২১ রমজান, সোমবার। সিয়াম সাধনার মাধ্যমে গত হয়েছে বিশটি দিবস। সিয়াম পালনকারীর জন্য কত না খুশির বার্তা রয়েছে। তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে তাকে একটি গুরুত্বপূর্ণ দরজা দিয়ে বেহেশতে প্রবেশ করানো হবে। এই দরজার বিশেষ নাম রয়েছে। এ বিষয়ে হাদিসের দৃষ্টিকোণ তুলে ধরা হলো।সাহাল ইবন সাদ থেকে বর্ণিত, “জান্নাতে ৮টি দরজা, তাতে একটি দরজাকে ‘রাইয়ান’ বলা হয়, তা দিয়ে রোজাদার ব্যতীত কেউ প্রবেশ করবে না।’’ বুখারির বর্ণিত শব্দে হাদিসটি এসেছে এভাবে, “নিশ্চই জান্নাতে একটি দরজা আছে, যাকে বলা হয় রাইয়ান, কিয়ামতের দিন তা দিয়ে রোজাদার প্রবেশ করবে। তারা ব্যতীত কেউ সেখান থেকে প্রবেশ করবে না। বলা হবে, রোজাদারগণ কোথায়? ফলে তারা দাঁড়াবে, তাদের ব্যতীত কেউ তা দিয়ে প্রবেশ করবে না। যখন তারা প্রবেশ করবে, তখন বন্ধ করে দেওয়া হবে। অতঃপর কেউ তা দিয়ে প্রবেশ করবে না। তিরমিযির বর্ণিত শব্দ, ‘জান্নাতে একটি দরজা আছে, যাকে রাইয়ান বলা হয়, তার জন্য রোজাদারদের আহ্বান করা হবে, যে রোজাদাররা অন্তর্ভুক্ত হবেন, তারা তাতে প্রবেশ করবে। যে তাতে প্রবেশ করবে, সে কখনও পিপাসার্ত হবে না।’ আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘আল্লাহর রাস্তায় যে দুটি জিনিস খরচ করল, তাকে জান্নাতের দরজাসমূহ থেকে ডাকা হবে, হে আব্দুল্লাহ, এটা কল্যাণ। যে সালাত আদায়কারী তাকে সালাতের দরজা থেকে ডাকা হবে। যে মুজাহিদ তাকে জিহাদের দরজা থেকে ডাকা হবে। যে রোজাদার তাকে রাইয়ান দরজা থেকে ডাকা হবে। যে দানশীল তাকে সদকার দরজা থেকে ডাকা হবে। আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন, ‘হে আল্লাহর রসূল, আমার মাতা-পিতা আপনার ওপর উৎসর্গ। যাকে এক দরজা থেকে ডাকা হবে না, তার বিষয়টি পরিষ্কার, কিন্তু কাউকে কি সকল দরজা থেকে ডাকা হবে? তিনি বললেন : হ্যাঁ, আমি আশা করছি তুমি তাদের অন্তর্ভুক্ত।’ বুখারি ও মুসলিমের অন্য শব্দে এসেছে, ‘জান্নাতের প্রহরী তাকে ডাকবে। প্রত্যেক দরজার প্রহরী বলবে, হে অমুক, এসো।’ ইমাম আহমাদের বর্ণনামতে, ‘প্রত্যেক আমলের লোকের জন্য জান্নাতে একটি করে দরজা আছে, তাদের সে আমল দ্বারা ডাকা হবে। রোজাদারদের একটি দরজা রয়েছে, তাদের সেখান থেকে ডাকা হবে, যাকে বলা হয় রাইয়ান।’ আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন, ‘হে আল্লাহর রসূল, কাউকে কি সব দরজা থেকে ডাকা হবে? তিনি বললেন : হ্যাঁ, আমি আশা করছি তুমি তাদের অন্তর্ভুক্ত হে আবু বকর।’ আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহুর উদ্দেশ্য, যাকে জান্নাতের একটি দরজা দিয়ে ডাকা হলো, তার জন্য এটাই যথেষ্ট। প্রত্যেক দরজা থেকে ডাকার প্রয়োজন নেই। কারণ মূল উদ্দেশ্য জান্নাতে প্রবেশ করা, যা এক দরজা দিয়ে সম্পন্ন হয়। তারপরও কাউকে কি সব দরজা থেকে ডাকা হবে? নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে হ্যাঁ বলে উত্তর দিলেন।আলোচ্য বিষয়ের হাদিসগুলো থেকে অর্জিত শিক্ষা ও মাসায়েল :
Advertisement
এক. রোজার ফজিলত হলো- তার জন্য জান্নাতের ৮টি দরজা থেকে একটি নির্দিষ্ট করা হয়েছে।
দুই. ‘বাবে রাইয়ান’ জান্নাতের একটি দরজার নাম। ‘রাইয়ান’ (আররাইয়ান) শব্দটি আররাইয়ু ধাতু থেকে নেওয়া, যা পিপাসার বিপরীত। রোজাদার যেহেতু নিজেকে পানি থেকে বিরত রাখে, যা মানুষের খুব প্রয়োজন, সেহেতু তার যথাযথ প্রতিদান হিসেবে আখিরাতে তাকে পান করানো হবে, যার পর কখনো সে তৃষ্ণার্ত হবে না।
তিন. হাদিসে উল্লিখিত ইবাদত : সালাত, জিহাদ, সিয়াম ও সদকা জান্নাতের এক একটি দরজা। প্রত্যেক দরজা তার আমলকারীর জন্য খাস থাকবে, এখানে উদ্দেশ্য যার যে আমল বেশি তার জন্য সে দরজা বরাদ্দ।
Advertisement
চার. জান্নাতের দরজায় ফেরেশতাদের থেকে প্রহরী নিযুক্ত রয়েছে, তারা প্রত্যেক আমলকারীকে তার আমল অনুসারে তার জন্য নির্দিষ্ট দরজা থেকে ডাকবে। এ থেকে প্রমাণ হয় যে, ফেরেশতারা নেককার আদম সন্তানদের মহব্বত করে ও তাদের কারণে খুশি হয়।
পাঁচ. আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহুর ফজিলত যে, তাকে প্রত্যেক দরজা থেকে ডাকা হবে, কারণ সে প্রত্যেক আমল করত। আবু বকরের ব্যাপারে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আশা অবশ্যই সত্যে পরিণত হবে। ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুর হাদিসে এসেছে, আবু বকরকে প্রত্যেক দরজা থেকে ডাকা হবে, বরং জান্নাতের প্রত্যেক গলি ও ঘর থেকে ডাকা হবে।
ছয়. হাদিস থেকে বুঝে আসে, যাদের সব দরজা থেকে ডাকা হবে, তাদের সংখ্যা খুব কম।
সাত. হাদিস থেকে আরও বুঝে আসে যে, এখানে উদ্দেশ্য নফল আমল, ওয়াজিব নয়; কারণ ওয়াজিব আদায়কারীর সংখ্যা প্রচুর হবে। তবে তাদের সংখ্যা খুব কম হবে, যাদের আমলনামায় অধিকহারে সব প্রকার আমল থাকবে এবং যাদের জান্নাতের সব দরজা থেকে ডাকা হবে।আট. সামনে মানুষের প্রশংসা করা বৈধ, যদি তার ওপর গর্ব ইত্যাদির আশঙ্কা না থাকে। নয়. যে সব আমল করে ও নিয়মিত করে, তাকে জান্নাতের সব দরজা থেকে ডাকা হবে, এটা তার প্রতি সম্মান ও ইজ্জত প্রদর্শনস্বরূপ, তবে সে প্রবেশ করবে এক দরজা দিয়ে। দশ. সাধারণত সব ধরনের নেক আমলের তওফিক একজন মানুষের হয় না, যার এক আমলের তাওফিক হয়, তার থেকে অপর আমল ছুটে যায়, এটাই স্বাভাবিক। খুব কম লোকের তওফিক হয় সব আমল করা, আর সে কমের অন্তর্ভুক্ত আবু বকর। এগার. যার যে আমল বেশি, সে আমল দ্বারা সে প্রসিদ্ধি লাভ করে ও সে আমলের সাথে তাকে সম্পৃক্ত করা হয়। দেখুন নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণী, ‘যে সালাত আদায়কারীদের দলভুক্ত হবে।’ তার উদ্দেশ্য যার যে আমল বেশি, তাকে সে আমল দ্বারা ডাকা হবে। কারণ সব মুসলিম সালাত আদায় করে।প্রিয় পাঠক, আরেকটি বিষয়ে আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। সেটি হচ্ছে আত্মীয়তার বন্ধনের বিষয়ে সবাইকে সজাগ হওয়া প্রয়োজন। তাদের জন্য ব্যয় না করতে পারলে সে বন্ধনের কোনো অর্থ নেই। যারা সামর্থ্যবান তাদের অবশ্যই উচিত হবে প্রথমভাগে তাদের দিকে দৃষ্টি দেওয়া। তারপর অন্যদের হক আদায় করতে হবে। ইসলামের প্রতিটি এবাদতে সাম্যবাদের শিক্ষা প্রকটিত। কী নামাজ বলেন, কী রমাজানের রোজা বলেন; সবখানে আমির গরিবে কোনো ভেদাভেদ নেই। মনে রাখতে হবে, ‘ভোগের পেয়ালা’ যদি ‘উপচে পড়ে তব হাতে’, ‘তৃষ্ণাতুরের হিস্যা’ আছে অবশ্যই সেই পেয়ালায়।
Advertisement