অর্থনীতি

দেশে প্রসাধনীর বড় বাজার, কালোবাজারিতে কম রাজস্ব

বিশ্বজুড়ে প্রসাধনীর বাজার অনেক বড়। বাংলাদেশও খুব বেশি পিছিয়ে নেই। মানুষের সৌন্দর্য সচেতনতা ও ক্রমক্ষমতা বাড়ায় বড় হচ্ছে এ বাজার। দেশি-বিদেশি কোম্পানির পুরোনো পণ্যগুলোর সঙ্গে প্রতিনিয়ত যোগ হচ্ছে নতুন নতুন পণ্য। কালার কসমেটিকসেও এসেছে বড় দেশি বিনিয়োগ। তবে নকল ও কালোবাজারিদের দাপটে বড় অংকের রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার।

Advertisement

প্রসাধনীর সবশেষ বাজার নিয়ে বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের (বিটিটিসি) একটি গবেষণা বলছে, কসমেটিকস খাতের প্রায় ৩৪ হাজার কোটি টাকার বাজার রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে কালার কসমেটিকস ও সাধারণ ত্বকচর্চার সঙ্গে মেডিকেটেড ত্বকচর্চার পণ্য।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যমতে, দেশে ২০ থেকে ৩৯ বছর বয়সী নারীর সংখ্যা প্রায় দুই কোটি ৭৩ লাখ। এসব নারীর ৭০ শতাংশকে প্রসাধনী সামগ্রীর ক্রেতা বলে বিবেচনা করা হয়েছে বিটিটিসির ওই গবেষণায়। সেক্ষেত্রে এসব ক্রেতা প্রায় ১৩ হাজার কোটি টাকার কালার কসমেটিকস এবং ২১ হাজার কোটি টাকার ত্বকচর্চার পণ্য ব্যবহার করছেন।

প্রসাধনীর পুরো বাজার অনেক সম্ভাবনাময়। দেশে গুণগত মানের পণ্য উৎপাদন করতে পারলে আমদানিনির্ভরতা কমবে। তাতে ডলার সাশ্রয় হবে, কর্মসংস্থানও বাড়বে। সে চিন্তা থেকে বড় পরিসরে এ খাতে বিনিয়োগ করা হয়েছে।- রিমার্ক এইচবি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আশরাফুল আম্বিয়া

Advertisement

এ খাত সংশ্লিষ্টরা জানান, সৌন্দর্যপণ্যের এ দুই ধরনের বাজারই বড় হলেও কালার কসমেটিকসে দেশি বিনিয়োগের বেশ কিছুটা সীমাবদ্ধতা রয়েছে। কালার কসমেটিকসের আওতায় পড়ে মেকআপ ও মেকওভারের জন্য প্রয়োজনীয় সৌন্দর্যপণ্য। এ তালিকায় রয়েছে ফাউন্ডেশন, কনসিলার, ফেসপাউডার, লিপস্টিক, মাসকারা, আইলাইনার, ব্লাশ ইত্যাদি। এসব পণ্যের প্রায় পুরোটা আমদানিনির্ভর। এর মধ্যে আবার বড় অংশ নকল।

দেশি কোম্পানিগুলো ভালো করছে সাধারণ ত্বকচর্চা পণ্যে। এই তালিকাও নেহায়েত ছোট নয়— সাবান, শ্যাম্পু, কন্ডিশনার, তেল, লোশন, ক্রিম, সুগন্ধী, পেট্রোলিয়াম জেলি, ট্যালকম পাউডার সবই রয়েছে। যে বাজারের বড় দখল এখন দেশি কোম্পানিগুলোর হাতে।

ত্বকচর্চায় দেশের ছয় থেকে সাতটি স্থানীয় কোম্পানি এ খাতের ৮০ শতাংশ বাজার নিজেদের দখলে রেখেছে। এর মধ্যে আছে স্কয়ার টয়লেট্রিজ, কোহিনূর কেমিক্যালস, কেয়া কসমেটিকস, অ্যারোমেটিক কসমেটিকসহ বেশকিছু প্রতিষ্ঠান। এছাড়া সম্প্রতি এ বাজারে বড় বিনিয়োগ করেছে রিমার্ক এইচবি লিমিটেড। যারা এ ত্বকচর্চা পণ্যের সঙ্গে কালার কসমেটিকসেও বিনিয়োগ করছে।

রিমার্ক এইচবি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আশরাফুল আম্বিয়া জাগো নিউজকে বলেন, ‘প্রসাধনীর পুরো বাজার অনেক সম্ভাবনাময়। দেশে গুণগত মানের পণ্য উৎপাদন করতে পারলে আমদানিনির্ভরতা কমবে। তাতে ডলার সাশ্রয় হবে, কর্মসংস্থানও বাড়বে। সে চিন্তা থেকে বড় পরিসরে এ খাতে বিনিয়োগ করা হয়েছে।’

Advertisement

তিনি বলেন, ‘এছাড়া বিদেশি প্রসাধনী নকল ও শুল্কফাঁকি দিয়ে আনা হচ্ছে, যা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হলে এ খাত দ্রুত বড় হবে।’

আরও পড়ুন দেশে নকল প্রসাধনী বাড়ার শঙ্কা ব্যবসায়ীদের নকল প্রসাধনীর বিরুদ্ধে অভিযানের নির্দেশ মানবাধিকার কমিশনের নকলের ভিড়ে আসল প্রসাধনী চিনবেন যেভাবে

দেশে প্রসাধনীর ভবিষ্যৎ বাজারও অনেক বড়। লাইট ক্যাসেল পাটনার্স ও অ্যালাইড মার্কেট রিসার্চের মতো গবেষণা সংস্থাগুলোর ভাষ্যমতে, ২০২০ সালে দেশে প্রসাধন পণ্যের বাজার ছিল ১২৩ কোটি মার্কিন ডলারের, যা বেড়ে ২০২৭ সালের মধ্যে ২১২ কোটি ডলারে উন্নীত হবে। ২০২১ থেকে ২০২৭ সাল পর্যন্ত এই বাজার ৮ দশমিক ১ শতাংশ হারে বাড়বে বলে জানায় গবেষণা সংস্থা দুটি।

এদিকে দেশে প্রসাধনীর বাজারের তদারকি প্রতিষ্ঠান বিএসটিআই। সংস্থাটির মহাপরিচালক এস এম ফেরদৌস আলম জাগো নিউজকে বলেন, ‘দেশের বাজারে যে হারে নকল ও মেয়াদোত্তীর্ণ পণ্য পাওয়া যায় তার ভিড়ে দেশি প্রতিষ্ঠানগুলো এক ধরনের প্রতিযোগিতায় পড়ে। সেক্ষেত্রে নতুন নতুন দেশি প্রতিষ্ঠান অথেনটিক পণ্য ভোক্তাদের কাছে পৌঁছে দিতে যেভাবে কাজ করছে তা দেশের জন্য অনুসরণীয়। তাই পর্যাপ্ত সুযোগ ও নীতি সহায়তায় এই শিল্পখাত থেকে সরকার আরও বেশি রাজস্ব আহরণ করতে পারবে।’

দেশের বাজারে যে হারে নকল ও মেয়াদোত্তীর্ণ পণ্য পাওয়া যায় তার ভিড়ে দেশি প্রতিষ্ঠানগুলো এক ধরনের প্রতিযোগিতায় পড়ে। সেক্ষেত্রে নতুন নতুন দেশি প্রতিষ্ঠান অথেনটিক পণ্য ভোক্তাদের কাছে পৌঁছে দিতে যেভাবে কাজ করছে তা দেশের জন্য অনুসরণীয়।- বিএসটিআই মহাপরিচালক এস এম ফেরদৌস আলম

তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে কোনো কালার কসমেটিকস তৈরি হয় না। এই চিত্র বদলাতে এগিয়ে এসেছে রিমার্ক। মুন্সিগঞ্জের গজারিয়ায় তাদের কারখানা আমরা পরিদর্শন করেছি। নিওর ব্র্যান্ড নামে এখানে তৈরি হবে সাধারণ কালার কসমেটিকস। আবার হার ল্যান হবে এক্সক্লুসিভ কালার কসমেটিকস। এছাড়া সাবান-শ্যাম্পু থেকে শুরু করে মেকওভারের নানা পণ্য এখন থেকে বাংলাদেশেই তৈরি হবে। এটি দেশের এ খাতে একটি বড় সম্ভাবনা তৈরি করেছে।’

বড় বাজারেও কম রাজস্ব, নেপথ্যে চোরাকারবার

এনবিআর থেকে পাওয়া তথ্যানুসারে, ২০২১-২২ অর্থবছরে ৬২৭ কোটি টাকার কালার কসমেটিকস ও স্কিন কেয়ার পণ্য আমদানি করা হয়েছে। এসব পণ্য থেকে সম্পূরক শুল্ক ও মূসক বাবদ সরকার রাজস্ব পেয়েছে ২৮৮ কোটি টাকা। একইভাবে ২০২০-২১ অর্থবছরে আমদানির পরিমাণ ছিল ৫২৮ কোটি টাকা, যার শুল্ক ও মূসকের পরিমাণ ছিল ২৪২ কোটি টাকা।

প্রসাধনী আমদানিকারক সমিতির তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ প্রতি বছর প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার প্রসাধনী আমদানি করে। তাদের হিসাব বিবেচনা করলেও ২৪ হাজার কোটি টাকার প্রসাধনীর বাজার কালোবাজারিদের দখলে।

তবে এ খাতসংশ্লিষ্টরা জানান, লাগেজ ব্যবসায়ীরা তুলনামূলক কম শুষ্ক দিয়ে বিদেশি পণ্য আমদানি করেন। কসমেটিকস পণ্যের আমদানিকারকদের হয়ে ফ্রেইট এজেন্সিগুলো এতে জড়িত থাকে। কিছু পণ্যের শুল্ক বেশি থাকায় বাজারে অনেক সময় সেসব পণ্যের সরবরাহ কমে যায়। তখন অসাধু ব্যবসায়ীরা সেসব পণ্য নকল করে বাজারে ছাড়েন। ফলে সরকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

অ্যাসোসিয়েশন অব স্কিন কেয়ার অ্যান্ড বিউটি প্রোডাক্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স বাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক জামাল উদ্দিন জাগো নিউজকে বলেন, ‘বিদেশি পণ্যের নামে বাজারে চোরাই পণ্য আনা হচ্ছে, যা দেশি বাজারের জন্য যেমন হুমকি, পাশাপাশি রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার।’

সুবিধা দিলে বাজার আরও বড় হবে

নীতিগত সহায়তা ও স্থানীয় শিল্প সুরক্ষায় শুল্ক-কর সুবিধা পাওয়া গেলে চাহিদা পূরণে দেশীয় শিল্প গড়ে উঠতে পারে, যার মাধ্যমে প্রায় ৫০ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হতে পারে বলে মনে করছেন এ খাত সংশ্লিষ্টরা।

এ কারণে আমদানিনির্ভরতা কমিয়ে স্থানীয় উদ্যোক্তাদের উৎসাহিত করতে কাঁচামাল আমদানিতে শুল্ক অব্যাহতি সুবিধা দেওয়ার সুপারিশ করা হয়। পাশাপাশি এসব পণ্যের কাস্টমস ডিউটি কেজিতে নির্ধারণ ও ট্যারিফ ভ্যালু উঠিয়ে যথাযথ শুল্কায়ন করে আমদানি পণ্যের উৎস, ব্র্যান্ড ও বাজারমূল্য বিবেচনায় নির্ধারণ করার সুপারিশ করা হয় ট্যারিফ কমিশনের ওই গবেষণায়।

বিদেশি পণ্যের নামে বাজারে চোরাই পণ্য আনা হচ্ছে, যা দেশি বাজারের জন্য যেমন হুমকি, পাশাপাশি রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার।- জামাল উদ্দিন

জামাল উদ্দিন এ বিষয়ে জাগো নিউজকে বলেন, ‘কসমেটিকসের বাজারের পরিসর অনেক। কিন্তু সে অনুযায়ী দেশীয় শিল্প গড়ে ওঠেনি। আমাদের দেশের চাহিদার বড় অংশই পূরণ হয় শুল্ক ফাঁকি দেওয়া কসমেটিকস ও নকল পণ্য সরবরাহের মাধ্যমে। যে কারণে সরকার বিশাল অংকের রাজস্ব হারাচ্ছে। এখন সরকারের উচিত দেশি এ খাতকে এগিয়ে নেওয়া।’

তিনি বলেন, ‘বাজারের চাহিদা পূরণে অসৎ ব্যবসায়ীরা হয় মিথ্যা ঘোষণায় শুল্ক ফাঁকি দিয়ে পণ্য দেশে আনছে, না হয় স্থানীয়ভাবে নকল পণ্য তৈরি করে তা সরবরাহ করছে। ফলে প্রকৃত ব্যবসায়ীরা যেমন বিপাকে পড়ছে, তেমনি নকল পণ্যের ব্যবহারে স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি হচ্ছে।’

‘দেশীয় শিল্প স্থাপনে সরকারের পলিসি সাপোর্ট বড় একটি বিষয়। এখন কসমেটিকসের কাঁচামাল ও তৈরি পণ্যের দাম বেশি পড়ে যায়। কারণ কাঁচামালে শুল্ক-কর বেশি, বিপরীতে সরাসরি কসমেটিকস আমদানিতে শুল্ক-কর কম। যে কারণে দেশীয় উদ্যোক্তারা এগিয়ে আসছে না।’ বলেন তিনি।

ক্ষতি করছে ‘উল্টো নীতি’

আমদানির বিকল্প ও ব্যাপক কর্মসংস্থানের সুযোগ থাকার পরও দেশীয় কসমেটিকস শিল্পে উল্টো নীতি গ্রহণ করা হচ্ছে রহস্যজনকভাবে। কসমেটিকস শিল্পখাতে নীতি সহায়তার পরিবর্তে বাড়তি শুল্ক ও ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে। এতে নতুন উদ্যোগগুলো আরও বেশি অসম প্রতিযোগিতার মধ্যে পড়ছে বলে মনে করছেন উদ্যোক্তারা।

অন্যদিকে কসমেটিকস শিল্পখাতের গুরুত্ব অনুধাবন করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন এই শিল্পের নীতি প্রণয়নে চার দফার জোরালো সুপারিশ করে ওই গবেষণায়। কিন্তু রহস্যজনক কারণে সহায়তার নীতি গ্রহণ করা হচ্ছে না।

সংশ্লিষ্টরা বলেন, নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের কোনো মহলের ভূমিকা রহস্যজনক এবং দেশীয় শিল্পবিরোধী। যার কারণে স্থানীয় বিনিয়োগ প্রবল অসম প্রতিযোগিতা ও ঝুঁকির মুখোমুখি হয়েছে।

ওই সময় ট্যারিফ কমিশন তাদের সুপারিশে উল্লেখ করেছে, একজন স্থানীয় উৎপাদনকারীকে প্রতি পিসের একক মূল্যের ওপর ১০ শতাংশ হারে সম্পূরক শুল্ক দিতে হয়। ফলে স্থানীয় উৎপাদনকারীর ওপর সম্পূরক শুল্কের প্রভাব অনেক বেশি। কারণ আমদানি করা পণ্যের শুল্কায়ন মূল্যের চেয়ে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত পণ্যের সম্পূরক শুল্ক আরোপযোগ্য মূল্য বেশি। ভোক্তা বাজার সবার জন্য এক হওয়ায় প্রতিযোগিতামূলক বাজার ব্যবস্থায় স্থানীয় উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর বিনিয়োগ হুমকির সম্মুখীন।

বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও এনবিইআর চেয়ারম্যান প্রফেসর সৈয়দ আহসানুল আলম পারভেজ বলেন, ‘প্রায় ৩শ কোটি ডলারের কসমেটিকস বাজারের শিল্পে বিদ্যমান সম্পূরক শুল্ক ও ভ্যাট স্থানীয় উদ্যোক্তাদের জন্য বৈষম্যের কারণ হবে। কারণ এ শিল্পের বার্ষিক গড় প্রবৃদ্ধির হার সাড়ে ১২ শতাংশ। তাই দেশীয় শিল্পে বিনিয়োগ আকর্ষণে নীতি সহায়তা জরুরি।’

এনএইচ/এএসএ/এএসএম