অধস্তন আদালতে দায়িত্ব পালনরত ম্যাজিস্ট্রেটরা রাষ্ট্রপতির নিয়ন্ত্রণে থাকা সংক্রান্ত ১১৬ অনুচ্ছেদ কেন অসাংবিধানিক, অবৈধ ও বেআইনি ঘোষণা করা হবে না তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছেন হাইকোর্ট। একই সঙ্গে বিচারকদের যে শৃঙ্খলা বিধি আছে সেটি কেন অসাংবিধানিক ঘোষণা করা হবে না, তাও জানতে চাওয়া হয়েছে।
Advertisement
অপর এক রুলে আইন ও বিচার বিভাগের জন্য সুপ্রিম কোর্টের অধীনে কেন পৃথক সচিবালয় গঠনের নির্দেশ দেওয়া হবে না- রুলে তাও জানতে চাওয়া হয়েছে।
বিচারবিভাগের জন্য পৃথক সচিবালয় গঠনের বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেলকে অগ্রগতি প্রতিবেদন দাখিলের বিষয়ে বলা হয়েছে। আগামী ৬০ দিনের মধ্যে অগ্রগতি প্রতিবেদন দাখিল করতে হবে।
এ সংক্রান্ত রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে রোববার (২৭ অক্টোবর) হাইকোর্টের বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও বিচারপতি দেবাশীষ রায় চৌধুরীর সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ আদেশসহ রুল জারি করেন।
Advertisement
আদালতে আজ রিটের পক্ষে শুনানি করেন অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ শিশির মনির। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল সৈয়দা সাজিয়া শারমিন ও ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল তামিম খান।
এর আগে সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদে বর্ণিত ‘অধস্তন আদালতের দায়িত্ব পালনরত ম্যাজিস্ট্রেটদের নিয়ন্ত্রণ (কর্মস্থল নির্ধারণ, পদোন্নতিদান ও ছুটি মঞ্জুরসহ) শৃঙ্খলাবিধানের দায়িত্ব রাষ্ট্রপতির ওপর ন্যস্ত রয়েছে’- এ বিধানের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট দায়ের করা হয়। রিটে আইন ও বিচার বিভাগের জন্য সুপ্রিম কোর্টের অধীনে সচিবালয় গঠনের নির্দেশনা চাওয়া হয়।
রিটে সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদ কেন অসাংবিধানিক হবে না, এ মর্মে রুল জারির আবেদন জানানো হয়। এতে বলা হয়, অধস্তন আদালতের দায়িত্বপালনরত ম্যাজিস্ট্রেটদের নিয়ন্ত্রণ ও শৃঙ্খলাবিধানের দায়িত্ব রাষ্ট্রপতির ওপর ন্যস্ত থাকলে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা খর্ব হয়, এ কারণে এই বিধানের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে।
রিটে আইন মন্ত্রণালায়ের লেজিসলেটিভ ও পার্লামেন্টারি অ্যাফেয়ার্স বিভাগ, আইন ও বিচার বিভাগের সচিব এবং সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রারকে বিবাদী করা হয়েছে।
Advertisement
গত ২৫ আগস্ট সুপ্রিম কোর্টের ১০ জন আইনজীবী এ রিট দায়ের করেন। রিট আবেদনকারীরা হলেন, আইনজীবী মোহাম্মদ সাদ্দাম হোসেন, মো. আসাদ উদ্দিন, মো. মুজাহিদুল ইসলাম, মো. জহিরুল ইসলাম, মোস্তাফিজুর রহমান, শাইখ মাহাদী, আবদুল্লাহ সাদিক, মো. মিজানুল হক, আমিনুল ইসলাম শাকিল এবং যায়েদ বিন আমজাদ
রিটে ২০১৭ সালে প্রণীত বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিস (ডিসিপ্লিনারি) রুলসের সাংবিধানিক বৈধতাকেও চ্যালেঞ্জ করা হয়। আবেদনে একটি পৃথক বিচার বিভাগীয় সচিবালয় প্রতিষ্ঠা করতে আদালতের নির্দেশনা এবং মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তির পূর্বে সুপ্রিম কোর্টের ২০১২ সালের আদেশ প্রতিপালনে অগ্রগতি রিপোর্ট দাখিলের নির্দেশনা চেয়ে অন্তর্বর্তীকালীন আদেশ চাওয়া হয়।
রিট আবেদনে আরও বলা হয়, ১১৬ অনুচ্ছেদে অনুযায়ী অধস্তন আদালতের দায়িত্ব পালনরত ম্যাজিস্ট্রেটদের নিয়ন্ত্রণ (কর্মস্থল নির্ধারণ, পদোন্নতিদান ও ছুটি মঞ্জুরসহ) শৃঙ্খলাবিধানের দায়িত্ব রাষ্ট্রপতির ওপর ন্যন্ত রয়েছে। একই অনুচ্ছেদে রাষ্ট্রপতি ওই দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্টের সঙ্গে পরামর্শ করবেন বলে উল্লেখ রয়েছে। মূলত রাষ্ট্রপতির ওপর ন্যস্ত এই দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগের সরাসরি হস্তক্ষেপ দেখা যায়, যা বিচার বিভাগের স্বাধীনতা খর্ব করে।
১৯৭২ সালের সংবিধানে অধস্তন আদালতের দায়িত্ব পালনরত ম্যাজিস্ট্রেটদের নিয়ন্ত্রণ (কর্মস্থল নির্ধারণ, পদোন্নতি ও ছুটি মঞ্জুরসহ) শৃঙ্খলাবিধানের এই দায়িত্ব সুপ্রিম কোর্টের ওপর ন্যস্ত ছিল। ১৯৭৪ সালে সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে ম্যাজিস্ট্রেটদের নিয়ন্ত্রণ (কর্মস্থল নির্ধারণ, পদোন্নতি ও ছুটি মঞ্জুরিসহ) শৃঙ্খলাবিধানের দায়িত্ব রাষ্ট্রপতির ওপর ন্যস্ত করা হয়।
পরবর্তী সময়ে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে এবং ‘সুপ্রিমকোর্টের সহিত পরামর্শক্রমে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক তাহা প্রযুক্ত হইবে’ শব্দগুলো সন্নিবেশিত করা হয়। এরপর সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ পঞ্চম সংশোধনী আইন অসাংবিধানিক ঘোষণা করলে পঞ্চদশ সংশোধন আইন, ২০১১ এর মাধ্যমে ১১৬ অনুচ্ছেদের বর্তমান একই বিধান প্রতিস্থাপন করা হয়। বর্তমানে সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদে এই বিধানটিই বিদ্যমান।
রিট আবেদনে যেসব যুক্তি তুলে ধরা হয়েছে১. বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সংবিধানের মৌলিক কাঠামো। ১১৬ অনুচ্ছেদের মাধ্যমে এই মৌলিক কাঠামো বিনষ্ট করা হয়েছে। একই সঙ্গে বিচারকদের শৃঙ্খলাবিধির বাস্তবায়ন কার্যত আইন মন্ত্রণালয়ের হাতে ন্যস্ত করা হয়েছে।
২. সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী এরই মধ্যে বিলুপ্ত হয়েছে। পঞ্চম সংশোধনী অসাংবিধানিক ঘোষিত হয়েছে। পঞ্চদশ সংশোধনীতে ১১৬ এর বিধান বহাল রাখা হয়েছে, যা বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও আইনের শাসনের পরিপন্থি।
৩. পৃথক সচিবালয় না থাকায় বিচার বিভাগের স্বাধীনতা কার্যত স্থবির হয়ে পড়েছে। অধস্তন আদালতের ওপর আইন মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণের কারণে বিচার বিভাগের কর্মকর্তারা স্বাধীনভাবে বিচারকার্য পরিচালনা করতে পারছেন না।
এফএইচ/কেএসআর/জিকেএস