শুরুতে করেছেন বামপন্থি রাজনীতি। পরবর্তী সময়ে যোগ দেন আওয়ামী লীগে। দলটির সংসদ সদস্য হয়ে শ্বশুরবাড়ির শেরপুর-২ (নকলা-নালিতাবাড়ী) আসনে দাপুটে রাজনীতি করেছেন বেগম মতিয়া চৌধুরী।
Advertisement
ছিলেন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য। কৃষিমন্ত্রীর দায়িত্ব পেয়েছেন দুইবার। শেষ মেয়াদে সংসদ উপনেতার দায়িত্ব পালন করেন বর্ষীয়ান এই রাজনীতিক।
১৯৪২ সালের ৩০ জুন পিরোজপুরে জন্মগ্রহণ করেন মতিয়া চৌধুরী। তার বাবা মহিউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী ছিলেন পুলিশ কর্মকর্তা। মা নুরজাহান বেগম ছিলেন গৃহিণী।
আশির দশকে আওয়ামী লীগে যোগ দেন মতিয়া চৌধুরী। পরবর্তী সময়ে সব আন্দোলন-সংগ্রামে জোরালো ভূমিকায় দেখা গেছে তাকে। তার আগে ঢাকার ইডেন কলেজে পড়ার সময় ছাত্ররাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন তিনি।
Advertisement
১৯৬১-৬২ সালে ইডেন কলেজে ভিপি এবং ১৯৬৩-৬৪ সালে ডাকসু জিএস নির্বাচিত হন মতিয়া চৌধুরী। বাম রাজনীতির ধারাবাহিকতায় ১৯৬৫ সালে সেসময়ের পূর্ব পাকিস্তানের সর্ব বৃহৎ ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৬৬ সালে শেখ মুজিবের ৬ দফা সমর্থনে তার জোরালো ভূমিকা ছিল।
পাকিস্তানের সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে ‘আপত্তিকর’ বক্তৃতা দেওয়ার অপরাধে মতিয়া চৌধুরী গ্রেফতারও হয়েছিলেন। ময়মনসিংহের জেলখানায় রাজনৈতিক বন্দি হিসেবে তাকে আটকে রাখা হয়। মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদানের জন্য ২০২১ সালে বাংলা একাডেমি তাকে সম্মানসূচক ফেলোশিপ প্রদান করা হয়।
রাজনৈতিক জীবনে ১৫ বার গ্রেফতার হয়েছেন মতিয়া চৌধুরী। এরমধ্যে আইয়ুব শাসনামলে পরপর চারবার জেলে যেতে হয়েছে তাকে। শেষ দুই বছর টানা জেলেই থাকতে হয়েছে। ১৯৬৯ সালে অভ্যুত্থানের মাধ্যমে জাতি স্বৈরশাসকের কবল থেকে মুক্তি পেলে তিনিও মুক্তি পান।
আরও পড়ুন: বর্ষীয়ান রাজনীতিক মতিয়া চৌধুরী মারা গেছেন১৯৭৫ সালের পর প্রাণনাশের হুমকিতে বেশ কয়েক মাস কাটিয়েছেন আত্মগোপনে। জিয়াউর রহমানের আমলে আবারও জেলে যেতে হয়েছে। টানা পাঁচ মাস কারাগারেই কাটান। এরশাদ সরকারের আমলে ৯ বার যেতে হয়েছে কারাগারে। ১৯৯১ সালে খালেদা জিয়া ক্ষমতাসীন হওয়ার পর আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের সঙ্গে মতিয়া চৌধুরীকেও জেলে যেতে হয়।
Advertisement
ব্যক্তিজীবনে ১৯৬৪ সালের ১৮ জুন প্রয়াত সাংবাদিক ও দৈনিক সংবাদের সম্পাদক বজলুর রহমানের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন মতিয়া চৌধুরী। বরিশালে গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন করার সময় মতিয়ার ছোট মামার মাধ্যমে বজলুর রহমানের সঙ্গে পরিচয় হন। দুজনই বাম রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। প্রেমের পর পারিবারিকভাবেই তাদের বিয়ে হয়।
রাজনৈতিক জীবনে বজলুর রহমানের নানার বাড়ি নকলা ও নালিতাবাড়ী আসনে আওয়ামী লীগের হয়ে নির্বাচন করেন মতিয়া চৌধুরী। বিএনপির সাবেক হুইপ জাহেদ আলী চৌধুরীর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে এই আসনে আওয়ামী লীগের দুর্গ শক্তিশালী করেন তিনি। ১৯৯৬, ২০০৯ এবং ২০১৩ সালে আওয়ামী লীগের শাসনামলে কৃষিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন মতিয়া চৌধুরী। সবশেষ আওয়ামী লীগের ১ নম্বর প্রেসিডিয়াম সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন বষীয়ান এই রাজনীতিক।
স্থানীয় রাজনীতিতে শেরপুর-১ আসনের এমপি ও সাবেক হুইপ আতিউর রহমান আতিকের সঙ্গে অভ্যন্তরীণ কোন্দলে জেলা আওয়ামী লীগকে বিভক্ত করেন মতিয়া চৌধুরী। জেলা আওয়ামী লীগের এই কোন্দল দলের হাই কমান্ড পর্যন্ত জানলেও মতিয়ার কারণে কোনো দলীয় হস্তক্ষেপ ছিল না এই জেলায়। দলের মাঠ পর্যায়ের নেতাকর্মী থেকে শুরু করে বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ ও জনপ্রতিনিধিরাও এই বিভক্তির রোষানলে পড়েছেন। পরবর্তী সময়ে জেলা আওয়ামী লীগের কমিটি থেকে তাকে বাতিলের সুপারিশও করা হয়েছিল সভাপতি আতিউর রহমানের পক্ষ থেকে।
শুধু রাজনৈতিক বিভক্তি নয়, মতিয়া চৌধুরী ও আতিউর রহমানের অন্তর্কোন্দলে নানাভাবে বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মযজ্ঞ থেকে বঞ্চিত হয়েছে শেরপুর। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর কাছের ও আস্থাভাজন হওয়ায় শেরপুরের বিষয়ে যেকোনো সুপারিশ তিনি নাকচ করে দিতেন বলেও অভিযোগ রয়েছে মতিয়া চৌধুরীর বিরুদ্ধে।
দলের হাই কমান্ডে ভালো সম্পর্ক থাকায় বেগম মতিয়া চৌধুরী ছয়বার এমপি নির্বাচিত হয়ে সংসদে প্রতিনিধিত্ব করেছেন। নালিতাবাড়ী ও নকলা উপজেলা নিয়ে গঠিত শেরপুর-২ আসন থেকে বিপুল ভোটে জয়ের স্বাদ নিয়েছিলেন তিনি। ১৯৯১ সালে প্রথমবারের মতো শেরপুর-২ আসনে আওয়ামী লীগের দলীয় প্রার্থী হিসেবে অংশ নিয়ে এমপি নির্বাচিত হন। এরপর ১৯৯৬ সালে দ্বিতীয়বারের মতো একই আসন থেকে নির্বাচিত হন। ২০০১ সালে সামান্য ভোটের ব্যবধানে বিএনপি প্রার্থী মরহুম জাহেদ আলী চৌধুরীর কাছে পরাজিত হন মতিয়া চৌধুরী।
ইমরান হাসান রাব্বী/এসআর/জেআইএম