রাজধানীর ধানমন্ডির ল্যাবএইড হাসপাতালে এন্ডোসকপি করাতে গিয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী রাহিব রেজার মৃত্যুর ঘটনায় চিকিৎসায় অবহেলার প্রমাণ পেয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
Advertisement
এজন্য অভিযুক্ত চিকিৎসক ডা. মামুন আল মাহতাব স্বপ্নীলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল (বিএমডিসি) ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) কর্তৃপক্ষকে চিঠি দেয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। তবে দীর্ঘ সময় পেরিয়ে গেলেও এখনো কোনো ব্যবস্থা নেয়নি দুই প্রতিষ্ঠান।
অভিযুক্ত চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব স্বপ্নীল বিএসএমএমইউয়ের ইন্টারভেনশনাল হেপাটোলজি বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান। তার নিবন্ধন বাতিল ও ল্যাবএইডের কাছে ক্ষতিপূরণ চেয়েছে ভুক্তভোগী রাহিব রেজার পরিবার।
বুধবার (২৩ অক্টোবর) হাইকোর্টে এক সংবাদ সম্মেলনে রাহিব রেজার পরিবারের আইনজীবী ব্যারিস্টার রাশনা ইমাম এসব তথ্য জানান। এ সময় রাহিবের স্ত্রী ও তার পরিবারের অন্য সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।
Advertisement
গত ১৫ ফেব্রুয়ারি পেটে গ্যাসজনিত সমস্যা নিয়ে ডা. স্বপ্নীলের কাছে গেলে তিনি রাহিবকে এন্ডোসকপি করার পরামর্শ দেন। পরে ওইদিন সন্ধ্যায় রাহিব ধানমন্ডির ল্যাবএইড হাসপাতালের বহির্বিভাগে অপেক্ষা করেন। রাত আনুমানিক ১১টার দিকে তার পরীক্ষা শুরু হয়। প্রায় দেড় ঘণ্টা পর রোগীকে মুমূর্ষু অবস্থায় দেখতে পান রাহিবের পরিবারের সদস্যরা। শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে তাকে ল্যাবএইডের আইসিইউতে নেওয়া হয়। তিনদিন চিকিৎসাধীন থাকার পর ১৯ ফেব্রুয়ারি সকালে রাহিবকে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসকরা।
এ ঘটনায় চিকিৎসায় অবহেলার অভিযোগ করে রাহিবের পরিবার। তাদের অভিযোগ, দায়িত্বরত চিকিৎসক ও টিমের গাফিলতির কারণে সাধারণ একটা অস্ত্রোপচার করতে গিয়ে প্রাণ হারাতে হয়েছে রাহিবকে।
তারা বলেন, এ ঘটনায় ডা. মামুন আল মাহতাব স্বপ্নীল কোনোভাবেই দায় এড়াতে পারেন না। রিপোর্ট না দেখেই অ্যানেস্থেসিয়া দেওয়ার কারণে এমনটা হয়েছে বলে সে সময় অভিযোগ ছিল রাহিবের পরিবারের।
পরে সাবেক স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী ডা. সামন্ত লাল সেন ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। এ সময় তিনিও বেশকিছু ত্রুটি দেখতে পান। পরে এ ঘটনায় দ্রুত কমিটি গঠন করে তদন্তের নির্দেশ দেন।
Advertisement
পরে আদালতে যায় রাহিবের পরিবার। ১১ মার্চ আদালত রুল জারি করেন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও মন্ত্রণালয়কে তদন্ত কমিটি গঠনের নির্দেশ দেন। ছয় মাস তদন্ত করে গত ১৯ সেপ্টেম্বর আদালতের প্রতিবেদন দাখিল করে অধিদপ্তরের কমিটি। যেখানে চিকিৎসায় গুরুতর অবহেলার প্রমাণ পায় কমিটি।
সংবাদ সম্মেলনে ব্যারিস্টার রাশনা ইমাম বলেন, চিকিৎসায় অবহেলার ঘটনা এখন স্বাভাবিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর প্রতিবাদে আমরা হাইকোর্টে একটি রিট পিটিশন দাখিল করেছিলাম। একই সঙ্গে বেশকিছু নির্দেশনা চেয়েছিলাম। আমাদের দাবি ছিল, চিকিৎসায় অবহেলা হয়েছে কি না সে বিষয়ে একটা তদন্ত কমিটি গঠন করা। সে আলোকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর তদন্ত করেছে। প্রতিবেদনের সঙ্গে একটি স্পষ্টীকরণ (ক্লারিফিকেশন) চিঠিও দিয়েছে অধিদপ্তর। যেখানে স্পষ্ট করে ডা. স্বপ্নীলের বিরুদ্ধে গুরুতর অবহেলার প্রমাণ পাওয়া গেছে।
প্রতিবেদনের সূত্র উল্লেখ করে তিনি বলেন, এন্ডোসকপির প্রক্রিয়া, এন্ডোসকপিকালীন এবং পরবর্তী স্টেজেও চিকিৎসায় চরম অবহেলা করা হয়েছে। রাহিব রেজা সর্বোচ্চ ঝুঁকির রোগী ছিলেন। অতিরিক্ত ওজন, কার্ডিয়াক ইস্যুও ছিল। অস্ত্রোপচারের আগে যেসব পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়েছে সেখানেই এসব শনাক্ত হয়। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, ওনারা কোনো রিপোর্টই দেখেননি। ফলে কোনো ঝুঁকি আছে কি না তা না জেনে কোনো ব্যবস্থাই নেননি। এর মধ্যেই অ্যানেস্থেসিয়া দিয়ে অস্ত্রোপচার করা হয়। এখন প্রশ্ন এসেছে, কে অ্যানেস্থেসিয়া দিয়েছিল।
এই আইনজীবী বলেন, তদন্ত প্রতিবেদন বলছে সেখানে দক্ষ কোনো অ্যানেস্থেসিস্ট ছিলেন না। এটা অবাক করে দিচ্ছে। এত বড় হাসপাতালে, এত বড় একজন ডাক্তার তার টিমে কোনো দক্ষ অ্যানেস্থেসিস্ট নেই! কোনো ঝুঁকি যাচাই ছাড়াই এন্ডোসকপি করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, এন্ডোসকপিতে সম্পৃক্ত আটজনের সাতজনেরই অভিজ্ঞতার কোনো কাগজ তদন্ত কমিটি পায়নি। অর্থাৎ অদক্ষ লোক দিয়ে এন্ডোসকপি করা হয়েছে। এখানে স্বপ্নীল ও হাসপাতাল উভয় সমান অপরাধী। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয়, একই দিনে একই ডাক্তার আরও ৬৬টি এন্ডোসকপি ও কলোনসকপি করেছেন। এ ঘটনার পর সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী (সামন্ত লাল সেন) পরিদর্শনে গিয়ে একদিনে ৭১টি এন্ডোসকপি করার প্রমাণ পান। এগুলো যদি এখনই চিহ্নিত ও ব্যবস্থা না নেওয়া হয়, সামনে আমরাও ভুল চিকিৎসার শিকার হয়ে অকালে মারা যাবো।
রাশনা ইমাম বলেন, এখনও ক্লিয়ার না, রিএজেন্ট কী ব্যবহার করা হয়েছিল? এমনকি ল্যাবএইডের এন্ডোসকপি সেটআপে ত্রুটি পাওয়া গেছে। প্রতিবেদনে মন্তব্য করা হয়েছে, এন্ডোসকপির পর রোগীর শ্বাসকষ্টসহ অন্যান্য জটিলতা দেখা দিয়েছিল, সেখান থেকে ৮৫ মিনিট ধরে সময় নষ্ট করা হয়েছে। ফলে রোগীকে পরে আইসিইউতে নিলেও বাঁচানো যায়নি।
শাস্তি ও ক্ষতিপূরণের বিষয়ে তিনি বলেন, তদন্তের পর অধিদপ্তর বিএমডিসিতে চিঠি দেয় ব্যবস্থা নিতে। কিন্তু এখনো কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। এজন্য আমরা আদালতের কাছে ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশনা দেওয়ার আবেদন জানাবো। একইভাবে বিএসএমএমইউ কেও তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছিল। তারাও কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। এখন আমরা ডা. স্বপ্নীলের নিবন্ধন বাতিল, ল্যাবএইডের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা এবং ক্ষতিপূরণের দাবিতে হাইকোর্টে আবেদন করবো।
এএএম/কেএসআর/এএসএম