দেশজুড়ে

শেষরক্ষা হলো না শ্রমিক থেকে বদির পার্টনার হয়ে ওঠা মাফিয়া জাফরের

গ্রেফতার এড়াতে এলাকা ছেড়ে রাজধানীর বাসাবোতে গা-ঢাকা দিয়েও আত্মরক্ষা হলো না স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত শীর্ষ মাদক কারবারি, টেকনাফের আব্দুর রহমান বদি ওরফে ইয়াবা বদির ম্যানেজার খ্যাত পার্টনার এবং টেকনাফ উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান জাফর আহম্মদের।

Advertisement

শুক্রবার (১ নভেম্বর) রাতে ঢাকার বাসাবো এলাকা থেকে তাকে গ্রেফতার করেছে র‌্যাব-১৫, কক্সবাজারের সদস্যরা। রাতে র‌্যাব-১৫, কক্সবাজারের সিনিয়র সহকারী পরিচালক (ল’ এন্ড মিডিয়া) অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. কামরুজ্জামান এ তথ্য জানান।

গ্রেফতার জাফর আহম্মদ (৬৭) টেকনাফ সদরের মিঠাপানিরছড়া উত্তর লেঙ্গুর বিল এলাকার মৃত সুলতান আহম্মদের ছেলে। তবে তিনি বর্তমানে টেকনাফ পৌরসভার পুরাতন পল্লানপাড়া, ২নং ওয়ার্ড এলাকায় বাস করছেন।

র‌্যাব-১৫ এর সিনিয়র সহকারী পরিচালক (ল’ এন্ড মিডিয়া) মো. কামরুজ্জামান জানান, ভয়ংকর মাদক ইয়াবা সিন্ডিকেটের টেকনাফের ডন মাদক সম্রাট আব্দুর রহমান বদি ওরফে ইয়াবা বদির বিশ্বস্ত সহযোগী হিসেবে পরিচিত ছিলেন সাবেক আলোচিত উপজেলা চেয়ারম্যান জাফর আহম্মদ প্রকাশ মাফিয়া জাফর। সংসদ সদস্য থাকাকালে আব্দুর রহমান বদি নিজের নির্বাচনী এলাকা টেকনাফকে পরিণত করেছিলেন মাদক, চোরাচালান, চাঁদাবাজি, অপহরণ ও হত্যার স্বর্গরাজ্যে। আর সেই স্বর্গরাজ্য কার্যক্রমের বিশ্বস্ত সহচর ছিলেন গ্রেফতার জাফর। ২০২২ সালের ডিসেম্বরে এক হাজার ২৭৫ জন মাদক কারবারিকে তালিকাভুক্ত করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেই প্রতিবেদনে আব্দুর রহমান বদি ও তার ঘনিষ্ঠ সহচর জাফরকে ইয়াবা সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণের অন্যতম মূলহোতা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। ২০১৯ সালে আত্মসমর্পণকারী মাদক কারবারীরা পুনরায় জামিনে বের হয়ে জাফরের নেতৃত্বে আবার সংঘবদ্ধ হয়েছে ইয়াবা ব্যবসার ব্যাপক প্রসার ঘটায়।

Advertisement

তিনি আরও বলেন, টেকনাফে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে ছাত্রদের বিরুদ্ধে সকল হামলা ও কুকীর্তির নেতৃত্বে ছিলেন জাফর ওরফে মাফিয়া জাফর। গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পরপর টেকনাফের ঝর্নাচত্বর এলাকায় ছাত্র জনতার ওপর জাফরের নেতৃত্বে নির্বিচারে গুলি চালায় তার লালিত সন্ত্রাসীরা। হামলার সময় তাদের হাতে দুটি শর্টগান ও একটি পিস্তল দেখা গেছে বলে প্রত্যক্ষদর্শী এবং স্থানীয় সূত্র জানায়।

গত ১৮ আগস্ট ছাত্র-জনতার ওপর হামলার ঘটনায় দায়ের করা হত্যাচেষ্টা মামলার অন্যতম আসামি জাফর আহম্মদ ওরফে মাফিয়া জাফর। এই মামলার প্রধান আসামি ইয়াবা গডফাদার আব্দুর রহমান বদি ওরফে ইয়াবা বদি ইতিপূর্বে র‌্যাবের হাতে আটক হলেও তার বিশ্বস্ত সহযোগী জাফর এতদিন অধরাই ছিলেন। র‌্যাব তাকে গ্রেফতারে সচেষ্ট ছিল। অবশেষে ব্যাপক তথ্য সংগ্রহ ও গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধির মাধ্যমে ১ নভেম্বর রাতে ঢাকাস্থ পূর্ব বাসাবো এলাকার একটি বাসায় অভিযান চালিয়ে র‌্যাব-১৫ এবং র‌্যাব-৩ এর যৌথ আভিযানিক দল জাফরকে র‌্যাবের জালে আটক করতে সমর্থ হয়।

তিনি জানান, গত ৫ আগস্ট রাতে টেকনাফে বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে জাফর এবং তার তিন ছেলের নেতৃত্বে টেকনাফের আলো শপিং কমপ্লেক্স, হোটেল নাফ কুইন ও আব্দুল্লাহ ব্রাদার্স ফিলিং স্টেশনে হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাট চালানো হয়। এসব ঘটনায় পৃথকভাবে তিনটি মামলা রুজু করা হয় যার সবকটিতেই জাফর আহম্মদ ওরফে মাফিয়া জাফরকে আসামি করা হয়েছে।

জিজ্ঞাসাবাদে জাফর র‌্যাবকে জানান, আব্দুর রহমান বদির অপরাধ জগতের বিশ্বস্ত সহচর গ্রেফতার জাফর প্রথম জীবনে ছিলেন পান বাজারের শ্রমিক। সেখান থেকে হয়ে ওঠেন শ্রমিক নেতা নামধারী চাঁদাবাজ। এই চাঁদাবাজির অর্থে টেকনাফ সদরের উপজেলা পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। এরপর থেকে তার আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। এরপর কৌশলে একটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত হয়ে টেকনাফ সদর ইউপি চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। কালের পরিক্রমায় জাফর নানারূপে আবির্ভূত হয়ে আব্দুর রহমান বদির বিশ্বস্ত সহযোগী হয়ে মাদক সাম্রাজ্য সম্প্রসারণপূর্বক অঢেল সম্পত্তির মালিক হয়েছেন।

Advertisement

তার বরাত দিয়ে র‌্যাব কর্মকর্তা আরও জানান, ওয়ান ইলেভেনের সময় জাফর গ্রেফতার হলে কারাগারে আব্দুর রহমান বদির সঙ্গে তার সখ্যতা গড়ে ওঠে। এরপর রাজনৈতিক মতাদর্শ পরিবর্তন করে আব্দুর রহমান বদির সঙ্গে যুক্ত হয়ে অন্য একটি রাজনৈতিক দলে যোগ দেন এবং আব্দুর রহমান বদির সহায়তায় চতুর্থ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। এরপর জেলা পরিষদ সদস্য ও ষষ্ঠ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে আবারো উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। সরকার পতন হলে ১৯ আগস্ট দুই মাসের মাথায় স্বপদ হতে তাকে অপসারিত করা হয়। উক্ত নির্বাচনে আব্দুর রহমান বদি ও জাফরের বিরুদ্ধে ভোট ক্রয়, ভোট চুরিসহ ব্যালট পেপার ছিনতাইয়ের অভিযোগ রয়েছে বলে জানা যায়। দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার সুবাদে আব্দুর রহমান বদি তার ঘনিষ্ঠ সহযোগী জাফরকে নিয়ে সীমান্তবর্তী উপজেলা টেকনাফকে মাদকের অভয়ারণ্যে পরিণত করেছেন।

পার্শ্ববর্তী দেশের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্রস্থল হলো টেকনাফ স্থলবন্দর। আমদানি-রপ্তানি সেবা দানকারী সিএন্ডএফ এজেন্সিগুলো আব্দুর রহমান বদির কথার বাইরে যেতে পারতো না। বিশ্বস্ত সহচর জাফরকে ‘উস্তাদ’ বলে সম্বোধন করতেন বদি, যার জিম্মি ছিলেন বন্দরের প্রতিটি ব্যবসায়ী। আব্দুর রহমান বদি ও জাফরের নিয়ন্ত্রিত বিভিন্ন এজেন্সিগুলোর বিরুদ্ধে বিপুল পরিমাণ কর ফাঁকির অভিযোগ রয়েছে। বন্দর কেন্দ্রিক চাঁদাবাজি, প্রতি ট্রাকে চাঁদা ওঠানোসহ ব্যবসায়ীদের জিম্মি করে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে।

গ্রেফতার মাফিয়া জাফরের বিরুদ্ধে মাদক, অস্ত্র, দুদকের মামলাসহ প্রায় এক ডজন মামলা রয়েছে। এর কয়েকটিতে তিনি জামিনে থাকলেও অধিকাংশ মামলাই বিচারাধীন। ২০২১ সালের ২১ জানুয়ারি দুর্নীতি দমন কমিশনের দায়ের করা এক মামলায় বিপুল পরিমাণ আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের দায়ে আদালত তাকে কারাগারে পাঠায়। এছাড়াও নাশকতার মামলায় দায়ের হওয়া নাশকতা মামলাগুলোতে এতদিন তিনি পলাতক এবং গ্রেফতার এড়াতে বিভিন্ন জায়গায় ছদ্মবেশ ধারণ করে আত্মগোপনে ছিলেন। তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন বলে উল্লেখ করেন র‌্যাব কর্মকর্তা কামরুজ্জামান।

সায়ীদ আলমগীর/এফএ/এএসএম