বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে নারায়ণগঞ্জে একছত্র আধিপত্য বিস্তার করতেন নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য শামীম ওসমান। তার ছেলে অয়ন ওসমানও আওয়ামী লীগের কোনো পদ পদবীতে না থেকেও রাজনীতিতে অনেক প্রভাব ফেলতেন। বিশেষ করে জেলা ও মহানগর ছাত্রলীগকে তিনি এককভাবে নিয়ন্ত্রণ করতেন।
Advertisement
জেলা ও মহানগর ছাত্রলীগের পদে আসতে হলে তার অনুগত হতে হতো। তার আনুগত্যের বাইরে কেউই ছাত্রলীগের পদে আসতে পারতেন না। সেইসঙ্গে অয়ন ওসমানের অনুসারী ছাত্রলীগ নেতারা অনেক সময় মূলদলের নেতাদেরও অপমান অপদস্থ করতেন। তাদের কারণে ত্যাগী নেতারাও মূল্যায়ন পেতেন না।
পাশাপাশি অয়ন ওসমানের অনুসারী এসকল ছাত্রলীগ নেতারা বিপুল পরিমাণ টাকার মালিকও বনেছেন। শূন্য থেকে দেশ-বিদেশে গড়েছেন সম্পদের পাহাড়। ছাত্র অবস্থায়ই অস্ত্রের ঝনঝনানি ছিল তাদের হাতে। সবশেষ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় শামীম ওসমানের অস্ত্রের মহড়ায় তারা অস্ত্র সরবরাহের দায়িত্বে ছিলেন। ক্ষমতার পটপরিবর্তনের মধ্য দিয়ে বর্তমানে তাদের কেউ এখন দেশের বাইরে রয়েছেন কিংবা দেশেই আত্মগোপনে রয়েছেন।
স্কুলের গণ্ডি না পেরিয়েও ছাত্রলীগ নেতা আহমেদ কাউসারঅয়ন ওসমানের অন্যতম অনুসারী ছিলেন আহমেদ কাউসার। স্কুলের গণ্ডি না পেরোলেও শামীম ওসমানের ছেলে অয়ন ওসমানের অনুগত হওয়ার সুবাদে ছাত্রলীগ নেতা বনে যান শহরের নলুয়াপাড়া এলাকার বাসিন্দা আহমেদ কাউসার। সবশেষ তিনি যুবলীগের পদপ্রত্যাশী ছিলেন। তার কারণে ছাত্রলীগের রাজনীতিতে ত্যাগ তীতিক্ষার শিকার অনেকেই যুবলীগের পদ-পদবী থেকে বঞ্চিত ছিলেন।
Advertisement
আহমেদ কাউসারের বাবা এক সময় ডাব বিক্রি করতেন। তিনি নিজে শহরের রিভারভিউ মার্কেটে একটি দোকানে চাকরি করতেন। ২০১৭ সালের দিকে অয়ন ওসমান তাকে ব্যক্তিগত সহকারী হিসেবে ব্যবহার শুরু করেন। এরপর থেকেই আহমেদ কাউসারকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। অনুগতদের তালিকায় অন্যদের পেছনে ফেলে তিনি এগিয়ে যান। গড়ে তোলেন দেশে-বিদেশে বিপুল পরিমাণ সম্পদ।
এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, শহরের নলুয়াতে দেড় কোটি টাকা ব্যয়ে একটি দুইতলা ভবন নির্মাণ করেছেন আহমেদ কাউসার। গত বছর পাশেই আরও একটি ৫তলা ভবন কেনেন। শহীদনগর ও আশপাশের এলাকাতে প্রচুর জমির মালিক তিনি। সেইসঙ্গে বিদেশেও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান দিয়েছেন। ৫ আগস্টের আগে নারায়ণগঞ্জ শহর ও শহরতলীর বিভিন্ন এলাকায় শামীম ওসমানের অস্ত্র মহড়ার ঘটনায় তার একাধিক ছবি প্রকাশ পেয়েছে। সেখানে অস্ত্র হাতে তাকে দেখা গেছে অসংখ্যকবার। সেইসঙ্গে তিনি সেসময় অনেককে অস্ত্রও সরবরাও করেছিলেন। যা নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অনেক নেতাকর্মী জানিয়েছেন।
বহু অপকর্মের হোতা ছাত্রলীগ নেতা হাবিবুর রহমান রিয়াদশামীম ওসমানের ছেলে অয়ন ওসমানের অনুগত হওয়ার সুবাদে মহানগর ছাত্রলীগের সভাপতি পদে আসেন হাবিবুর রহমান রিয়াদ। ছাত্রলীগের পদে আসা এবং অয়ন ওসমানের সহযোগী সবমিলিয়ে তিনি ধরাকে সরা জ্ঞান করেন। সরকারি তোলারাম কলেজে তিনি একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করেন। কলেজ সংসদ নির্বাচন না হলেও তিনি ছিলেন স্বঘোষিত ভিপি। সেইসঙ্গে ছাত্র নির্যাতন ও সাংবাদিক পেটানো সবকিছুতেই তিনি ছিলেন পটু।
কলেজের ভেতর টর্চার সেল গড়ে তুলেছিলেন তিনি। তার এসকল কাজের অন্যতম প্রধান সহযোগী ছিলেন জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আশরাফুল ইসলাম রাফেল প্রধান। অয়ন ওসমানের প্রভাব ব্যবহার করে ঠিকাদারি নিয়ন্ত্রণ, ঝুট নিয়ন্ত্রণ, চাঁদাবাজি করে বিপুল সম্পত্তির মালিক হয়েছেন তারা।
Advertisement
শহরের মাসদাইর এলাকার বাসিন্দা হাবিবুর রহমান রিয়াদ এলাকায় বিগত সময়ে ৮ থেকে ১০ কোটি টাকার জায়গা কিনেছেন। বিসিক শিল্পনগরী এলাকায় তিনি দীর্ঘদিন ধরে ঝুট নামিয়েছেন। এলাকায় রয়েছে ইন্টারনেট ব্যবসা। তার পরিবারের সদস্যরা বিএনপির রাজনীতিতে জড়িত থাকলেও হাবিবুর রহমান রিয়াদ ছাত্রলীগের একনিষ্ঠ নেতা বনে যান।
একইসঙ্গে রাফেল প্রধানও চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি ও ঝুট নিয়ন্ত্রণ করতেন। মাসদাইর এলাকায় ইন্টারনেট ব্যবসার দখল নিয়ে নিজেদের মধ্যেই গোলাগুলির নেতৃত্ব দেওয়ার অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে। ২০২৩ সালের ৪ জুন রাফেল প্রধানের নেতৃত্বে তার বাহিনী অস্ত্র উচিয়ে প্রতিপক্ষ ব্যবসায়ীকে মারধর ও গুলিবর্ষণ করে। তবে ওই ঘটনার পর ওসমান পরিবারের সদস্যরাই বিষয়টি মীমাংসা করে দেয়।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে ১৮ জুলাই চাষাঢ়ায় প্রথম সংঘর্ষে দুপুর ২টার দিকে অস্ত্র নিয়ে গুলিবর্ষণ ও হামলা চালান ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। যেখানে নেতৃত্বে ছিলেন অয়ন ওসমানের অনুসারী রিয়াদ প্রধান, আহমেদ কাউসার, রাফেল প্রধান। পরবর্তী সময়ে শামীম ওসমানের নেতৃত্বেই আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি চালায় এই বাহিনী।
ছাত্রাবস্থায় অস্ত্রের লাইসেন্সের আবেদননারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসকের কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, ২০২৩ সালের জানুয়ারি মাসে নিজেকে ব্যবসায়ী দাবি করে একটি শটগানের লাইসেন্সের জন্য আবেদন করেন হাবিবুর রহমান রিয়াদ। আবেদনে তার ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান হিসেবে ‘জালাল এন্টারপ্রাইজ’ উল্লেখ করা হয়েছিল। এটি একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান।
নিয়ম অনুযায়ী আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্সের বিষয়ে চিঠি যায় জেলা পুলিশ সুপার কার্যালয়ে। গত সেপ্টেম্বরে এই ছাত্রলীগ নেতার আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্সের জন্য আবেদনের বিপরীতে অনাপত্তি দেয় পুলিশ সুপার কার্যালয়। সবশেষ আবেদনটি জেলা প্রশাসক তথা জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে নারায়ণগঞ্জের জেলা প্রশাসক ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ মাহমুদুল হক বলেন, নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে যে কেউ আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্সের জন্য আবেদন করতে পারে। কিন্তু এক্ষেত্রে নির্দিষ্ট কিছু ক্রাইটেরিয়া থাকে। সেসব বিষয় ঠিক থাকলে আবেদনকারী অস্ত্রের লাইসেন্স পান, না হলে পান না। সব আবেদনকারীর ক্ষেত্রেই একইরকম সিস্টেম।
ছাত্র ও সাংবাদিক পিটিয়েও ছাড়া পেয়ে যান রিয়াদগত বছরের ১৫ জুলাই রাতে সরকারি তোলারাম কলেজের সামনের সড়ক দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় ছাত্রদলের ৪ নেতাকর্মীকে পেটায় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। এ ঘটনার নেতৃত্ব দেন হাবিবুর রহমান রিয়াদ। ঘটনার খবর পেয়ে সেখানে গেলে ছবি ও ভিডিও ধারণে বাধা দিয়ে দুই সাংবাদিককে মারধর করেন তারা। তাদের মোবাইলফোনও ছিনিয়ে নেওয়া হয়। ২০২১ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি দুপুরে সরকারি তোলারাম কলেজে ফরম পূরণ করতে গিয়ে রিয়াদ ও তার লোকজনের মারধরের শিকার হন ওই কলেজের দুই শিক্ষার্থী আতা-ই-রাব্বি ও আব্দুল্লাহ আল মামুন। তারা দুজন ওই কলেজ শাখা ছাত্রদলের আহ্বায়ক ও যুগ্ম-আহ্বায়ক ছিলেন।
যোগাযোগ করা হলে জেলা ছাত্রদলের সহসভাপতি ও সরকারি তোলারাম কলেজের প্রাক্তন ছাত্র আতা-ই-রাব্বি বলেন, আমি সেদিন তোলারাম কলেজে পরীক্ষার খোঁজখবর নিতে গিয়েছিলাম। তখন কলেজের ভেতরেই হাবিবুর রহমানের নেতৃত্বে তার অনুসারী লোকজন আমাকে ও আরেক ছাত্রকে ব্যাপক মারধর করে। এর আগেও ছাত্রদলের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকায় সে আমাকে হুমকি-ধমকি দিয়েছিল। সেসময় রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে থানায় গেলে উল্টো হয়রানির শিকার হতে হয় বলে আইনি প্রক্রিয়ায় যাইনি। আর তোলারাম কলেজের ছাত্রছাত্রী সংসদের রুমটিকেতো টর্চারসেল বানিয়ে রাখা হয়েছিল।
২০১৯ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর দুপুরে কলেজের সামনের সড়কে আরেক শিক্ষার্থী শাহজাহান আলীকে পিটিয়েছিলেন রিয়াদের নেতৃত্বে তোলারাম কলেজ ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা।
তোলারাম কলেজে ছাত্রলীগের কর্মকাণ্ড নিয়ে সংবাদ করার জেরে সাংবাদিকের ওপর দুই বার হামলার অভিযোগও আছে। এ ঘটনায় ডেইলি স্টারের সাংবাদিক সৌরভ হোসেন সিয়াম ফতুল্লা মডেল থানায় একটি সাধারণ ডায়রি করেছিলেন।
পিটুনি খেয়ে আলোচিত হন রিয়াদ২০২১ সালের ১১ নভেম্বর সদর উপজেলার এনায়েতনগর ইউপির একটি ভোটকেন্দ্র দখলে গিয়ে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে আটক হন হাবিবুর রহমান রিয়াদ। পরবর্তীতে ভোটকেন্দ্রের সামনে বিশৃঙ্খলা করতে থাকা রিয়াদ ও তার দলবলকে লাঠিপেটা করে র্যাব। তাদের পিটুনির খবর শুনে তৎকালীন সংসদ সদস্য শামীম ওসমান ছুটে যান।
সেসময় হাবিবুর রহমান রিয়াদ শামীম ওসমানের কাছে বিচার দেন ‘আমাদের কুত্তার মতো পিটিয়েছে’। আর এই বিষয়টি সারাদেশব্যাপী মুহূর্তের মধ্যেই ছড়িয়ে পড়ে। এ ঘটনার পর তাদের কাছ থেকে ককটেল, ধারালো অস্ত্র, লাঠিসোঁটাও উদ্ধার করে র্যাব। ২০২২ সালের জানুয়ারিতে নারায়ণগঞ্জ মহানগর ছাত্রলীগের কমিটি বিলুপ্ত করা হলেও ছাত্রলীগের একটি অংশকে এখনো নেতৃত্ব দেন রিয়াদ।
এদিকে গত ৯ ফেব্রুয়ারি রাতে শহরের চাষাঢ়ায় আল-আমিন ওরফে দানিয়েলকে (২৮) কুপিয়ে হত্যা করে মরদেহ মাসদাইরে তার বাড়ির সামনে ফেলে রাখা হয়। এ হত্যাকাণ্ডে জড়িতরাও হাবিবুর রহমান রিয়াদের ঘনিষ্ঠজন বলে পরিচিত।
এ বিষয়ে নারায়ণগঞ্জ মহানগর ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি রাকিবুর রহমান সাগর বলেন, ছাত্রলীগের সময় পরিস্থিতি কেমন ছিল তার বড় সাক্ষী সাংবাদিক সমাজ। সাধারণ শিক্ষার্থীরা কোনো দাবি দাওয়া পেশ করতে পারতো না। নারায়ণগঞ্জের গোটা ছাত্র সমাজ তাদের কাছে জিম্মি ছিল। সাংবাদিকরাও তাদের হাতে নিরাপদ ছিল না। কলেজ ক্যাম্পাসে কোনো রকমের রাজনৈতিক চর্চা করতে পারতো না শিক্ষার্থীরা। ছাত্রলীগ একটা সন্ত্রাসী সংগঠনে রূপ নিয়েছিল। এমন কোনো অপকর্ম নেই তারা করেনি। তাদের কোনো অধিকার নেই রাজনীতি করার। বর্তমান সরকার ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করে ছাত্র রাজনীতিকে কলঙ্কমুক্ত করেছে।
এফএ/এমএস