ড. মাহবুবুর রাজ্জাক
Advertisement
গ্রামে নতুন মোল্লা এসেছে। সুদর্শন যুবক, বেশ পড়াশোনা করা, কথা বলে ভালো। আগের মোল্লা প্রমাদ গুনলো। নতুন মোল্লাকে মাঠে জায়গা দিলে তার নিজের আয় রোজগারে নিশ্চিত টান পড়বে। সে তার এক চেলাকে লেলিয়ে দিলো। নতুন মোল্লাকে তাড়াতাড়ি বিতর্কিত করে গ্রামছাড়া করতে হবে। একদিন ভরা মজলিসে নতুন মোল্লা তাঁর জ্ঞানগর্ভ বয়ান করছেন। চেলা গিয়ে তাঁকে থামিয়ে দিলো। বললো, মিয়াঁ, এতো বড় বড় কথা বলছো, বলো তো দেখি আল্লাহ ডিম সৃষ্টি করেছে আগে, না মুরগি? বেচারা নতুন মোল্লা পড়লো বিপদে। শুরু হলো হইচই। সেদিন মজলিস ওখানেই শেষ। প্রশ্নটি ছিলো একটা অজুহাত মাত্র। আসল টার্গেট ছিল নতুন মোল্লাকে সাইজ করা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র শিবিরের সেক্রেটারি পরিচয়ে একটি ছেলে সম্প্রতি সংবাদ সম্মেলন করেছে। ওখানে ‘রগ কাটা’ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এই প্রশ্নটি একটি ছুতা মাত্র। খুনি স্বৈরাচারের দোসর যারা, তাদের একটি বহুল ব্যবহৃত ভোঁতা অস্ত্র। তারা যে কোনো ছুতায় নতুন কোনো কিছুকে মাঠছাড়া করতে চায়। সেক্রেটারি ছেলেটি স্মার্ট। জবাবে বলেছে, গুগুলে সার্চ দিয়ে নিজেই দেখুন না রগ কাটার সাথে কারা বেশি জড়িত; কাদের নাম ওখানে বেশি পাওয়া যায়।
ছেলেটি ঠিকই বলেছে। গুগলে খুঁজলে বের হয়ে আসে ভয়াবহ সব তথ্য। রগ কাটা, হাত-পা কাটা, গলা কাটা, গুম, খুন, ধর্ষণ, চাঁদাবাজি, চুরি, ছিনতাই, রাহাজানি, এমন কোনো ফৌজদারি অপরাধ নেই, যার ওপর এই দেশের তথাকথিত রাজনীতির স্নেহের ছোঁয়া নাই। এ সমস্ত অপরাধে যাদের জেলে থাকার কথা ছিল, তারা হয়ে গেছে রাজনীতিবিদ। সরকারি দলই তাদের পছন্দের প্রথম ঠিকানা। তাদের সংসদে দেখা যায়। দেশের বড় বড় মানুষ এমনকি প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রীর সাথেও তাদের ছবি শোভা পায়। মানুষ অসহায় হয়ে চেয়ে চেয়ে দেখে, তারা আইনের ঊর্ধ্বে। তাই দেশ থেকে অরাজকতা আর অপরাধ দূর করার সদিচ্ছা থাকলে ঢাবি শিবিরকে প্রশ্ন করে অযথা সময় নষ্ট করার কোনো মানে হয় না। প্রশ্ন করতে হবে দেশের রাজনীতির অপসংস্কৃতিকে। সবাইকে আইনের আওতায় আনতে হবে।
Advertisement
রাজনীতির পান্ডারা নৃশংস আচরণ করলে আমরা অন্তত সমালোচনা করতে পারি; জনগণের করের টাকায় বেতন পাওয়া সরকারি পান্ডা র্যাব-পুলিশ একই কাজ করলে কথা পর্যন্ত বলতে পারি না। জঙ্গী দল জেএমবি যেই কায়দায় যতজনকে খুন করেছে, একই কায়দায় একই কাজ অনেক বেশি করেছে র্যাব আর পুলিশ। তারপরেও শুধু সরকারি নয় বলে জেএমবির করা সন্ত্রাস হয় জঙ্গীবাদ, আর সরকারি বলে র্যাবের সন্ত্রাস হয়ে যায় বৈধ। র্যাবের জন্য যেন সাতখুন মাফ।
জঙ্গী ধরার নাটক ছিল স্বৈরাচারের খুবই গুরুত্বপূর্ণ কর্মসূচিগুলোর একটি; ক্যাম্পাসে মাঝে মাঝেই হতো। শুধু সন্দেহের বশবর্তী হয়ে কাউকে পিটিয়ে জখম করে মুমূর্ষু করে ফেলে কর্তৃপক্ষকে ডেকে বলা হত জঙ্গী ধরা পড়েছে। কর্তৃপক্ষও বাধ্যগত ভৃত্যের মতো তাদের কথা শুনে কৃতার্থ হতো। পুলিশ ডেকে পুলিশের হাতে তুলে দিতো। নির্মম মারধর করে একটি জ্বলজ্যান্ত মানুষকে আধমরা করে ফেললেও তাদের বিরুদ্ধে কোনো মামলা হতো না বরং মামলা হতো যে মার খেয়েছে তার বিরুদ্ধে। একটি স্বাধীন দেশে এর চেয়ে অসভ্যতা, বর্বরতা আর কী হতে পারে?
বুয়েটের কিছু ছেলে একবার ঢাবি ছাত্রদলের দুই নেতাকে বিনা কারণে পিটিয়ে পুলিশে দিয়ে ডিএমপি কমিশনারের কাছ থেকে পুরস্কারও পেয়েছে; সেই ছবি আবার পত্রিকায়ও এসেছে। শুধু তা-ই নয়, সরকারি দল খুশি হয়ে তাদের বানিয়েছে নেতা; আর তাদের মুরব্বীদের বানিয়েছে ভিসি, প্রোভিসি। আজ পরিবেশ বড্ড বেশি কলুষিত। পরিস্থিতি কল্পনার চেয়েও ভয়াবহ ও জটিল। অভিজ্ঞতা বলে, বেছে বেছে বিশেষ কারো পেছনে লেগে দীর্ঘ মেয়াদে লাভ হয় না। হলে এতদিনে অনেকেরই নাম-নিশানা থাকতো না। তাই আমাদের এখন সোচ্চার হওয়া দরকার সামগ্রিক অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে।
শতকরা নব্বই ভাগ মুসলমানের দেশে আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো ভয় থাকার কথা নয়। মুসলমানদের হাত ও জিহ্বা থেকে তো অন্যরা নিরাপদে থাকার কথা। সেই সমাজ কই? ঘরেও কেন আমাদের নিরাপত্তা নাই? ধর্মনেতাদের সাথে নিয়ে মসজিদে-মন্দিরে আমাদের সেই নিরাপদ সমাজের জন্য কাজ শুরু করতে হবে এখনই।
Advertisement
আমরা অন্যের চরকায় তেল দিতে পছন্দ করি বেশি। ভাসাভাসা ধারণা নিয়েও অন্যের কাজের সমালোচনা করি। নিজের চরকায় তেল দেওয়ার অভ্যাস আমাদের নাই। আমার এক বাল্যবন্ধুর ভাষায় নিজের চরকায় তেল দেওয়ার নামই হল দেশপ্রেম। যদি আমরা দেশকে ভালোবাসি, যদি আসলেই বৈষম্যহীন শান্তিপূর্ণ সমাজ চাই, সবার আগে আমার নিজের চরকায় তেল দিতে হবে; মানে নিজেকে শুধরাতে হবে। নিজে যদি অন্যের ওপর অযাচিত হাত তোলা বন্ধ করি, আইন নিজ হাতে তুলে নেওয়ার অপসংস্কৃতির বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান নিই, তাহলে সমাজে অপরাধ কমে আসতে বাধ্য।
লেখক: অধ্যাপক, মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)।
এসইউ/এমএস