বিলের মাঝে বয়ে যাওয়া ৪ কিলোমিটার আঁকা বাঁকা পথ। বাতাসে পানির ঢেউয়ের ছলাৎ ছলাৎ শব্দ। রঙ বেরংয়ের সারি সারি নৌকায় সুসজ্জিত দুই পাড়। সূর্যাস্তের সময় পশ্চিম আকাশের লাল আভা পানিতে পড়া মাত্রই সৃষ্টি হয় নয়নাভিরাম দৃশ্যের। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলে জ্বলে ওঠে শত শত ল্যাম্পপোস্ট। দূর থেকে দেখলে মনে হবে যেন জোঁনাকির আলো খেলা করছে।
Advertisement
বলছি উত্তরের সীমান্তবর্তী জেলা নওগাঁ সদর উপজেলার হাঁসাইগাড়ী বিলের কথা। গত ১০ বছর যাবত পর্যটকদের কাছে জনপ্রিয়তা পেয়েছে এই বিল। যা দেখতে সকাল থেকে রাত অবধি নওগাঁর ১১টি উপজেলা ছাড়াও প্রতি বছর পার্শ্ববর্তী বগুড়া, জয়পুরহাট, রাজশাহী, নাটোর ও সিরাজগঞ্জ থেকে হাজারো পর্যটক ভিড় জমান এ এলাকায়। দর্শনার্থীদের আনাগোনায় মুখরিত থাকতো হাঁসাইগাড়ী বিল। তবে সম্প্রতি ৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে নানা কারণে হাঁসাইগাড়ী বিলের সেই জনপ্রিয়তা কমতে শুরু করেছে।
সরেজমিন হাঁসাইগাড়ী বিলে গেলে পর্যটকদের উপস্থিতির পরিমাণ বিগত বছরের তুলনায় অর্ধেকেরও কম দেখা যায়। উপস্থিতি কমায় কোনো পর্যটক আসা মাত্রই তাকে নিয়ে টানাহেঁচড়ায় ব্যস্ত হতে দেখা যায় নৌকার মাঝিদের। এক্ষেত্রে অবশ্য কম খরচে নৌকায় উঠে বিলের একাংশ ঘুরে দেখার সুযোগ পাচ্ছেন পর্যটকরা। তবে দিনশেষে বেশিরভাগ মাঝিকেই মলিন মুখে ফিরতে হচ্ছে খালি হাতে। পর্যটক শূন্যতায় যেসব ব্যবসায়ীরা পসরা সাজিয়ে বিভিন্ন দোকানপাট বসিয়েছিলেন তাদের অনেকেই দোকানপাট গুটিয়ে অন্যত্রে চলে গেছেন। সোলার প্যানেলের ল্যাম্পপোস্টগুলোর বেশিরভাগই চুরি হয়ে গেছে। তাই চাইলেও সন্ধ্যার পর বেশিক্ষণ বিলে থাকতে পারছেন না কেউ। এমন পরিস্থিতিতে হাঁসাইগাড়ী বিলে প্রকৃতির মাঝে প্রশান্তি খুঁজতে এসে তিক্ত অভিজ্ঞতা নিয়ে ফিরতে হচ্ছে অনেক পর্যটককে। হুমকির মুখে পড়েছে বিল কেন্দ্রিক গড়ে উঠা কয়েকশ মাঝি ও ব্যবসায়ীদের জীবন-জীবিকা।
২৫ অক্টোবর হাঁসাইগাড়ী বিলে কথা হয় শহরের মৃধাপাড়া মহল্লা থেকে ঘুরতে আসা দর্শনার্থী শাহানা হাবিবা মিমের সঙ্গে। তিনি বলেন, বিয়ের পর কয়েক বছর ধরে রাজশাহীতে থাকছি। বর্তমানে নওগাঁয় খুবই কম আসা হয়। তবে নওগাঁয় এলে অন্তত একবার হলেও হাঁসাইগাড়ী বিল ঘুরে দেখি। ছোট বোনকে সঙ্গে নিয়ে শ্যালো মেশিনচালিত নৌকায় বিল ঘুরে দেখলাম। এবারের বিল ভ্রমণের অভিজ্ঞতা খুবই বাজে ছিল। বিগত সময়ে যতবার এসেছি হাজারো পর্যটক থাকা স্বত্বেও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি যথেষ্ট ভালো ছিল। তবে এবার পর্যটকের সংখ্যা কম থাকার সুযোগে বখাটেদের উৎপাতে বেড়ানো ঝুঁকিপূর্ণ মনে হয়েছে। এখানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নজরদারি বাড়ানো প্রয়োজন।
Advertisement
পারনওগাঁ মহল্লা থেকে আসা আরেক দর্শনার্থী শাহরিয়ার সজিব বলেন, দীর্ঘদিন পর উন্মুক্ত স্থানে নির্মল বাতাসে নৌকায় ঘুরতে পেরে প্রাণ জুড়িয়ে যাচ্ছে। তবে উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে এখানে নির্মিত মাছ ও পাখি চত্বর দেখতে আসাই মূল উদ্দেশ্যে ছিল। ভেবেছিলাম মাছ ও পাখির সঙ্গে সেলফি উঠিয়ে আর সবার মতো ফেসবুকে পোস্ট করবো। সেটা আর হয়ে উঠলো না। এসে দেখছি মাছ ও পাখি চুরি হয়ে গেছে। হাঁসাইগাড়ী বিল কেন্দ্রিক পর্যটন বিকাশে উপজেলা প্রশাসনের নেওয়া প্রথম এই উদ্যোগটিই বৃথা গেলো। তবে বিল পাড়ে রুফটপ রেস্টুরেন্ট দেখে ভালো লাগলো।
নৌকার মাঝি রুবেল হোসেন বলেন, বিলের মাঝ দিয়ে বয়ে যাওয়া এলজিইডির সড়ক হাঁসাইগাড়ী ও দুবলহাটি ইউনিয়নকে যুক্ত করেছে। প্রতি বছর ১ জুলাই থেকে ১৫ নভেম্বর পর্যন্ত পর্যটকদের আনাগোনায় মুখরিত থাকতো হাঁসাইগাড়ী বিল। এবার সেটি লক্ষ করা যাচ্ছে না। গত বছর এই সময়ে নৌকায় পর্যটকদের ঘুরিয়ে দৈনিক অন্তত ৭০০ টাকা আয় করেছি। এখন দিনে ২০০ টাকা আয় করাই কঠিন হয়ে পড়েছে। চলমান পরিস্থিতিতে অনেক মাঝি অর্ধাহারে অনাহারে দিন কাটাচ্ছে। তাই অনেকে নৌকা ফিরিয়ে নিয়ে পেশা বদলাচ্ছেন।
নওগাঁ সরকারি কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক মো. বাকি বিল্লাহ বলেন, গুটিয়ার বিলের নাম পরিবর্তন হয়ে ১০ বছর যাবত এই বিল হাঁসাইগাড়ী বিল হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। শত কর্মব্যস্ততা কাটিয়ে একটু প্রশান্তি পাওয়ার আশায় মানুষ সেখানে ছুটে যায়। উপজেলা প্রশাসন সেখানে ছোটখাটো উদ্যোগ নিলেও খুব বেশি টেকসই হচ্ছে না। যার ফলে ক্রমাগত বিলটি তার সৌন্দর্য হারাচ্ছে। এ সংকট কাটাতে হাঁসাইগাড়ী বিল কেন্দ্রিক পর্যটন বিকাশে স্থানীয় প্রশাসনকে বহুমুখী উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
নওগাঁ সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এস এম রবিন শীষ জাগো নিউজকে বলেন, হাঁসাইগাড়ী বিলকে কেন্দ্র করে ওই অঞ্চলের হাজারো মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। অনেকের জীবনমান উন্নয়নে ভূমিকা রেখে চলেছে এই বিল। তাই সেখানকার প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষের কথা ভেবে ওই বিলে স্পিডবোড নামতে দেওয়া হয়নি। সড়কের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করাসহ সেলফি পয়েন্ট নির্মাণ করা হয়েছে। বিল কেন্দ্রিক পর্যটন বিকাশে আগামীতে আরও উদ্যোগ নেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে বলেও জানান তিনি।
Advertisement
আরমান হোসেন রুমন/জেডএইচ/জেআইএম