বিশেষ প্রতিবেদন

বৃদ্ধাশ্রমের এক মায়ের কান্না

মেঘে ভর করা আকাশ সূর্য অস্ত যাওয়ার খানিক আগেই সন্ধ্যা নামিয়েছে। বৃষ্টি নামতে পারে বলে আজ বিকেলে আর বারান্দায় যাওয়া হয়নি। বয়সের ভারে নুয়ে পড়েছেন। তবুও পরিপাটি। বিছানায় বসেই পত্রিকায় চোখ বোলাচ্ছেন। পাশের চেয়ারে রাখা আরেকটি ইংরেজি দৈনিক। চার দেয়ালের মধ্যখানে যার বেঁচে থাকা, সে দুনিয়ার খবরও রাখেন নিয়মিত। পত্রিকা পড়েই দিনের অধিক সময় পার করেন। বলছিলাম, রাজধানীর আগারগাঁওয়ে অবস্থিত প্রবীণ নিবাসের (বৃদ্ধাশ্রম) বৃদ্ধা মিরা চৌধুরীর কথা। শনিবার সন্ধ্যায় আশ্রমের ৪১৫ নম্বর কক্ষে বসে কথা হয় এই বৃদ্ধার সঙ্গে। খাটের পাশে চেয়ারের সঙ্গে রাখা স্ক্যাস। এটিই এখন তার পথ চলার একমাত্র সম্বল। আশ্রমে আসার তিন মাস পরেই সিঁড়ি থেকে পড়ে পা ভেঙে যায়। আর সবল হতে পারেননি মিরা। কথা হচ্ছিল মা দিবস প্রসঙ্গে। শুরু থেকেই মৃদু ভাষায় কথা বলছিলেন। মা দিবসের কথা শুনে নিজেকে আর আটকে রাখতে পারলেন না। গলা ধরে এলো। নিমিষেই চোখের কোণ বেয়ে দু’ফোটা জল গালে গড়ালো। বয়সের ভারে কুচকানো গাল। তাতে বেদনার জল। তবুও বিদ্যুতের আলোতে চিকচিক করতে লাগলো। চশমা খুলে ওড়নায় চোখের পানি মুছতে মুছতে শোনালেন সংক্ষিপ্ত জীবনকথা। বয়স ষাটের কোটা পেরিয়েছে। জন্ম রাজধানীর পুরান ঢাকার মালিটোলায়। ১৯৮৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন মিরা। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের পাঠ চুকিয়ে মিরা চৌধুরী কর্মজীবন শুরু করেন খুলনা কলেজিয়েট স্কুলের শিক্ষিকা হিসেবে। এরপর বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের সবচেয়ে কাছের প্রিয়বন্ধু জোসেফ চৌধুরীর সঙ্গে। স্বামী ইন্টারন্যাশনাল লেবার অর্গানাইজেশন (আইএলও) এর ডিরেক্টর পদে দায়িত্ব পালন করেন দীর্ঘদিন। জীবন সংসারের আলো যখন উদ্ভাসিত, ঠিক তখনই ছন্দপতন। স্বামীর মৃত্যুই জীবনযুদ্ধে পরাজিত সৈনিকের রূপ দেয় মিরাকে। একমাত্র ছেলে অপূর্ব হাসান চৌধুরী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি বিভাগ থেকে পাশ করে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান উচ্চতর ডিগ্রি নিতে। সমস্ত স্বপ্নস্বাদের কবর রচনা করে মিরা চৌধুরী আজ ঠাঁই নিয়েছেন আশ্রমের ৪১৫ নম্বর কক্ষে। জীবনের অর্জিত সম্পদ দিয়ে একমাত্র সন্তান অপূর্ব হাসান চৌধুরীকে উচ্চ শিক্ষার উদ্দেশ্যে যুক্তরাষ্ট্রে পাঠিয়েছেন। সন্তানকে বিদেশে পড়িয়ে জীবনের বাকিটা সময় সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যেই কাটাবেন বলেই এতো আয়োজন। বিদেশ যাওয়ার কিছুদিন পরেই স্বামী জোসেফের মৃত্যু। পাশে কাউকে না পেয়ে নিজের সম্বল বলতে রাজধানীর বাংলামোটরের দিলু রোডে ছয়তলা একটি বাড়ি বিক্রি করে দেন ২ কোটি টাকার বিনিময়ে। বাড়ি বিক্রির টাকা ব্যয় হয়েছে ছেলের শিক্ষা খরচে। তবে নিজের নামেও কিছু টাকা ব্যাংকে গচ্ছিত রয়েছে। সেখান থেকেই আশ্রমের খরচ চালানো হয়। ছেলে উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রেরই একটি ব্যাংকে চাকরি নিয়েছেন। মাইনেও বেশ ভালো। দেশে ফেরা অনেকটাই অনিশ্চিত। মা মিরা চৌধুরী স্মৃতিচারণ করে বলছিলেন, ‘ছেলে বাংলাদেশে আসবে এমন আশা দিনে দিনে ক্ষীণ হচ্ছে। আর আসবেই বা কেন? কীসের আশায় আসবে? বাংলাদেশে এসেই-বা কী করবে? এ দেশে তো জীবনের নিরাপত্তাও নেই।’ সংসারের ঘানি টেনে আশ্রমে এসে জীবনের থিতু আনা মিরা বলেছিলেন, ‘আর কয় দিনই-বা বাঁচব। এখন আর ছেলেকে বিরক্ত করি না। ওরও তো স্বপ্ন আছে। কষ্টেই তো আমার জীবন গড়া। অসময়ে স্বামীকে হারলাম। বাবা-মা চলে গেছেন অনেক আগে। একমাত্র ভাই, সেও চলে গেল ছয় মাস হয়। আপন বলতে আর তো কেউ নেই। কলকাতায় স্বামীর ঘরের আত্মীয়-স্বজন আছে। কে আর কার খবর রাখে। চাচাতো বোনের মেয়ে মিরপুরে থাকে। ও মাঝে মধ্যে এসে খবর নেয়। আছি তো। আশ্রমেই বেশ আছি। এএসএস/জেএইচ                

Advertisement