকার তৌফিকুল ইসলাম বাবুর মফিজ অটোরাইস মিল ও আজিজুল হকের গুদাম।
এছাড়া মহাদেবপুরে আকিজ এবং সরস্বতীপুর এলাকায় এসিআইয়ের বেশ কয়েকটি বড় বড় গুদাম আছে। এসব গুদামেও হাজার হাজার মেট্রিক টন চাল মজুত রয়েছে।
অভিযুক্তদের বেশিরভাগই কথা বলতে না চাইলেও ঘোষ অটোমেটিক রাইস মিলের স্বত্ত্বাধিকারী দ্বিজেন্দ্র নাথ ঘোষ বলেন, মিলে পুরনো কোনো ধান-চাল মজুত নেই। মোকামে কেনাবেচা না থাকায় ব্যবসায় এখন মন্দা চলছে। অবৈধ মজুতের যে অভিযোগটি করা হচ্ছে সেটি সঠিক নয়।
উৎপাদন বেশি হলেও কৃত্রিম সংকটকৃষি বিভাগের তথ্যমতে নওগাঁ জেলায় আবাদি জমির পরিমাণ প্রায় ২ লাখ ৬৪ হাজার ২০০ হেক্টর। এরমধ্যে প্রায় ১ লাখ ৯৬ হাজার হেক্টর জমিতে হয় ধানের আবাদ। তিন মৌসুমে বোরো, আউশ ও আমন ধানের আবাদ হয়। এ তিন মৌসুমে জমির পরিমাণ প্রায় ৪ লাখ ৪৪ হাজার ১১০ হেক্টর। যা থেকে বছরে প্রায় ১৬ লাখ ৫৬ হাজার টন চাল উৎপাদন হয়। এর বিপরীতে জেলায় চাহিদা ৪ লাখ ৪৯ হাজার টন। বাকি ১০ লাখ ৭০ হাজার টন সরবরাহ করা হয় ঢাকা, চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন জেলায়।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক আবুল কালাম আজাদ বলেন, চালের সংকট করে দাম বাড়ানোকে আমরা কোনোভাবেই মেনে নেবো না। কারণ আমাদের চাল দিয়ে দেশের একটি বড় অংশের চাহিদা মেটে। সেখানে নিজ এলাকাতেই প্রতিদিন চালের দাম বাড়ানোর পেছনে সিন্ডিকেট জড়িত এটা বলার অপেক্ষা রাখে না।
অন্যদিকে বগুড়া কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মতলুবর রহমান বলেন, এবার ধানের ফলন খুব ভালো হয়েছে। এ কারণে চাল উৎপাদন হয়েছে বেশি। বাজারে চালের সংকট সৃষ্টির বিষয়টি উদ্দেশ্যমূলক।
এদিকে কৃত্রিম সংকটের পেছনে সিন্ডিকেট চক্রের কারসাজির অভিযোগ তুলে নওগাঁর খুচরা চাল ব্যবসায়ীরা বলেন, বিগত বছরগুলোতে চালের বাজারে স্বস্তি ফিরলেও এ বছর টানা ১ মাস যাবত খুচরা ও পাইকারি বাজার এবং মিলগেটে চলছে এক অস্থিতিশীল পরিস্থিতি।
শহরের পৌর চাল বাজার এলাকার মালশন রাইস সেন্টারের খুচরা চাল ব্যবসায়ী মাণিক প্রামাণিক বলেন, বড় বড় মিলাররা গোডাউনে হাজার হাজার টন পুরনো চাল ও ধান মজুত করে রেখেছে। তাদের সিন্ডিকেটের কারণেই চালের বাজারে অস্থিরতা কাটছে না। মিলগেট থেকে বেশি দামে চাল কেনার কারণেই বেশি দামে ভোক্তা পর্যায়ে বিক্রি করতে হয়।
যা বলছে চালকল মালিক সমিতিমালিক সমিতির তথ্য অনুযায়ী, শুধু নওগাঁ জেলায় ৫৭১টি সচল চালকল রয়েছে। এরমধ্যে ৫৩টি অটোমেটিক ও ৫১৮টি হাসকিং মিল। এসব মিলে প্রতিদিন কমপক্ষে ২ হাজার টন চাল উৎপাদন সম্ভব। প্রতিদিন জেলার ১১টি উপজেলায় স্থানীয় ভোক্তা পর্যায়ে চাহিদা রয়েছে ৮০০ টন চাল। এই চাহিদা মেটানোর পর উদ্বৃত্ত চাল ব্যবসায়ী ও মিল মালিকদের হাতে থাকে। পরবর্তীতে যা দেশের বিভিন্ন মোকামে সরবরাহ করার কথা। আর খাদ্য বিভাগের ফুডগ্রেইন লাইসেন্স অনুযায়ী দীর্ঘ সময় যাবত মিলে উৎপাদিত চাল সংরক্ষণ করাও অপরাধ। তারপরও হাজার হাজার টন চাল মিলের গোডাউনে সংরক্ষণ করে রাখা হচ্ছে।
নওগাঁ চালকল মালিক গ্রুপের সাধারণ সম্পাদক ফরহাদ হোসেন চকদার সাংবাদিকদের বলেন, পরিবহন শ্রমিক এবং বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধির প্রভাবে বেড়েছে উৎপাদন খরচ। এসবের প্রভাব পড়েছে ধান-চালের দামে। প্রতি বছর এ মৌসুমে ধান-চালের দাম কিছুটা বাড়ে।
শেরপুর উপজেলা ধান-চাল মালিক সমিতির সভাপতি আব্দুল হামিদ বলেন, ধানের যোগান কম, এ কারণে চালের দাম বেড়েছে। তবে এই সমস্যা থাকবে না বেশিদিন। আগাম জাতের আমন ধান-কাটা মাড়াই শুরু হয়েছে। পুরোপুরি কাটা-মাড়াই শুরু হতে আরও এক থেকে দুই সপ্তাহ সময় লাগবে। তখন বাজার ঠিক হয়ে যাবে।
নওগাঁ জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক ফরহাদ খন্দকার বলেন, এ বছর রেকর্ড পরিমাণ ফলন হয়েছে। এ অবস্থায় চালের দাম বেড়ে যাওয়া মোটেও স্বাভাবিক নয়। আমরা চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে কাজ করছি। নির্দেশনা অনুযায়ী চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে মাঠপর্যায়ে প্রশাসনের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করবে খাদ্য বিভাগ।
বগুড়া জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক রিয়াজুর রহমান বলেন, চালের মূল্য সহনীয় রাখতে খাদ্য বিভাগ থেকে নিয়মিত তদরকি চালানো হয়। বিশেষ করে বগুড়ার নন্দীগ্রাম ও শেরপুরে বাজার তদারকি করার জন্য তাদের বিশেষ একটি টিম কাজ করে। এরপরও কোনো গুদামে চাল মজুদের তথ্য দেওয়া হলে তারা অভিযান পরিচালনা করবেন। তিনি স্বীকার করেন যে, কিছু কোম্পানি নিয়ম না মেনে চাল মজুতের অপচেষ্টা করছে।
এফএ/জেআইএম