বাংলাদেশি পোশাক পণ্যের একক বৃহত্তম রপ্তানি গন্তব্য হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। তবে সাম্প্রতিক মাসে সেখানে রপ্তানিতে প্রতিযোগীদের থেকে পিছিয়ে পড়েছে বাংলাদেশ। রপ্তানিকারকরা প্রতিদ্বন্দ্বীদের কাছে বাজারের শেয়ার হারাচ্ছেন। প্রতিযোগী দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশের রপ্তানি আয় কম এবং নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি অন্যদের চেয়ে বেশি। এটি রপ্তানিকারকদের কাছে উদ্বেগের বিষয়। একদিকে রপ্তানিকারকরা বাজার হারাচ্ছেন, অন্যরা আমাদের রপ্তানিকারকদের কাছ থেকে কাজের আদেশ নিয়ে নিচ্ছে।
Advertisement
রপ্তানি আয়ের নেতিবাচক ধারা থেকে বের হয়ে আসতে অর্থনীতিবিদ ও বাণিজ্য বিশ্লেষকরা অবিলম্বে রপ্তানি আয় হ্রাসের পেছনের কারণগুলো চিহ্নিত করার আহ্বান জানিয়েছেন। যেখানে রপ্তানি আয় বৃদ্ধি হওয়ার কথা, সেখানে যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি পোশাক রপ্তানির পরিমাণ ক্রমাগত কমছে।
‘রপ্তানিকারকদের জন্য আরেকটি উদ্বেগের বিষয় হলো সাম্প্রতিক শ্রমিক অসন্তোষ, যা ক্রেতাদের আস্থা নষ্ট করেছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ না করা হলে আমরা স্থায়ীভাবে কাজের আদেশ হারাবো।’-বিকেএমইএ সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম
ইউএস ডিপার্টমেন্ট অব কমার্সের অফিস অব টেক্সটাইলস অ্যান্ড অ্যাপারেলসের (ওটেক্সা) তথ্য অনুসারে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট মাসে যুক্তরাষ্ট্রের সামগ্রিক পোশাক আমদানিতে ৪ শতাংশ নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি হয়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশের রপ্তানি ৯ দশমিক ১৭ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। আয় হয়েছে ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার, যা আগের বছর একই সময়ে ছিল ৫ দশমিক ১৮ বিলিয়ন ডলার।
Advertisement
যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক রপ্তানিতে শীর্ষ ১০টি দেশের মধ্যে পাকিস্তান ও কম্বোডিয়া যথাক্রমে ১ দশমিক ১৫ শতাংশ ও ৩ দশমিক ৩৯ শতাংশ ইতিবাচক বৃদ্ধি অর্জন করেছে। মেক্সিকোর রপ্তানি সর্বোচ্চ ১০ দশমিক ৪৯ শতাংশ কমেছে এবং আয় করেছে ১ দশমিক ৪৭ বিলিয়ন ডলার, যা আগের বছরে ছিল ১ দশমিক ৯৫ বিলিয়ন।
আরও পড়ুন শ্রমিক অসন্তোষ পোশাকখাত ধ্বংসের চক্রান্ত, কলকাঠি নাড়ছে তৃতীয় পক্ষ যে কারণে থামছে না পোশাক খাতের শ্রমিক অসন্তোষ নিরাপত্তা নিশ্চিত না করলে পোশাক কারখানা খুলবেন না মালিকরামার্কিন বাজারে সবচেয়ে বড় পোশাক রপ্তানিকারক চীন ২ দশমিক ৭ শতাংশ নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি দেখেছে। তারা চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট মাসে ১০ দশমিক ৬৯ বিলিয়ন ডলার আয় করেছে, যেখানে দ্বিতীয় বৃহত্তম রপ্তানিকারক ভিয়েতনাম ১ দশমিক ০৩ শতাংশ নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি রেকর্ড করেছে। এটি শীর্ষ রপ্তানিকারকদের মধ্যে সবচেয়ে কম। ভিয়েতনাম আয় করেছে ৯ দশমিক ৫৫ বিলিয়ন ডলার, যা গত বছরের একই সময়ে ছিল ৯ দশমিক ৬৫ বিলিয়ন ডলার।
বাংলাদেশের নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ইন্দোনেশিয়া ও ভারত যথাক্রমে আয় করেছে ২ দশমিক ৬৮ বিলিয়ন ও ৩ দশমিক ৩১ বিলিয়ন ডলার, যা গত বছরের তুলনায় ৭ দশমিক ১৩ শতাংশ ও ১ দশমিক ৫০ শতাংশ কম।
যুক্তরাষ্ট্রের পোশাকের বাজারে চীনের দখলে আছে ২০ দশমিক ৮৩ শতাংশ, ভিয়েতনামের ১৮ দশমিক ৬২ শতাংশ, বাংলাদেশের ৯ দশমিক ১৮ শতাংশ, ভারতের ৬ দশমিক ২ শতাংশ এবং ৫ দশমিক ২৩ শতাংশ ইন্দোনেশিয়ার।
Advertisement
মার্কিন অর্থনীতি এখনও কোভিডের ধাক্কা থেকে পুনরুদ্ধার করতে পারেনি এবং অর্থনৈতিক মন্দা গ্রাহকদের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস করেছে। ফলে পোশাকের চাহিদা এখনও বাড়েনি। অন্যদিকে, চলতি বছরের জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচন কেন্দ্র করে রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে বাংলাদেশ কাজের আদেশ কম পেয়েছে। এর পাশাপাশি, জুলাই ও আগস্টে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ফলে পণ্যের উৎপাদন ও চালান উভয় ক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
‘এই মুহূর্তে সরকারকে ব্যবসায়ী সম্প্রদায় এবং দেশবাসীর জন্য পূর্ণ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। অন্যদিকে কর্মী অসন্তোষ যাতে না ঘটে সেজন্য খুব সতর্ক থাকতে হবে। তবে শ্রমিকদের যৌক্তিক দাবি সুরাহা করতে হবে এবং যথাযথভাবে বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে।’- অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে নেতিবাচক রপ্তানি আয়ের পেছনে এই কারণগুলো হতে পারে বলে মনে করছেন রপ্তানিকারক ও বিশেষজ্ঞরা।
আরও পড়ুন ২০২৩-২৪ অর্থবছরে রপ্তানি আয় কমেছে ০.৪৯ শতাংশ শ্রমিকদের ১৮ দাবি মেনে নিলো মালিকপক্ষ, বুধবার খুলবে সব কারখানা ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোতে অস্থিরতার নেপথ্যেবাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম জাগো নিউজকে বলেন, ‘জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে রাজনৈতিক উত্তরণ নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ায় বেশিরভাগ মার্কিন ক্রেতা কাজের আদেশ দিতে দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন। ফলস্বরূপ, আমরা পর্যাপ্ত কাজের আদেশ পাইনি। এতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে রপ্তানি আয়ের প্রবণতা কমেছে। অন্যদিকে, সাম্প্রতিক শিক্ষার্থীদের আন্দোলনও পণ্য উৎপাদনে আঘাত হানে এবং আমরা সময় মতো পণ্য পাঠাতে সমস্যায় পড়ে যাই।’
‘রপ্তানিকারকদের জন্য আরেকটি উদ্বেগের বিষয় হলো সাম্প্রতিক শ্রমিক অসন্তোষ, যা ক্রেতাদের আস্থা নষ্ট করেছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ না করা হলে আমরা স্থায়ীভাবে কাজের আদেশ হারাবো।’ যোগ করেন হাতেম।
কীভাবে ক্রেতাদের আস্থা ফিরিয়ে আনা যায়সাম্প্রতিক সময়ে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় দেশ চরম সংকটে পড়েছে। এতে দেশের ব্যবসায়িক পরিবেশে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।
আরও পড়ুন অচেনা শ্রমিক অসন্তোষ তৈরি পোশাক শিল্পে! কারখানাকেন্দ্রিক আধিপত্যের লড়াই, ব্যাহত হচ্ছে উৎপাদন চলমান সংকট উত্তরণে ২ হাজার কোটি টাকা ঋণ চায় বিজিএমইএবিনিয়োগকারী ও ক্রেতাদের আস্থা ফিরিয়ে আনতে সরকারকে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি করতে হবে এবং তা বজায় রাখতে হবে। তবে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর অন্তর্বর্তী সরকার ব্যাংকখাতে রক্তপাত বন্ধ করতে সক্ষম হয়েছে।
‘সব পক্ষের উদ্যোগে কিছুটা হলেও অস্থিরতার অবসান হয়েছে। শ্রমিকদের সব দাবি ইতিমধ্যে কমবেশি সমাধান করা হয়েছে। আমরা সব সমস্যা সমাধানের জন্য সরকার এবং ট্রেড ইউনিয়নের সঙ্গে কাজ করছি। এখন সরকারের কাছে আমাদের আহ্বান শিল্পাঞ্চলে পূর্ণ নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং দেশে স্থিতিশীলতা আনা।’ -বিজিএমইএ সভাপতি খোন্দকার রফিকুল ইসলাম
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংক সমস্যায় জর্জরিত ব্যাংক নিয়ে কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে ও বোর্ড পুনর্গঠন করেছে, যা রপ্তানিকারক ও আমদানিকারকদের সহজ করবে।’
‘এই মুহূর্তে, সরকারকে ব্যবসায়ী সম্প্রদায় এবং দেশবাসীর জন্য পূর্ণ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। অন্যদিকে, কর্মী অসন্তোষ যাতে না ঘটে সেজন্য খুব সতর্ক থাকতে হবে। তবে শ্রমিকদের যৌক্তিক দাবির প্রতি সুরাহা করতে হবে এবং যথাযথভাবে বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে।’ বলছিলেন ড. জাহিদ হোসেন।
বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) সভাপতি খোন্দকার রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘সব পক্ষের উদ্যোগে কিছুটা হলেও অস্থিরতার অবসান হয়েছে। শ্রমিকদের সব দাবি ইতিমধ্যে কমবেশি সমাধান করা হয়েছে। আমরা সব সমস্যা সমাধানের জন্য সরকার এবং ট্রেড ইউনিয়নের সঙ্গে কাজ করছি।’
আরও পড়ুন দলীয়করণে ব্যবসায়ী সংগঠনে অস্থিরতা, প্রয়োজন সংস্কার এলসি খোলায় নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার চায় বিজিএমইএ জুলাইয়ে পোশাক রপ্তানি বেড়েছে ২.৮৮ শতাংশ‘এখন সরকারের কাছে আমাদের আহ্বান শিল্পাঞ্চলে পূর্ণ নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং দেশে স্থিতিশীলতা আনা।’
বিজিএমইএ সভাপতি দুষ্কৃতকারীদের নাশকতা এড়াতে পর্যাপ্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মোতায়েন করার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
আইএইচও/এমএমএআর/এএসএম