বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে ঝালকাঠির কিস্তাকাঠি আবাসন প্রকল্পের সাড়ে ৪০০ ঘর। নির্মাণের ১৮ বছর অতিবাহিত হলেও সংস্কার না হওয়ায় মানবেতর জীবনযাপন করছে এখানকার বাসিন্দারা। সীমাহীন কষ্ট সহ্য করতে না পেরে বর্ষায় অন্যত্র বাসা ভাড়া বসবাস করতে হয় অনেক পরিবারকে।
Advertisement
স্থানীয়রা জানান, ২০০৬ সালে ঝালকাঠি পৌরসভার ৭ নম্বর ওয়ার্ডে সুগন্ধা, বিষখালী ও বাসন্ডা নদীর মোহনায় ৬৫ একর খাস জমিতে গড়ে ওঠে উত্তর কিস্তাকাঠির আবাসন প্রকল্প। তিনটি ব্যারাকে নির্মিত ৪৫০টি ঘর। এখানে আড়াই হাজারের অধিক মানুষের বসবাস। ৫০টি গভীর নলকূপ অকেজো। সব কটি বাথরুমের ভাঙা দরজা। গোরস্থান বা শ্মশান না থাকায় মৃত্যুর পর মরদেহ দাফনের জন্য নিতে হয় ৫ কিলোমিটার দূরে।
সংস্কার না হওয়ায় আবাসনের ৪৫০টি পরিবার মানবেতর জীবনযাপন করছে। টিনের চালা এবং বেড়ায় সৃষ্টি হওয়া ছিদ্র পলিথিন দিয়ে ঢেকে পানি থেকে বাঁচার চেষ্টা করছে বাসিন্দারা। চলতি বছর কয়েক ধাপে ভারি বৃষ্টি হওয়ায় বসতঘরে পানি প্রবেশ ঠেকাতে না পেরে ঘর ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছে অনেক পরিবার। আসছে শীত মৌসুমেও ঘরের বেড়া পলিথিন দিয়ে মুড়িয়ে ঠান্ডা থেকে মুক্তি পাওয়ার প্রস্তুতিও নিতে হবে অনেককে।
সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, প্রতি পাঁচটি পরিবারের জন্য একটি করে শৌচাগার ও গোসলখানা রয়েছে এখানে। শৌচাগারগুলো এখন ব্যবহারের অযোগ্য। পয়ঃনিষ্কাশনের জন্য ব্যারাকে কোনো ড্রেন না থাকায় ময়লা দুর্গন্ধযুক্ত পানি যাচ্ছে এখানকার পুকুরে। আর দূষিত হচ্ছে গোটা পুকুরের পানি। এ পুকুরের পানি ব্যবহার করে বাসিন্দারা নানা রোগেও আক্রান্ত হচ্ছে। দুই একজন বাসিন্দা ঘর নিজেরা মেরামত করে বসবাস করলেও নিম্ন আয়ের অসহায় বাসিন্দারা সংস্কার না করেই দিনের পর দিন কষ্টে কাটাচ্ছেন।
Advertisement
আবাসনের বাসিন্দা দিনমজুর দেলোয়ার হোসেন মাঝি বলেন, বৃষ্টির দিনে মাঠের চেয়ে আমার ঘরে পানি বেশি ওঠে। চালে পলিথিন টাঙিয়েও বৃষ্টি ঠেহানো যায় না। আর শীতে তো জন্মের কষ্ট। ভাঙা বেড়া দিয়ে হুহু করে ঠান্ডা ঢোকে। আঠাদিয়ে মোটা কাগজ বেড়ায় লাগিয়ে রাখি।'
সীমা আক্তার নামের একজন বলেন, বইষ্যা নামলে মোর ঘরের চালের যে কয়জায়গা দিয়া পানি পরে, তা কইতে পারি না। হেই পানি ধরার লইগ্যা মোড় ঘরে হেতুডি হাড়ি-পাতিলও নাই। পেত্তেক ঘরে তিনবান হইররা টিনের প্রয়োজন। খাওয়ার পানির সব কয়ডা কল নষ্ট। বাথরুমের দরজাও না থাহার মতোন।
রিনা বেগম বলেন, জরাজীর্ণ ঘরতো আছেই, এছাড়া এ আশ্রয়ণ প্রকল্পে নেই ঘূর্ণিঝড় আশ্রয় কেন্দ্র, নেই গোরস্থান। দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় আমাদের শহরে গিয়ে উঠতে হয়। আর ড্রেন না থাকায় পানি জমে থাকে। ডেঙ্গুর ভয়ে নিজেরা মহিলারা কোদাল দিয়ে মাটি কুপিয়ে পানি সরানোর চেষ্টা করি।
আবাসনের বাসিন্দা আলমগীর খান জানান, তিন নদীর মোহনায় আমাদের আবাসনের কাছাকাছি কোনো সাইক্লোন শেল্টার না থাকায় ঝড়-বন্যায় আমরা অনেকে শহরে চলে যাই। আবাসনের বর্তমান পরিবেশ গরু ঘরের চেয়েও খারাপ।
Advertisement
বাসিন্দাদের দুর্দশা নিয়ে উত্তর কিস্তাকাঠি আবাসন প্রকল্প সমবায় সমিতি-১ এর সাধারণ সম্পাদক কামাল হোসেন বলেন, আমরা বিভিন্ন সময় আবাসনের এসব সমস্যার কথা কর্তৃপক্ষকে জানালেও তারা কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। বিগত সরকার বিভিন্ন জায়গায় নতুন নতুন আবাসন ও ঘর নির্মাণ করলেও আমাদের এখানের তিন হাজার বাসিন্দাদের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হয়নি। এখানে বসবাসকারীদের একটাই দাবি দ্রুত প্রতিটি ঘরের চালের টিন পরিবর্তন করে নতুন করে চালা তৈরি, শৌচাগার ও গোসলখানাগুলো সংস্কার এবং নষ্ট হয়ে থাকা সব কটি টিউবওয়েল মেরামত করে ব্যারাকগুলো বসবাসের উপযুক্ত করতে হবে।
সদর উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) মোজাম্মেল হক বলেন, কিস্তাকাঠি আবাসন প্রকল্প অনেক পুরনো। সবকিছু নতুনভাবে নির্মাণ করলে সমস্যার স্থায়ী সমাধান হবে। গত ৬ বছর আগে সংস্কারের জন্য চাহিদা অনুযায়ী বরাদ্দ চেয়ে মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠিয়েছিলাম। তারপর ২০১৮ সালের ডিসেম্বর মাসে টেন্ডার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ঘরপ্রতি দুটি করে টিন লাগানো হয়েছিল। গৃহ বরাদ্দের পর ১৭ বছরের মধ্যে এই মেরামত খুবই নগণ্য।
ঝালকাঠি সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ফারহানা ইয়াসমিন বলেন, প্রকল্পের বাসিন্দাদের দুর্ভোগ নিরসনের জন্য যথাসাধ্য কাজ করা হবে। বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হবে।
মো. আতিকুর রহমান/আরএইচ/জিকেএস