ধর্ম

খাদিজাতুল কুবরা সর্বপ্রথম ইসলাম গ্রহণকারী

হজরত খাদিজাতুল কুবরা রাদিয়াল্লাহু আনহা। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রথম স্ত্রী। তিনি উম্মাহাতুল মুমিনিন বা মুমিনদের মা। সর্ব প্রথম ইসলামগ গ্রহণকারীও ছিলেন তিনি। ইসলাম ও রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবনে রয়েছে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ অবদান। যার সংক্ষিপ্ত বর্ণনা তুলে ধরা হলো-জন্ম ও পরিচিতিহজরত খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা আমুল ফিল বা হস্তি বর্ষের পনের বছর পূর্বে ৫৫৫ খ্রিস্টাব্দে পবিত্র মক্কা নগরিতে জন্ম গ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন মক্কার উচ্চ শিক্ষিত ও বিখ্যাত ব্যবসায়ী খুয়াইলিদের দ্বিতীয় সন্তান। মাতার নাম ফাতিমা বিনতে যায়িদ। তাঁর কুনিয়াত ছিল ‘উম্মুল হিন্দ’ এবং উপাধি ছিল ‘তাহিরা’। মুসলিম জগতে তিনি উম্মুল মুমিনিন হজরত খাদিজাতুল কুবরা রাদিয়াল্লাহু আনহা নামে পরিচিত। তাঁর ৬ষ্ঠ পূর্ব পুরুষ ইবনে কিলাব ছিলেন মক্কার সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি ও শাসক। পিতৃ বংশের উর্ধ্ব পুরুষ কুসাঈ-এর মাধ্যমে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সঙ্গে তাঁর বংশ পরম্পরা মিলিত হয়েছে। স্বভাবতই উত্তরাধিকার সূত্রইে খাদিজা ছিলেন একজন বিত্তবান, প্রভাবশালী ও বিদুষী নারী । ছিলেন খুব সুন্দরীও। তিনি ছিলেন প্রখর ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন ও  বুদ্ধিমতী।ব্যবসায়ী খাদিজাতাঁর পিতা জীবিত থাকাকালেই তিনি পিতার ব্যবসা দেখাশুনা করতেন। যদিও তাঁর আরো দুই ভাই এবং তিন বোন ছিল তথাপিও তিনি তাঁর পিতার ব্যবসা পরিচালনার দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন।বিশ্বনবির প্রতিভায় আকৃষ্টতিনি হজরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে তাঁর ব্যবসার প্রতিনিধি হিসেবে নিয়োগ করেন। সহযোগি হিসেবে তিনি তার বিশ্বস্ত দাস মায়সারাকে বিশ্বনবির সঙ্গ প্রেরণ করলেন।বিশ্বনবি খাদিজার পণ্য-সামগ্রী নিয়ে তা বিক্রয় করে আবার মক্কার উপযোগী পণ্য ক্রয় করে মক্কায় ফিরে আসেন। সেগুলো বিক্রি করে অন্যান্য সময়ের  চেয়ে দ্বিগুণেরও বেশি মুনাফা লাভ করেন। ব্যবসায়িক সফরের আদি-অন্ত বিশ্বস্ত দাস মায়সারার কাছ থেকে জেনে বিশ্বনবির প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েন। অথচ হজরত খাদিজাকে মক্কার সম্ভ্রান্ত ও ধনী ব্যক্তিগণ বিবাহের প্রস্তাব দিলেও তিনি তা গ্রহণ করেননি। অবশেষে তিনি বিশ্বনবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ও গুণে মুগ্ধে হয়ে বিবাহের প্রস্তাব পাঠান।বিবাহহজরত খাদিজার বয়স যখন ৪০ বছর। বিশ্বনবির বয়স তখন ২৫ বছর। আল্লাহ তাআলা জাহেলি যুগের তাহিরার সঙ্গে ঐ যুগেরই সাদিক বা আলআমিনের সঙ্গে বিবাহের ব্যবস্থা করবেন। বিয়ের উভয় পক্ষের খরচও হজরত খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা বহন করেন। এবং তাঁদের উভয়ের পোশাকের জন্য দুই উকিয়া স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রা ব্যয় করেন।সন্তান জন্মদানরাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ঔরসেই তাঁর দুই ছেলে চার মেয়েসহ ছয় সন্তান জন্মগ্রহণ করেন। প্রথম সন্তান কাসিম অল্প বয়সে মক্কাতেই ইন্তেকাল করেন। তৃতীয় সন্তান আবদুল্লাহ বিশ্বনবির নবুয়ত প্রাপ্তি পর জন্ম লাভ করেন এবং অল্প বয়সেই ইন্তেকাল করেন। দ্বিতীয় সন্তান হজরত যয়নব, চতুর্থ সন্তান রুকাইয়া, পঞ্চম সন্তান উম্মু কুলসুম এবং ৬ষ্ঠ সন্তান হজরত ফাতিমা রাদিয়াল্লাহু আনহা।বিশ্বনবির খেদমতে খাদিজারাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নবুয়ত লাভ করবেন এ কথা হজরত খাদিজা পূর্বে থেকেই জানতে পেরেছিলেন। সে কারণেই বিশ্বনবির নবুয়ত লাভের পূর্বে হেরা গুহায় ধ্যনমগ্ন থাকাকালীন সময়ে তিনি বিশ্বনবিকে সর্ব প্রকার সহযোগিতা করেছেন।হজরত জিব্রিল আমিনের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতে তিনি ভয় পেলে হজরত খাদিজাই তাঁকে অভয় দিয়ে বলেছিলেন, আপনি কারো ক্ষতি করেননি, তাই কেউ আপনার ক্ষতি করবেন না। এমনকি তাঁকে মানসিকভাবে শক্তি যোগাতে তিনি তাঁর চাচাতো ভাই তাওরাতের বিশেষজ্ঞ ওরাকা বিন নওফেলের কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন।সর্ব প্রথম ইসলাম গ্রহণকারীহজরত খাদিজার বিয়ে পনের বছর বিশ্বনবি নবুয়ত লাভ করেন। নবুয়ত লাভের পর ইসলামের ইতিহাসে সর্বপ্রথম ইসলাম গ্রহণের সৌভাগ্য হয়েছিল হজরত খাদিজাতুল কুবরা রাদিয়াল্লাহু আনহার।সম্পদ ওয়াকফহজরত খাদিজাতুল কুবরা রাদিয়াল্লাহু আনহু ইসলাম গ্রহণের পর তার সকল ধন-সম্পদ তাবলিগে দ্বীনের লক্ষ্যে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে হস্তান্তর করেন।ধৈর্য ও সহনশীলতানবুয়ত লাভের পর বিশ্বনবি ব্যবসা-বাণিজ্য ছেড়ে আল্লাহ ইবাদাত এবং ইসলামের কাজে আত্মনিয়োগ করেন। সংসারের সকল আয় বন্ধ হয়ে যায়। ধৈর্য ও সহনশীলতার সঙ্গে তিনি সব প্রতিকূল অবস্থার মোকাবিলা করেন।সান্ত্বনা প্রদানইসলামের দাওয়াত মুশরিকদের প্রত্যাখ্যান ও অবিশ্বাসের কারণে বিশ্বনবি যে ব্যথা অনুভব করতেন, হজরত খাদিজার কাছে আসলে তাঁর সে ব্যথা বেদনা বিদুরিত হয়ে যেত। ইসলাম প্রচারের কাজে হজরত খাদিজা তাঁকে সান্তনা দিতেন, সাহস ও উৎসাহ যোগাতেন। এমনকি মুশরিকদের সকল নির্যাতন ও অমার্জিত আচরণ তিনি অত্যন্ত হালকা এবং তুচ্ছ বলে বিশ্বনবির কাছে তুলে ধরতেন। যাতে তিনি শান্তি ও স্বস্থি লাভ করেন।বন্দি অবস্থায় বিশ্বনবির সেবানবুয়তের সপ্তম বছর মহররম মাসে কুরাইশরা বিশ্বনবিসহ সকল মুসলমানকে বয়কট করেন। তখণ তাঁরা শিয়াবে আবু তালিবে আশ্রয় গ্রহণ করেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সঙ্গে তিনিও সেখানে অন্তরীণ হন। প্রায় তিন বছর বনু হাশিমের সবাই দুর্ভিক্ষের মাঝে অতিবাহিত করেন। স্বামীর সঙ্গে হজরত খাদিজা সে সব হাসি মুখে বরণ করে নেন।বিশ্বনবি, ইসলাম এবং মুসলমানদের এহেন দুর্দিনে হজরত খাদিজা নিজের প্রভাব খাটিয়ে মাঝে মাঝে খাদ্য-দ্রব্যের ব্যবস্থা করতেন। অমুসলিম হওয়া সত্ত্বেও হজরত খাজিদার আত্মীয়-স্বজনের মাধ্যমে তিনি খাবারের ব্যবস্থা করতেন।সর্ব প্রথম নামাজ আদায়যখন নামাজ ফরজ হওয়ার হুকুম নাজিল হয়নি, ইসলাম গ্রহণ করে তিনি বিশ্বনবির সঙ্গে প্রথম থেকেই নামাজ আদায় করেন। যা হজরত আলি রাদিয়াল্লাহু আনহু ইসলাম গ্রহণের পূর্বে দেখে ফেলেন। পিতৃকূলে ওপর প্রভাবহজরত খাদিজার ইসলাম গ্রহণ তার পিতৃকূলের ওপর বিশাল প্রভাব পড়ে। ইসলামের আর্বিভাবের সময় তাঁর বংশের ১৫ জন বিখ্যাত ব্যক্তি জীবিত ছিল। যাদের ১০ জনই ইসলাম গ্রহণ করে। বাকি পাঁচ জন বদরের যুদ্ধে কাফির অবস্থায় মৃত্যু বরণ করে।স্ত্রীদের মধ্যে শ্রেষ্ঠত্ব লাভবিশ্বনবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর জীবদ্দশায় কোনো বিয়ে করেননি। তিনি ছিলেন বিশ্বনবির প্রথম স্ত্রী। হজরত ইবরাহিম ছাড়া তাঁর সকল সন্তান হজরত খাদিজার গর্ভে জন্ম হয়। বিশ্বনবরি সকল স্ত্রীদের মধ্যে তাঁর স্থান ছিলো সর্বোচ্চ।ওফাতরাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সঙ্গে পঁচিশ বছর দাম্পত্য জীবন অতিবাহিত করার পর নবুয়তের দশ বছরের দশই রমজান ৬৫ বছর বয়সে ২৯ রজব মক্কায় ইন্তেকাল করেন। (ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। বিশ্বনবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম স্বয়ং তাঁর লাশ কবরে নামান। তাঁর মৃত্যুর সময় জানাযার নামাজের বিধান ছিল না বিধায় তাঁকে বিনা জানাযায় মক্কার জান্নাতুল মুয়াল্লায় তাঁকে দাফন করা হয়।বিশ্বনবির ভালোবাসা লাভরাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হজরত খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহাকে আমৃত্যু ভালোবেসেছিলেন। হজরত খাদিজাকে তিনি বেশি বেশি স্মরণ করতেন। যার কারণে হজরত আয়িশা রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ‘আপনি একজন বৃদ্ধার কথা মনে করছেন যিনি মারা গেছেন। জবাবে বিশ্বনবি বলেন, ‘কক্ষনো না, মানুষ যখন আমাকে মিথ্যে বলে উড়িয়ে দিতে চেয়েছে, সে তখন আমাকে সত্য বলে মেনে নিয়েছে। সবাই যখন কাফির ছিল সে তখন মুসলমান। কেউ যখন আমার সাহায্যে এগিয়ে আসেনি। তখন সে আমাকে সাহায্য করেছে। তাঁর গর্ভেই আমার সন্তান হয়েছে। হজরত খাদিজার মূল্যায়ন এর চেয়ে বেশি আর কি হতে পারে? এমনি ভাবে হজরত খাদিজার ব্যাপারে বিশ্বনবির অনেক বর্ণনা রয়েছে।আল্লাহ তাআলা হজরত খাদিজাকে জান্নাতের সর্বোচ্চ মর্যাদা দান করুন। সমগ্র বিশ্বের মুসলিম নারীদেরকে তাঁর আমল-আখলাক অর্জন করার স্বামী খেদমতে তাঁকে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করার তাওফিক দান করুন। আমিন।এমএমএস/এবিএস

Advertisement