অর্থনীতি

সারা বাংলাদেশে ‘উইমেন শাটল’ চালু করতে চাই

• ঢাকার যানজট সহনীয়তার সব সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে• গণপরিবহনে যাতায়াতে সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে নারীরা• নারীদের জন্য নেই বিশেষ সার্ভিসের ব্যবস্থা

Advertisement

তাসনিয়া আতিক, একজন নারী উদ্যোক্তা। গত আট বছর ধরে নারীদের ক্ষমতায়ন নিয়ে কাজ করছেন। তারই অংশ হিসেবে কর্মজীবী নারী ও নারী শিক্ষার্থীদের যাতায়াত সহজ করতে আগামী নভেম্বর মাস থেকে ‘উইমেন শাটল’ নামে একটি সেবা চালু করতে যাচ্ছেন। নতুন উদ্যোগ ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা বিষয়ে একান্ত সাক্ষাৎকারে কথা বলেছেন জাগো নিউজের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জাগো নিউজের নিজস্ব প্রতিবেদক সামিউর রহমান সাজ্জাদ।

জাগো নিউজ : শুরু থেকে শুরু করি। নারীদের জন্য আলাদা শাটল বাসের আইডিয়া কিভাবে এলো? কেমন সাড়া পাচ্ছেন?

তাসনিয়া : আমি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিলাম তখন থাকতাম মিরপুর ডিওএইচএসে। আমার ক্যাম্পাস ছিল বসুন্ধরায়। বাসায় নিজস্ব গাড়ি থাকা সত্ত্বেও প্রত্যেকের গন্তব্য ভিন্ন পথে হওয়ায় প্রায়ই আমাকে ভেঙে ভেঙে ক্যাম্পাসে যেতে হতো। এতে প্রতিদিনের যাতায়াত খরচ অনেক বেড়ে যেতো। তার চেয়েও বড় কথা ঝামেলা হতো অনেক।

Advertisement

সেই থেকে মূলত আমার কাজের শুরু। এছাড়া এখন তো ঢাকা শহরে যাতায়াতের অনেক বিকল্প ব্যবস্থা আছে। যেমন- উবার, পাঠাও ইত্যাদি। কিন্তু অফিস টাইমে এসব রাইড শেয়ারিংয়ের ভাড়া প্রায় দেড় থেকে দুই গুণ বেড়ে যায়।

আরও পড়ুন

ঘোষণা ছাড়াই বন্ধ নগর পরিবহন, যাত্রীদের ভোগান্তি মেট্রোরেলে প্রতিদিন যাতায়াত করছেন তিন লাখ মানুষ সড়কে নিয়ম ভাঙার মহোৎসব, ট্রাফিক পুলিশকে ‘থোড়াই কেয়ার’

এসব বিষয় বিবেচনা করে আমি নারীদের জন্য একটু আরামদায়ক, এসি সার্ভিস দেওয়ার কথা চিন্তা করছিলাম। কারণ, নারীদের নানা রকম সীমাবদ্ধতা থাকে। অনেকে গর্ভবতী থাকেন, শারীরিক জটিলতা থাকে। এটা মানতেই হবে যে নারীরা শারীরিকভাবে পুরুষের তুলনায় একটু দুর্বল।

আমার ক্যাম্পাস ছিল বসুন্ধরায়। বাসায় নিজস্ব গাড়ি থাকা সত্ত্বেও প্রত্যেকের গন্তব্য ভিন্ন পথে হওয়ায় প্রায়ই আমাকে ভেঙে ভেঙে ক্যাম্পাসে যেতে হতো। এতে যাতায়াত খরচ যেমন বেড়ে যেতো, ঝামেলাও হতো অনেক

Advertisement

‘উইমেন শাটল’ নিয়ে কাজ শুরুর পর এক কথায় অভাবনীয় সাড়া পাচ্ছি। আমাদের ফেসবুক পেজ খোলার তিনদিনের মধ্যে প্রায় পাঁচ হাজার মানুষের মেসেজ রিকোয়েস্ট পেয়েছিলাম।

জাগো নিউজ : বর্তমানে কোন কোন রুটে আপনাদের কার্যক্রম চালু আছে? ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?

তাসনিয়া : আমরা ১২টি রুট নিয়ে কাজ করছি। এর মধ্যে বর্তমানে উত্তরা, বসুন্ধরা, মিরপুর, মোহাম্মদপুর, ধানমন্ডি এই পাঁচটি জায়গায় পরিকল্পনা আছে। যা আগামী ১ নভেম্বর থেকে চালু হবে।

ঢাকায় মেট্রোরেল চললেও কমেনি যানজটের ভোগান্তি

আমাদের দুই ধরনের প্যাকেজ চালু আছে। তার একটি কর্মজীবী নারীদের জন্য প্রিমিয়াম প্যাকেজ, আর অন্যটি হচ্ছে নারী শিক্ষার্থীদের জন্য স্টুডেন্ট প্যাকেজ। আমাদের পিক এবং ড্রপ দুটি সুবিধাই আছে। প্রিমিয়াম প্যাকেজে প্রতি ট্রিপে একমুখী যাত্রা ২০০ টাকা এবং উভয়মুখী অর্থাৎ যাওয়া-আসা ৪০০ টাকা। ন্যূনতম ২০ দিনের সাবস্ক্রিপশন করতে হবে।

আমাদের একটি মোবাইল অ্যাপ তৈরির পরিকল্পনা আছে। আপাতত আমরা আমাদের ফেসবুক পেজের মাধ্যমে কার্যক্রম পরিচালনা করছি। আমাদের ছয়টি কোস্টার বাস এরই মধ্যে বুকিং ফুল হয়ে গিয়েছে এবং আমরা আরও ৬টি বাস যুক্ত করছি।

প্রতিটি বাসে একজন নারী নিরাপত্তাকর্মী, সার্বক্ষণিক নিরাপত্তার জন্য আইপি ক্যামেরা, অগ্নি নির্বাপক যন্ত্র, স্যানিটারি ন্যাপকিনসহ বিশেষ সুবিধা থাকবে।

‘উইমেন শাটল’ নিয়ে কাজ শুরুর পর এক কথায় অভাবনীয় সাড়া পাচ্ছি। আমাদের ফেসবুক পেজ খোলার তিনদিনের মধ্যে প্রায় পাঁচ হাজার মানুষের মেসেজ রিকোয়েস্ট পেয়েছিলাম

আস্তে আস্তে ঢাকার সব রুটেই আমরা শুধু নারীদের জন্য নিরাপদ পরিবহন নিয়ে আসবো। শুরুর দিকে পুরো ঢাকা শহর এবং পরবর্তী সময়ে সারা বাংলাদেশে যেখানে যেখানে প্রয়োজন হবে আমরা এ সেবা চালু করতে চাই।

জাগো নিউজ : বিআরটিসির নারী বাস সার্ভিসের সঙ্গে আপনাদের উদ্যোগের পার্থক্য কী?

তাসনিয়া : এটিকে (আমাদের উদ্যোগকে) গণপরিবহনের সঙ্গে তুলনা করাটা ঠিক হবে না। বিআরটিসির সার্ভিস রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে। আর আমাদের উদ্যোগটা আসলে প্রাইভেট সার্ভিস, কোনো গণপরিবহন নয়। মানুষজন এটি তুলনা করছে, কিন্তু আমি কখনো সেভাবে চিন্তা করিনি।

আমাদের এটি কোনো বাস সার্ভিস না। তাছাড়া আমি নন-এসি নিয়ে কাজ করতে চাই না। কারণ, ঢাকা শহরে বর্তমানে তাপমাত্রার যে অবস্থা তাতে নারীদের জন্য নন-এসি সার্ভিস কোনোভাবেই টেকসই হবে না।

যানজটে জনদুর্ভোগের এমন চিত্র প্রতিদিনের

আমি আসলে খুব ছোট পরিসরে শুরু করতে চেয়েছিলাম। প্রথমে আমি সাত সিটের গাড়ি নিয়ে মিরপুর-বসুন্ধরা রুটে শুরু করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু পরে দেখলাম চাহিদা অনেক বেশি, সবাই অনুরোধ করছিলেন পরিসর আরেকটু বাড়ানোর জন্য। আমিও চেষ্টা করছি এবং করবো।

আমরা প্রাথমিকভাবে ৩০০-৫০০ জনকে সেবা দেওয়ার লক্ষ্যে কাজ করছি। এরপর আমাদের ১৫০০-৩০০০ পর্যন্ত যাওয়ার ইচ্ছা আছে।

জাগো নিউজ : বিদ্যমান মূল্য কাঠামো বা প্যাকেজ চার্জ নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে যেসব সমালোচনা হচ্ছে সেগুলোকে কীভাবে দেখেন?

তাসনিয়া : মূলত যে কোনো কাজই ছোট করে শুরু করতে গেলে খরচটা বেশি হয়ে থাকে। যখন অনেক মানুষ আমাদের সেবা নেবেন তখন খরচও কমে আসবে এবং কাজও সহজ হয়ে যাবে। যখন আরও বেশি মানুষকে এ সেবায় সম্পৃক্ত করতে পারবো তখন আরও সাশ্রয়ী প্যাকেজ নিয়ে আসতে পারবো।

নানা মানুষ নানা কথা বলবে। তাই আমরা তাড়াহুড়ো করে নারী শিক্ষার্থীদের জন্য আলাদা প্যাকেজ চালু করে দিয়েছি, যেটা নিয়ে শুরুতে পরিকল্পনা ছিল না। কিন্তু তারপরও আমরা সেটা করেছি, যেন মানুষ আমাদের প্রতি ভরসা রাখতে পারে।

নারী উদ্যোক্তা তাসনিয়া আতিক

জাগো নিউজ : ১৫ অক্টোবর আপনারা নারী শিক্ষার্থীদের জন্য নতুন প্যাকেজ চালু করার ঘোষণা দিয়েছেন। এ সম্পর্কে যদি বলেন...।

তাসনিয়া : শুধু যাদের স্টুডেন্ট আইডি কার্ড আছে তাদের জন্য এই প্যাকেজ প্রযোজ্য। নারী শিক্ষার্থীদের জন্য প্রতি ট্রিপে একমুখী যাত্রা ১৫০ টাকা এবং উভয়মুখী ৩০০ টাকা। এটি বসুন্ধরা, আফতাবনগর/বাড্ডা, বনানী/গুলশান, উত্তরা এবং মিরপুর এই পাঁচটি রুটে চালু হচ্ছে।

আরও পড়ুন

ভয়াবহ যানজটে নাকাল নগরবাসী, কোন পথে ঢাকা? শাহজালাল বিমানবন্দরে চালু হলো শাটল বাস সার্ভিস যানজটে নাকাল ঢাকা, বাড়ছে শারীরিক-মানসিক ভোগান্তি

নারী শিক্ষার্থীদের জন্য আমাদের যে প্যাকেজটি আছে সেটি আগামী জানুয়ারিতে চালু করার পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু পাবলিক ডিমান্ডের কারণে আমরা এটিও নভেম্বরের ১ তারিখ থেকে শুরু করছি। এক মাসে ন্যূনতম ১৬ দিনের সাবস্ক্রিপশন করতে হবে।

জাগো নিউজ : এ উদ্যোগ কি আপনার একক অর্থায়নে নাকি কোনো সংস্থার অংশীদারত্ব আছে?

তাসনিয়া : প্রাথমিকভাবে আমরা অল্প কিছু টাকা নিয়ে শুরু করেছি। আমরা মূলত ক্রাউডফান্ডিং করেছি। পরিচিত কাছের কয়েকজন মিলে অর্থায়ন করেছি এবং কাজটি শুরু করেছি। যদিও এটি সম্মিলিত উদ্যোগ, কিন্তু ব্যবসাটা আমার একার।

কর্মজীবী নারীদের জন্য প্রিমিয়াম প্যাকেজ, নারী শিক্ষার্থীদের জন্য স্টুডেন্ট প্যাকেজ। পিক এবং ড্রপ দুটি সুবিধাই থাকছে। প্রিমিয়াম প্যাকেজে প্রতি ট্রিপে একমুখী যাত্রা ২০০ টাকা এবং উভয়মুখী অর্থাৎ যাওয়া-আসা ৪০০ টাকা। ন্যূনতম ২০ দিনের সাবস্ক্রিপশন করতে হবে

আমরা খুব দ্রুতই আমাদের এ উদ্যোগকে আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীদের কাছে নিয়ে যেতে চাই। আমরা এরই মধ্যে বিভিন্ন জায়গায় বিষয়টি উত্থাপন করছি। কারণ, সারাদেশে এ সেবা পৌঁছাতে চাইলে অবশ্যই আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ প্রয়োজন। এ নিয়ে আমরা কাজ করছি।

ঢাকায় মেট্রোরেলের শাটল বাস

আমি বিনিয়োগকারীদের আহ্বান জানাতে চাই যেন তারা এ উদ্যোগে বিনিয়োগ করেন। কারণ, একার পক্ষে এর পরিসর অনেক বেশি বিস্তৃত করা সম্ভব নয়। এ কাজে আরও মানুষের সহযোগিতা দরকার। সেটি হলে তবেই আমরা আরও ব্যাপকভাবে সার্ভিসটি ছড়িয়ে দিতে পারবো।

জাগো নিউজ : দিন দিন সমাজের সব ক্ষেত্রে নারীদের সম্পৃক্ততা বাড়ছে। নারীর ক্ষমতায়নে আর কী কী করা উচিত বলে মনে করেন?

তাসনিয়া : আমি গত আট বছর ধরে শুধু নারীদের নিয়ে কাজ করছি এবং নারীদের নিয়েই কাজ করতে চাই, যতটুকু আমার পক্ষে করা সম্ভব।

আমাদের সবার আগে নারীর মৌলিক অধিকার নিয়ে কাজ করা উচিত। খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা এই পাঁচটি মৌলিক অধিকারের পাশাপাশি যাতায়াতও একটি অন্যতম অপরিহার্য বিষয়। নারীর উন্নয়নে সবার আগে এ বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করতে হবে বলে আমি মনে করি।

এসআরএস/এমকেআর/এমএস