স্টোরেজ, পরিবহন এবং পণ্য প্রক্রিয়াকরণ পর্যায়ে উৎপাদন খরচ কমানো গেলে দামও কমে আসবে বলে জানিয়েছেন খাত সংশ্লিষ্টরা।
Advertisement
তারা বলেন, পণ্যের দামের ক্ষেত্রে উৎপাদন খরচের ক্রমাগত উচ্চ মূল্য, অদক্ষ বাজার ব্যবস্থা, পণ্য পরিবহনে বাড়তি খরচ ও বাজার আধিপত্য প্রভাব ফেলে। এছাড়া উৎপাদনকারীদের খুচরা বাজারে প্রবেশাধিকারের সুযোগ কম। এসব কারণে আমাদের স্থানীয় বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্যের ওপর প্রভাব ফেলছে।
বৃহস্পতিবার (১৭ অক্টোবর) রাজধানীর ঢাকা চেম্বারে আয়োজিত ‘খাদ্য মূল্যস্ফীতি; নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য নির্ধারণে গতি-প্রকৃতি বিশ্লেষণ’ শীর্ষক সেমিনারে এসব মত উঠে আসে।
আলোচনায় অংশ নেন বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ড. সায়েরা ইউনুস, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ট্রেড সাপোর্ট মেজারস উইংয়ের যুগ্ম-সচিব ড. সাইফ উদ্দিন আহম্মদ, বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারফি কমিশনের যুগ্ম প্রধান মো. মশিউল আলম, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর উপ-পরিচালক (সেনসাস উইং) স্বজন হায়দার প্রমুখ।
Advertisement
ঢাকা চেম্বারের সভাপতি আশরাফ আহমেদ বলেন, উৎপাদক থেকে ভোক্তা পর্যায়ে দাম বাড়লেও উৎপাদকরা ন্যায্য দাম পান না। কখনো কখনো দাম বাড়ানোর জন্য পরোক্ষ খরচ জড়িত হয়। আমরা যদি স্টোরেজ, পরিবহন এবং পণ্য প্রক্রিয়াকরণ পর্যায়ে উৎপাদন খরচ কমাতে পারি, তাহলে দাম তুলনামূলক কমে আসবে।
পচনশীল পণ্যের অপচয়ের বিষয়টি উল্লেখ করে তিনি বলেন, শুধুমাত্র প্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে এই বিশাল ক্ষতি রোধের জন্য একটি ভালো সমাধান হতে পারে। এছাড়াও একটি নিখুঁত নীতিগত সিদ্ধান্তের জন্য যথাযথ সরবরাহ এবং চাহিদা ভিত্তিক তথ্যপ্রাপ্তি, তথ্য বিশ্লেষণ এবং মূল্যায়নের গুরুত্বের ওপর জোর দেন। তিনি একটি ট্যারিফ ক্যালেন্ডার প্রণয়নের প্রস্তাবনা পেশ করেন। এর মাধ্যমে দেশীয় মৌসুম ছাড়াও পূর্বঘোষিত সময়সীমা অনুসারে আমদানি শুল্ক হ্রাস অথবা বৃদ্ধি করা যেতে পারে।
ঢাকা চেম্বারের নির্বাহী সচিব (গবেষণা) এ কে এম আসাদুজ্জান পাটোয়ারী অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। তিনি বলেন, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির পেছনে উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি, কম সরবরাহ, অদক্ষ বাজার ব্যবস্থা, উচ্চ পরিবহন খরচ এবং বাজারের আধিপত্য, সীমিত দর কষাকষির ক্ষমতা এই গবেষণায় উঠে এসেছে। কৃত্রিম সংকট, এলসি খোলার সমস্যা, মৌসুমি পণ্যের মূল্যের তারতম্য, টাকার অবমূল্যায়ন, সরবরাহ চেইনের অদক্ষতা, অপর্যাপ্ত স্টোরেজ সুবিধা এবং উৎপাদকদের সীমিত বাজারে প্রবেশাধিকার প্রভৃতি পণ্যের মূল্য ওঠানামার জন্য দায়ী। বর্তমান খাদ্য মূল্যস্ফীতির প্রধান কারণ প্রয়োজনীয় পণ্যের চাহিদা, উৎপাদন ও আমদানির মধ্যে সমন্বয়ের অভাব।
আরও পড়ুন যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক রপ্তানিতে প্রতিপক্ষের কাছে হেরেছে বাংলাদেশ সয়াবিন ও পাম তেলে ভ্যাট ছাড়এ কে এম আসাদুজ্জান পাটোয়ারী বলেন, অদক্ষ বাজার ব্যবস্থা এবং তথ্যের অসামঞ্জস্যতা, স্থানীয় উৎপাদন হ্রাস এবং উচ্চ পরিবহন খরচ, কীটনাশকসহ সার-বীজ-তেল এবং ওষুধের উচ্চমূল্য এক্ষেত্রে ভূমিকা রাখছে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য কার্যকর সুনির্দিষ্ট তথ্যভিত্তিক গবেষণা পরিচালনার সুপারিশ করা হয়েছে, যেন সরকার কার্যকর সিদ্ধান্ত গ্রহণে সক্ষম হয়। খাদ্যপণ্য সময়মতো সরবরাহ নিশ্চিত করতে আরও ভালো পরিবহন ব্যবস্থা উন্নয়নে বিনিয়োগ বাড়ানো, পণ্যের অপচয় রোধে আরও স্টোরেজ সুবিধা সম্প্রসারণের ওপর জোরারোপ করা হয়।
Advertisement
ড. সায়েরা ইউনুস বলেন, শুধুমাত্র মুদ্রানীতি দিয়ে পণ্যের মূল্য কমানো সম্ভব নয়। এজন্য সরকারকে প্রান্তিক পর্যায়ে পর্যবেক্ষণ কার্যক্রম জোরদার করতে হবে।
তিনি বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রায় ৯ বার পলিসি রেট পরিবর্তন করলেও বাজারে এর প্রভাব তেমন উল্লেখযোগ্য নয়। তিনি উল্লেখ করেন, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির পেছনে আমদানির বিষয়টিও অত্যন্ত জরুরি। কারণ কোভিড পরবর্তী সময়ে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং সাম্প্রতিক সময়ে মধ্যপ্রাচ্যে অস্থিতিশীল পরিস্থিতির কারণে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে সাপ্লাই চেইন মারাত্মক ব্যাহত হচ্ছে। যার প্রভাব পড়ছে আমাদের স্থানীয় পণ্য উৎপাদন ও সামগ্রিক অর্থনীতিতে।
যুগ্ম-সচিব ড. সাইফ উদ্দিন আহম্মদ বলেন, আমাদের বাৎসরিক পণ্য ভিত্তিক কোনো প্রডাক্ট ক্যালেন্ডার নেই, তবে পরিসংখ্যান ভিত্তিক এ ধরনের থাকলে সরকারের পক্ষে পণ্য আমদানি শুল্কায়নসহ অন্যান্য সিদ্ধান্ত গ্রহণ অনেক সহজ হতো। তিনি উল্লেখ করেন, প্রতিবছর আমাদের আবাদি জমি এক শতাংশ হারে কমছে, ফলে কৃষিভিত্তিক পণ্য উৎপাদন ক্রমাগত হারে কমে যাচ্ছে। এ কারণে আমদানি নির্ভরতা বাড়ছে।
তিনি বলেন, বতর্মানে কৃষিখাতে আমাদের ভর্তুকি ৪ থেকে ৫ শতাংশ। যেটিকে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো ১০ শতাংশে উন্নীত করা সম্ভব হলে স্থানীয় উৎপাদনশীলতা আরও বাড়বে। এছাড়াও তিনি ক্রস বর্ডার বাণিজ্য প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন আনা, আমদানি খরচ কমানো, বন্ডেড ওয়্যারহাউজ সুবিধা সম্প্রসারণ, ব্যাক-টু-ব্যাক এলসি সুবিধা বাড়ানো প্রভৃতির ওপর জোরারোপ করেন।
বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের যুগ্ম প্রধান মো. মশিউল আলম বলেন, স্থানীয়ভাবে উৎপাদন ও আমদানির মাধ্যমে আমরা পণ্যের চাহিদা মিটিয়ে থাকি। তবে সিজিওন্যাল ট্যারিফ অথবা ট্যারিফ ক্যালেন্ডার প্রবর্তনের বিষয়টি সক্রিয়ভাবে চিন্তা করা যেতে পারে। যার মাধ্যমে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত পণ্যের মৌসুমে শুল্ক কমানো বা বাড়ানো যেতে পারে। ফলে আমাদের উৎপাদকরা যেমন উপকৃত হবেন, সেই সঙ্গে পণ্য আমদানি প্রক্রিয়াও সহজতর করা সম্ভব।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর উপ-পরিচালক (সেনসাস উইং) স্বজন হায়দার বলেন, আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী পরিসংখ্যান ব্যুরো মূল্যস্ফীতি নির্ধারণে দেশব্যাপী ৩৪২টি পণ্যের তথ্য সংগ্রহ করে থাকে। এক্ষেত্রে পণ্যের সরবরাহ ও দামের মধ্যে একটি কার্যকর যোগসাজশের বিষয়টি তীব্রভাবে প্রতীয়মান।
ইএআর/কেএসআর/জিকেএস