প্রতিবছর দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার সুযোগ পাচ্ছেন ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীর সদস্যরা। এবছর খুমী সম্প্রদায় থেকে দেশের প্রথম নারী হিসেবে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়েছেন বান্দরবানের রোয়াংছড়ি উপজেলার মংয়ো পাড়া গ্রামের তংসই খুমী।
Advertisement
নয়লো খুমী ও লিংসাই খুমী দম্পতির চার সন্তানের মধ্যে তৃতীয় তংসই খুমী। ২০২৩-২৪ সেশনে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) নৃবিজ্ঞান বিভাগে অধ্যয়নের সুযোগ পেয়েছেন তিনি।
এর আগে তংসই খুমী প্রথমে বান্দরবান কালেক্টরেট স্কুল ও পরে ইন্টারমিডিয়েটে ভর্তি হন হলি ক্রস কলেজে। সম্প্রতি জাগো নিউজের সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জাগো নিউজের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি নাঈম আহমদ শুভ।
জাগো নিউজ: পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে খুমী জনগোষ্ঠীর প্রথম মেয়ে হিসেবে চান্স পেয়ে আপনার কেমন লাগছে?
Advertisement
তংসই খুমী: অবশ্যই খুশি লাগছে। অবশেষে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার ইচ্ছা পূরণ হলো। মায়ের মুখে আনন্দের তৃপ্তির হাসির রেখা দেখতে পেয়েছি।
জাগো নিউজ: পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার আগ্রহ কবে জন্মেছে?
তংসই খুমী: ছোটবেলা থেকেই দেখে আসছি আমাদের জনগোষ্ঠীর সংখ্যা কম হওয়ায় মেয়েরা অনেক পিছিয়ে রয়েছে। কেউ বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায় পর্যন্ত পড়তে পারেনি। আমার দাদারাও এসব নিয়ে আমাকে বলতেন সবসময়। মূলত আমার হাই স্কুল লেভেল থেকেই পড়ার ইচ্ছেটা জন্মেছে।
জাগো নিউজ: পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আপনাকে কারা বেশি অনুপ্রেরণা দিয়েছেন?
Advertisement
তংসই খুমী: বিশেষত আমার ভাইয়েরা সবসময় উৎসাহ দিতেন। তারপর আমার মা যিনি নিজে না পড়েও আমাকে সবসময় অনেক সাপোর্ট দিয়েছেন। বলতেন, আমি পড়তে পারি নাই তো কী হয়েছে, তোমরা দুই বোন তোমাদের যত পড়ার ইচ্ছে পড়ো। আমি পাশে আছি। এমন সাপোর্টিভ মা ও দুই ভাই পাওয়া আসলে আমার সৌভাগ্যের ব্যাপার।
জাগো নিউজ: পড়াশোনায় এ পর্যন্ত আসতে কী ধরনের প্রতিবন্ধকতা মোকাবিলা করেছেন?
তংসই খুমী: আমার গ্রামের বাড়ি দুর্গম এলাকায়। বান্দরবান জেলা শহর থেকে সাঙ্গু নদীর ওপর দিয়ে নৌপথে যেতে হয়। নদী পার হয়ে এক ঘণ্টারও বেশি সময় হেঁটে বাড়িতে পৌঁছাতে হয়। যাতায়াতের সমস্যা থাকা ও বাবার চাকরি সূত্রে আমরা বান্দরবান শহরে থাকতাম। তখন আমি বেসরকারি স্কুলে পড়তাম। আমি যখন চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ি তখন বাবা মারা যান। বাবা মারা যাওয়ায় পরিবারের সব দায়িত্ব মায়ের ওপর এসে পড়ে। ফলে আমার পরিবার অর্থনৈতিকভাবে চরম দুরবস্থার মধ্য দিয়ে যায়। আমাকে সরকারি স্কুলে ভর্তি হতে হয়।
আমাদের পড়াশোনার খরচ জোগাতে মা হাল ছেড়ে দেননি। অন্যদের কাছ থেকে ধারদেনা করে এবং অনেক কষ্টে আমাদের নিজেদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক বানিয়ে বিক্রি করার মাধ্যমে আমাদের চার ভাইবোনের পড়াশোনার খরচ চালিয়ে গেছেন। বাবার মৃত্যু ও মায়ের অসুস্থতা সবমিলিয়ে আমাদের অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল করে দেয়। অনেকে টানাপোড়েনের মধ্যে আমাকে পড়ালেখা করতে হয়েছে। আমার মায়ের অনুপ্রেরণা ও হাড়ভাঙা পরিশ্রমকে আমি বৃথা যেতে দেইনি। আমার জায়গা থেকে সর্বোচ্চ চেষ্টা করে নিজেকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য যোগ্য করে তোলার চেষ্টা করেছি।
জাগো নিউজ: বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পেতে আপনি কী কী করেছেন?
তংসই খুমী: এইচএসসি শেষে আমার ইচ্ছে ছিল বন্ধু-বান্ধবদের মতো একটা ভালো কোচিং সেন্টারে ভর্তি হবো। কিন্তু অভাবের টানাপোড়েনে ভর্তি হতে পারিনি। তখন অনেক চিন্তায় ছিলাম কী করবো না করবো এসব নিয়ে। পরে জুম একাডেমিতে বিনা খরচে পড়ার সুযোগ পাই। বাংলাদেশ খুমী স্টুডেন্টস কাউন্সিল (বিকেএসসি) বই কেনার জন্য আমাকে সহায়তা করেছে। পরে যখন ঢাবি, জাবি ও রাবিতে চান্স পাইনি তখন আবার ভেঙে পড়ি। পরে পরিবারের সাপোর্টে জিএসটিতে পরীক্ষা দিয়ে শাবিপ্রবিতে চান্স পেয়েছি।
জাগো নিউজ: ভবিষ্যতে নিজেকে কোন জায়গায় দেখতে চান?
তংসই খুমী: বিদেশে উচ্চশিক্ষার অর্জনের ইচ্ছে আছে। আমার পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী বিশেষ করে শিক্ষায় পিছিয়ে পড়া নারীদের জন্য কাজ করতে চাই। যতটুকু পারি সহযোগিতা করার চেষ্টা করবো।
জাগো নিউজ: খুমী জনগোষ্ঠীর জন্য আপনি কীভাবে অবদান রাখতে চান?
তংসই খুমী: যেহেতু আমাদের জনগোষ্ঠী শিক্ষার ক্ষেত্রে বিশেষ করে নারী শিক্ষায় পিছিয়ে রয়েছে, সেহেতু আমি নারী শিক্ষার উন্নয়ন ও নারীদের অবকাঠামো উন্নয়ন এবং তাদের কর্মসংস্থান নিয়ে কাজ করতে চাই।
এসআর/জেআইএম