দেশজুড়ে

অনিয়মই যেন নিয়ম ছিল শেবাচিমের সাবেক পরিচালক সাইফুলের

দক্ষিণাঞ্চলবাসীর একমাত্র চিকিৎসার ভরসাস্থল বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে (শেবাচিম) দীর্ঘ আড়াই বছর ক্ষমতার অপব্যবহার করে নিজের মতো চালিয়েছেন সাবেক পরিচালক ডা. সাইফুল ইসলাম। তার কাছে অনিয়মই যেন ছিল নিয়ম। হাসপাতালে ধারণক্ষমতার চেয়ে দ্বিগুণ রোগী থাকলেও রোগীদের জন্য বেডের ব্যবস্থা না করে মেডিসিন ওয়ার্ডের বিশাল অংশজুড়ে বসিয়েছেন একটি বেসরকারি ব্যাংকের শাখা।

Advertisement

এর বাইরেও করেছেন সরকারি জমি দখল, অল্প দিনে গড়েছেন বরিশালের প্রাণকেন্দ্র বিলাসবহুল বাড়ি, দিয়েছেন প্রাইভেট হাসপাতাল। এসব বিষয়ে খোঁজ নিতে গেলে জাগো নিউজের হাতে আসে নানা অজানা তথ্য।

জানা গেছে, শেবাচিম হাসপাতালে পরিচালক হিসেবে যোগদানের পরপরই হাসপাতালের নবনির্মিত ভবন মেডিসিন ওয়ার্ডের নিচ তলায় ব্যাংক স্থাপনের জন্য উঠে পড়ে লাগেন ডা. সাইফুল ইসলাম। লোকদেখানোর জন্য কয়েকটি ব্যাংকের কাছ থেকে তাদের শাখা স্থাপনের আবেদন জমা নেন। কিন্তু ভাই মনির হোসেন ও ভাইয়ের স্ত্রীর কর্মস্থল মেঘনা ব্যাংক আগে থেকেই ঠিক করে রাখেন তিনি। পরে সেখানে নিচ তলার বিশাল অংশ জুড়ে স্থাপন করা হয় মেঘনা ব্যাংক, শেবাচিম শাখা।

কারণ হিসেবে জানা যায়, তার ভাই মনির হোসেনকে ওই শাখায় ম্যানেজার হিসেবে পদোন্নতি দেওয়া হবে। পরে এ নিয়ে বিতর্কের সৃষ্টি হলে তার ভাইকে ঝালকাঠি জেলার নলছিটি উপজেলায় বদলি করা হয়। কিন্তু তার ভাইয়ের স্ত্রী এখনো মেডিকেল শাখায় কর্মরত আছেন।

Advertisement

এ ব্যাপারে বরিশাল মেঘনা ব্যাংকের শাখা ব্যবস্থাপক মো. আমিনুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, এখানে আমাদের কোনো হাত ছিল না, এটা সরাসরি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ও মেঘনা ব্যাংক কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নিয়ে শাখা স্থাপন করেছে। আমরা বরিশাল শাখা শুধু জায়গা নির্ধারণ করে ঢাকায় জানিয়েছি।

এমনকি হাসপাতালে থাকাকালীন রোগীদের ব্যবহারের জন্য বরাদ্দ দেওয়া ৪টি অ্যাম্বুলেন্সের মধ্যে একটি নিজের ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করেছেন সাবেক এই পরিচালক। অন্যগুলো নষ্ট ও চালক সংকট দেখিয়ে রোগীর স্বজনদের বাধ্য করা হতো অতিরিক্ত ভাড়া দিয়ে বাইরের অ্যাম্বুলেন্স ব্যবহার করতে। সেখান থেকেও তার কাছে আসতো বিশাল অংকের ভাগ।

এছাড়া নিয়মবহির্ভূত ভাবে দিয়েছেন জনবল নিয়োগ। হাসপাতাল চত্বরের মধ্যে থাকা গাছ কেটে বিক্রি করে আত্মসাত করেছেন লাখ লাখ টাকা। তৎকালীন সময়ে এসব বিষয়ে তার বিরুদ্ধে কেউ মুখ খুলতে সাহস পায়নি। কেউ মুখ খুললে তাকে হতে হয়েছে বদলি।

হাসপাতালের সাবেক ওয়ার্ড মাস্টার রাশেদ জাগো নিউজকে বলেন, পরিচালক সাইফুল ইসলামের নেতৃত্বে একাধিকবার হাসপাতালের গাছপালা কেটে বিক্রি করে অর্থ তার কাছে তুলে দিয়েছি। কিন্তু সরকারি ফান্ডে কোনো টাকা জমা দেননি তিনি।

Advertisement

তিনি আরও বলেন, হাসপাতালের ব্লাড ব্যাংক থেকে প্রতিদিন ৫ হাজার করে মাসে দেড় লাখ টাকা ও প্যাথলজি বিভাগ থেকে মাসে দেড় লাখ টাকা করে মোট ৩ লাখ টাকা নিতেন পরিচালক। এসব বিষয়ে কথা বলায় আমাকে তিনি শোকজ করার হুমকি দেন। পরে এ বিষয়ে গণমাধ্যমে জানালে আমাকে বরগুনায় বদলি করে দেন। এসব কারণে তার ভয়ে কেউ কিছু বলতো না।

অভিযোগ রয়েছে অনিয়ম দুর্নীতির টাকায় অল্প দিনের মাথায় ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কের পাশে নগরীর সিএন্ডবি রোড এলাকায় কয়েক কোটি টাকায় জমি কিনে বিশাল এক বহুতল ভবন নির্মাণ করেছেন। সেখানে দিয়েছেন ‘নিরুপন হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার’ নামে নিজের এক প্রাইভেট হাসপাতাল। হাসপাতালের অধিকাংশ রোগী শেবাচিম হাসপাতালের। যাদের পরিচালকের নিজস্ব দালাল বাহিনী দিয়ে ফুঁসলিয়ে ওখানে নিয়ে যাওয়া হতো।

এছাড়াও বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী হোস্টেলের পাশে একটি অসহায় পরিবারকে পুলিশ বাহিনী দিয়ে উচ্ছেদ করে খাস জমিসহ প্রায় দুই একর জমি ক্রয় করেছেন তিনি।

সেখানে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ডা. সাইফুল ইসলাম সরকারি খাস জমিসহ ১৯০ শতাংশ জমি ক্রয় করেছেন। যেখানে পিলার ও তারকাঁটার বেড়া দিয়ে সীমানা নির্ধারণ করে রেখেছেন।

স্থানীয় একাধিক বাসিন্দা জানান, এই ১৯০ শতাংশ জমির মধ্যে সরকারি খাস নদীর জমিও রয়েছে, যা ডা. সাইফুল ইসলাম ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে কিনে নিয়েছেন।

এসব বিষয়ে ড. সাইফুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, হাসপাতালে তার বিরুদ্ধে একটি চক্র কাজ করতো। এসব তাদের চক্রান্ত।

ভার্সিটি এলাকায় জমি ও শহরে বিলাসবহুল বাড়ির বিষয়ে তিনি বলেন, ভার্সিটি এলাকায় দুই একর জমি না, তার চেয়ে কম কিনেছেন। এছাড়া নিজের প্রাইভেট হাসপাতালে রোগী দেখে ও বেতনের টাকায় ভবন নির্মাণ করেছেন বলে দাবি করেন তিনি।

এফএ/এএসএম