দেশজুড়ে

ছেলুন-টোটনের পকেটে কোটি টাকার রাজস্ব

চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার নয়মাইল ও দশমাইল এলাকায় মাত্র এক মাইল দূরুত্বের মধ্যে একই দিনে বসে দুটি পশুহাট। হাট দুটি নিয়ে একদিকে যেমন তৈরি হয়েছে স্থানীয় কোন্দল, অন্যদিকে চুয়াডাঙ্গা-ঢাকা মহাসড়কে সৃষ্টি হয় দীর্ঘ যানযট। তবে একটি হাট প্রশাসনের অনুমতিতে চললেও আরেকটির কোনো অনুমোদন নেই।

Advertisement

নয়মাইল ভুলটিয়া বাজারের হাটটির পক্ষ থেকে সামান্য অর্থ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার দপ্তরে জমা হলেও দশমাইল হাটের কোনো অর্থই সরকার পাচ্ছে না। দীর্ঘদিন আওয়ামী লীগের প্রভাবশালীদের নিয়ন্ত্রণ ও মামলার কৌশলের কারণে সরকারকে ফাঁকি দেওয়া হয়েছে কোটি কোটি টাকার রাজস্ব।

তবে বর্তমানে হাটের নিয়ন্ত্রণকারীরা বলছেন, সকলে মিলেই হাট দুটি পরিচালনা করা হচ্ছে। সরকারকে দেওয়া হচ্ছে রাজস্ব।

জানা গেছে, সদর উপজেলার দশমাইল বদরগঞ্জ বাজার ও নয়মাইল ভুলটিয়া বাজারে সপ্তাহে শনিবার বসছে দুটি পশুহাট। রাস্তার পাশেই হাট দুটোর অবস্থান এবং একই দিনে দুটি হাট বসায় চুয়াডাঙ্গা-ঢাকা মহাসড়কে তৈরি হয় দীর্ঘ যানজট।

Advertisement

এলাকাবাসী বলছে, দুই হাট নিয়ে স্থানীয়দের মধ্যে পূর্ব থেকেই ছিল কোন্দল। ৫ আগস্টের পর হাটের নিয়ন্ত্রণকারী পরিবর্তন হলেও নতুনদের মধ্যেও রয়েছে দুটি গ্রুপ।

অনুসন্ধানে জানা যায়, সদর উপজেলার দশমাইল তথা বদরগঞ্জ বাজারে ১৯৫৩ সালে একটি গরুর হাট চালু করা হয়। তৎকালীন কিছু ধর্মপ্রাণ ও শিক্ষানুরাগী মানুষ জমি দিয়ে এই এলাকায় ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চলমান রাখতে আর্থিক উৎস হিসেবে হাটটি চালু করেন। এই হাটের জন্য গঠন করা হয় একটি ট্রাস্ট। বদরগঞ্জ কামিল মাদরাসা, পার্শ্ববর্তী ঝিনাইদহ কামিল মাদরাসা, আলিয়ারপুর মসজিদ কবরস্থান, দশমী হাফিজিয়া মাদরাসা ও লিল্লাহ বোর্ডিং, এলাকার বিভিন্ন মসজিদ, সাধুহাটির একটি গার্লস স্কুলসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ওই ট্রাস্টের মাধ্যমে এই হাট থেকে উপার্জিত অর্থ সহায়তার জন্য প্রদান করা হতো। এই এলাকায় কোনো প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠলে সরকারিকরণ হওয়ার আগ পর্যন্ত নানাভাবে হাটটি থেকে আর্থিকভাবে পাশেও থাকা হতো।

তবে এক সময় এই হাটে নজর পড়ে চুয়াডাঙ্গা জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও চুয়াডাঙ্গা-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য সোলায়মান হক জোয়ার্দ্দার ছেলুন ও তার ভাই জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক পৌর মেয়র রিয়াজুল ইসলাম জোয়ার্দ্দার টোটনের। তাদের দীর্ঘ প্রচেষ্টায় এই হাটে তৈরি করা হয় স্থানীয় কোন্দল।

হাট নিয়ন্ত্রণকারীদের দুটি ভাগে বিভক্ত হওয়ার সুযোগ কাজে লাগান সাবেক এমপি ছেলুন জোয়ার্দ্দার ও তার ভাই টোটন জোয়ার্দ্দার। ওই অঞ্চলের অন্যতম প্রভাবশালী হাট ব্যবসায়ী, সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও কুতুবপুর ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান হাসানুজ্জামান মানিকের গুটি চালেন দুই ভাই। এরপর ২০১৯ সালে দশমাইল বাজার থেকে হাটটি সরিয়ে আনা হয় নয়মাইল বাজারে।

Advertisement

তবে সেসময় চুয়াডাঙ্গার দশমাইল বাজারে ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের কয়েকজন প্রভাবশালী নেতার সংশ্লিষ্টতা থাকায় হাটটি সম্পূর্ণ রূপে নয়মাইল বাজারে স্থানান্তরিত হয় না, তাই বসে আংশিক হাট। তৈরি গ্রুপিং আর দলবাজি।

অনুসন্ধান বলছে, তখন দুটি গ্রুপ দুটি পৃথক হাট বসানো শুরু করে। চুয়াডাঙ্গার নয়মাইল ভুলটিয়া বাজারে ছেলনু-টোটনের নির্দেশনায় একটি পশুহাট এবং ঝিনাইদহের সাধুহাটি ইউনিয়ন পরিষদের পাশে বসে আরেকটি হাট। ঘটনা সেখানেই থেমে যায়নি। একদিকে যেমন বদরগঞ্জ এলাকায় থাকা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে আর্থিক উৎসের সংকট দেখা দেয়, অন্যদিকে নয়মাইল ভুলটিয়া বাজারেও দেখা দেয় নানা স্থানীয় সমস্যা।

আওয়ামী লীগের ক্যাডার খ্যাত কুতুবপুর ইউপি চেয়ারম্যান হাসানুজ্জামান মানিকের নেতৃত্বে ভুলটিয়া পশুহাট কিছুদিন চললেও ছেলুন-টোটনের পরিকল্পনা ছিল অন্যকিছু। জেলার অনেক হাট ও বিলের মতোই এই হাটেও মামলার ছক কষে রাজস্ব ফাঁকি দেওয়ার পরিকল্পনা এখান থেকেই করেন ছেলুন-টোটন। ২০২০ সালে সদর উপজেলার হাসনহাটি গ্রামের আব্দুর রহিমের ছেলে আব্দুর রহমানকে দিয়ে জমির মালিকানা সংক্রান্ত একটি মামলা দায়ের করানো হয়। মামলা হওয়ার পর হাইকোর্ট থেকে স্থগিতাদেশ নিয়ে হাটটির ইজারা পদ্ধতি বাতিল করা হয়।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই হাট থেকে বছরে প্রায় দুই কোটি টাকার রাজস্ব আয় হতো সরকারের। তবে ছক কষে মামলা সাজিয়ে এই হাটের ইজারা বন্ধ করে আনা হয় খাস কালেকশনে। খাস কালেকশন শুরু হওয়ার পর থেকেই সরকারের রাজস্বে দেওয়া হয়েছে বিপুল পরিমাণ অর্থের ফাঁকি।

চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়ের একটি সূত্র বলছে, ইজারা হলে অন্তত বছরে দুই কোটি টাকার ডাক হতো। তবে সরকার পরিবর্তনের আগে আওয়ামী লীগের লোকজন বছরে মোট ১২ থেকে ১৭ লাখ টাকা মতো জমা দিতেন। মূলত সপ্তাহে একটি হাট হিসাব করে সপ্তাহে ৩৬ হাজার টাকা বা হাট বুঝে এর কমবেশি ইচ্ছামতো টাকা জমা দিতেন হাসানুজ্জামান মানিক।

উপজেলা প্রশাসনের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্ত দিয়ে বলেন, সরকারের রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে হাটটি থেকে কোটি কোটি টাকা আয় করতেন স্থানীয় সাবেক সংসদ সদস্য সোলায়মান হক জোয়ার্দ্দার ছেলুন ও তার ভাই রিয়াজুল ইসলাম জোয়ার্দ্দার টোটন।

নাম না প্রকাশ করে হাট সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বদরগঞ্জ হাট থেকে আয়ের চার ভাগের তিন ভাগই নিতেন ছেলুন জোয়ার্দ্দার ও টোটন জোয়ার্দ্দার। তবে তাতেও তাদের মন ভরে না, সেজন্য স্থানীয় কোন্দল সৃষ্টি করেন। নানা জটিলতার মধ্যে হাটটি নয়মাইল বাজারে নিয়ে আসেন তারা। ওই হাটের প্রায় সব টাকাই ছেলুন-টোটনের পকেটে ঢুকতো। সংসদ সদস্য হওয়ার প্রভাব খাটিয়ে সরকারের রাজস্ব বিপুল পরিমাণে শুধু ফাঁকিই দেননি, এরসঙ্গে গরিব-দুঃখী মানুষের সন্তানদের লেখাপড়ার জন্য যে প্রতিষ্ঠানগুলো তৈরি করেছিলেন তৎকালীন দানশীল ব্যক্তিরা, সেই প্রতিষ্ঠানগুলোতে যাতে অর্থ না পৌঁছায় সেজন্যই ছেলুন-টোটন এই পরিকল্পনা করেন।

চুয়াডাঙ্গা-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ছেলুন জোয়ার্দ্দার ও তার ছোট ভাই চুয়াডাঙ্গা পৌরসভার সাবেক মেয়র টোটন জোয়ার্দ্দার পলাতক থাকায় যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। এছাড়া তাদের ব্যবহৃত মোবাইল ফোন নম্বরটিও বন্ধ পাওয়ায় অভিযোগের বিষয়ে বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।

চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নাজিবুল আলম বলেন, আমি নতুন যোগদান করেছি। জেলা প্রশাসক স্যার হাটটি পরিদর্শন করতে বলেছিলেন। আমি সেখানে গিয়ে দুটি হাটের লোকজনের সঙ্গেই কথা বলেছি। আসলে সমস্যাটা জটিল। আমি পূর্বের ইতিহাস সম্পর্কেও জেনেছি। বিষয়গুলো জেলা প্রশাসক স্যারকে জানাবো, তবে সেদিনই জেলা প্রশাসক স্যার বদলি হয়ে চলে যান। নবাগত জেলা প্রশাসক স্যারের সঙ্গে আমি হাটটি নিয়ে বিস্তারিত আলাপ করবো। তবে নয়মাইল হাট থেকে খাস কালেকশনের মাধ্যমে সামান্য কিছু অর্থ সম্ভবত আমার দপ্তরে জমা হয়। বদরগঞ্জে আমাদের কোনো হাট নেই।

ছেলুন জোয়ার্দ্দার ও তার ছোট ভাই টোটন জোয়ার্দ্দারের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ উঠলেও এখনো পর্যন্ত প্রকাশ্যে কেউ মুখ খুলছেন না। সাংবাদিকদের কাছেও বক্তব্য দিচ্ছেন নাম না প্রকাশ করে। সবার এক অজানা ভয়। আওয়ামী লীগ না থেকেও যেন তারাই চালাচ্ছেন সব, বিষয়টি এমন।

এফএ/জেআইএম