জমি দখল, চাঁদাবাজি, লুটপাট, সালিশ বাণিজ্য ও অবৈধ বালু উত্তোলনে কোটি কোটি টাকার সাম্রাজ্য গড়েছেন পাবনার বেড়া উপজেলার সদ্য অপসারিত চেয়ারম্যান রেজাউল হক বাবু। ক্ষমতার দাপটে উপজেলার কাশীনাথপুর, আমিনপুর বাজার, নগরবাড়ী ও কাজীরহাট ঘাটে একক নিয়ন্ত্রণ নিয়ে চাঁদাবাজির সিন্ডিকেট গড়েন বাবু। সরকার পতনের পর এলাকা ছেড়ে পালানো উপজেলা চেয়ারম্যান বাবু ও তার ভাইয়ের শাস্তির দাবিতে ফুঁসে উঠেছে নির্যাতিত এলাকাবাসী।
Advertisement
স্থানীয় সূত্র বলছে, এক সময় অন্যের দোকানের কর্মচারী ছিলেন উপজেলা চেয়ারম্যান রেজাউল হক বাবু। সাধারণ এক টেম্পু চালক ছিলেন বাবুর ভাই মোকলেছুর রহমান (মুকু)। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর প্রথমে জাতসাখিনী ইউপি চেয়ারম্যান ও পরে বেড়া উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। এতেই খুলে যায় তার ভাগ্য।
ছোট ভাই মোখলেছুর রহমান মুকু ও স্থানীয় সন্ত্রাসী মাইট্যা রাজ্জাককে দিয়ে এলাকায় শুরু করেন চাঁদাবাজি ও অবৈধ বালু ব্যবসা। দখল করেন বাস মালিক সমিতি, নগরবাড়ী ঘাট বণিক সমিতি কয়েকটি ব্যক্তিগত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। সরকারি বিধি অমান্য করে প্রভাব খাটিয়ে নগরবাড়ী নৌ-বন্দর ঘাট, কাজীরহাট ফেরিঘাট ও স্পিডবোট ঘাটের ইজারাও দখল করেন বাবু।
ভুক্তভোগীদের দাবি, বাণিজ্যিক গুরুত্বপূর্ণ এসব পয়েন্টে বাবু ও মুকুকে চাঁদা না দিয়ে ব্যবসা করাই ছিল অসম্ভব।
Advertisement
নগরবাড়ি ঘাটের ব্যবসায়ী আরশেদ আলী জানান, রেজাউল হক বাবুর দাপট ও ভয়ে এই ঘাটে কেউ ভিড়তে পারেনি। ব্যবসা করতে গেলে অতিরিক্ত চাঁদা দিয়ে তাকে ও তার লোকজনদের খুশি রাখতে হয়েছে। তা না হলে এখানে ব্যবসা পরিচালনা অসম্ভব ছিল। তৎকালীন নৌমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের প্রভাব খাটিয়ে ঘাট দখলে নেওয়ার পরই গাড়ি ও মাল প্রতি অতিরিক্ত চাঁদা নেওয়া শুরু করেন বাবু।
ভুয়া কাগজপত্রে মামলা জটিলতা দেখিয়ে ঘাট ইজারা বন্ধ রাখেন। নতুন করে ঘাট আর ডাকতে দেননি। আইন অনুযায়ী কোনো জনপ্রতিনিধি ঘাট বা এ সংক্রান্ত ইজারা নিতে পারেন না, অথচ সেগুলোর তোয়াক্কা না করে তিনি নিজ নামে ঘাট ইজারা নিয়েছিলেন। তার অন্যায় ও অনিয়মের বিরুদ্ধে কেউ কথা বললে তাকে মারধর, ভয়ভীতি ও নির্যাতন করা হয়েছে। এভাবে সবার মুখ বন্ধ রেখে অন্যায়ভাবে এই ঘাট থেকে কোটি কোটি টাকা লুট করেছেন তিনি।
নির্বাচনকালীন সময়ে প্রার্থী রেজাউল হক বাবু বিআইডব্লিউটিএ-র নগরবাড়ী, কাজিরহাট, নরাদহ নদী বন্দর এলাকার ঠিকাদার, ইজারাদার ও সরবরাহকারী হিসেবে সরকারের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ ছিলেন। জেলা নির্বাচন অফিসে মনোনয়নপত্র যাচাই বাছাইয়ে নির্বাচন বিধিমালা, ২০১৩ এর বিধি ১৭ অনুসারে রেজাউল হক বাবুর মনোনয়নপত্র বাতিল করে নির্বাচন কমিশন। পরে অবশ্য মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে মনোনয়ন ফেরত আনেন।
কেবল চাঁদাবাজিই নয়, এলাকায় কোনো জমি পছন্দ হলেই তা মুকুকে দিয়ে দখল করে নিতেন বাবু। এলাকার নদী ও মুক্ত জলাভূমি দখল করে তৈরি করেছিলেন মাছের খামার। সামাজিক সমস্যায় সালিশ বাণিজ্য করে নিজেদের খেয়ালখুশি মতো রায় দিতেন তারা। এসব অন্যায়ের প্রতিবাদ করায় সৈয়দপুর গ্রামের অসংখ্য বাড়িতে হামলা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ করে গ্রামবাসীকে মামলা দিয়ে এলাকাছাড়া করে বাবুর সন্ত্রাসী বাহিনী। নির্মম নির্যাতন চালানো হয় নারী ও বৃদ্ধদের ওপর। অন্যের জমিতে জোরপূর্বক তৈরি করেন বহুতল ভবনও।
Advertisement
এক সময় টিনের ঘরে বাস করলেও উপজেলা চেয়ারম্যান হয়ে নিজ গ্রামে কয়েক কোটি টাকা খরচ করে আলিশান বাড়ি করেছেন বাবু। কিনেছেন ঢাকার বসুন্ধরায় ফ্লাট, পাবনা শহরে জজকোর্ট এলাকায় কয়েক কোটি টাকার জমি।
সরকার পতনের পরও বাবু, মুকু ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকায় হতাশ এলাকাবাসী। বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করে তাদের দ্রুত গ্রেফতার ও শাস্তির দাবি ভুক্তভোগীদের।
এ ব্যাপারে সৈয়দপুর গ্রামের বৃদ্ধা হক সাহেব বলেন, শ্বশুরবাড়ির অবহেলায় আমার মেয়ে মারা যায়। কিন্তু বিয়ের সময় দেওয়া টাকা পয়সা ও গহনা ফেরত দেওয়াসহ তাদের অবহেলায় মেয়ে মারা যাওয়ার বিষয়টি নিয়ে সালিশ করে বাবু ও মকু। সালিসে মেয়ের শ্বশুরবাড়ির লোকদের জরিমানা করা হয় এবং গহনা ফেরত দেওয়ার রায় হয়। তারা সেগুলো দিলেও বাবু ও মকু সেগুলো মেরে খেয়েছে, বার বার চেয়েও আমি সেগুলো পাইনি।
আরেক বৃদ্ধা আব্দুল আজিজ বলেন, বাবু, মকু, ফিরোজ ও কবিররা আত্রাই নদী দখল করে খেয়েছে। কাউকে নদীর পাড়েও নামতে দেয়নি। কোনো বাচ্চাও যদি পাড়ে নেমেছে তাদের ধরে ব্যাপক মারধর করা হয়েছে। তাদের বাড়ি গিয়েও বাবা মায়ের ওপর অত্যাচার করেছে। এর আগে কাশেম নামে একজন একটা মরা বোয়াল মাছ পেয়েছিল, তার জন্য তাকে তুলে নিয়ে বেঁধে মারধর করে ও ২০ হাজার টাকা জরিমানা করে। সবশেষ রান্না করা সেই বোয়ালও নিয়ে যায় এরা। এদের অত্যাচারে এলাকায় টেকা যায়নি।
নুরুল ইসলাম মাস্টার জানান, লোকজন দিয়ে বাবু চেয়ারম্যান আমার বাড়ি, জমি সব দখলে নিয়ে অন্যায়ভাবে বিক্রি করেছে। প্রতিবাদ করলে আমাকে ও আমার ছোটভাইকে মারধর করেছে। প্রাণের ভয়ে আমার ছোটভাই এলাকায় থাকতে পারেনি। পরে সে মারা যায়। এরকম হাজারো ঘটনা আছে, যেগুলো বাবু ও তার বাহিনী ঘটিয়েছে।
একই গ্রামের বাসিন্দা বেড়া উপজেলা যুবদলের আহ্বায়ক সবুজ বলেন, দীর্ঘ এক দশকেরও বেশি সময় এই বাবু ও তার গুন্ডা বাহিনীর অত্যাচারে আমরা বিএনপি বা ভিন্নমতের লোক এলাকায় থাকতে পারিনি। সাধারণ মানুষকেও তারা ছাড়েনি। যে তাদের অন্যায়কে সমর্থন করেনি, তাকেই হামলা মামলা দিয়ে হয়রানি করেছে। বাড়ি থাকতে দেয়নি। নিজেরা বোমা পুঁতে রেখে উল্টো আমাদের নেতাকর্মীদের নামে মামলা দিয়ে বাড়িছাড়া করেছে। পরে তথ্য প্রমাণ না থাকায় সেই মামলা খারিজ হয়।
সবুজ বলেন, কাজিরহাট, নগরবাড়িসহ সকল ঘাটের একক নিয়ন্ত্রণ নিয়ে চাঁদাবাজি ও লুটপাট চালিয়েছে বাবু। অবৈধভাবে মাটি ও বালু উত্তোলন, লোক দিয়ে মাদক ব্যবসাসহ হেন কোনো অপকর্ম নেই বাবু করেনি। মানুষের জমি ও বাড়ি দখলের অসংখ্য নজির রয়েছে সৈয়দপপুর, আহম্মদপুর ও জাতসাখিনী গ্রামে।
বেড়ার ছাত্র আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী ছাত্রনেতা রাকিব জানান, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে কাশীনাথপুরে ছাত্রদের ওপর বাবুর নেতৃত্বে হামলা করে সন্ত্রাসীরা। আন্দোলন চলাকালে অসংখ্যবার আমার ওপর হামলা চালানো হয়েছে। প্রাকশ্যে মারধর করা হয়েছে। মিথ্যা মামলা দিয়ে আমাকে থানায় দেওয়া হয়েছে। বাবু, মাইট্যা রাজ্জাকসহ তার বাহিনীর সদস্যরা ঠিকমতো খেতে পেতো না। একদম নিম্নবিত্ত ছিল তারা। অথচ মাটি কেটে, বালু তুলে, অন্যের জমি দখল, মাদক ব্যবসা ও চাঁদাবাজি করে হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক বনে গেছে। মানুষের ওপর অন্যায় জুলুম করাই ছিল তাদের একমাত্র কাজ। আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি আমাদের আহ্বান দ্রুত এই বাবু বাহিনীকে গ্রেফতার করে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করুন। একইসঙ্গে তাদের সম্পদের উৎস অনুসন্ধান করে ব্যবস্থা নিন।
এফএ/জেআইএম