আইন-আদালত

উচ্চ আদালতের বিচারক অপসারণ প্রক্রিয়া কী?

ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন বিভাগ ও প্রতিষ্ঠানে ব্যাপক রদবদল হয়। আন্দোলনের মুখে পদত্যাগ করেন প্রধান বিচারপতিসহ ছয় বিচারপতি। দায়িত্ব ছাড়েন রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন কর্মকর্তাও। এরপর হাইকোর্ট বিভাগে দুই ডজনের বেশি বিচারপতির পদত্যাগের দাবিতে বিক্ষোভ করে আইনজীবীদের একটি অংশ। ২০ অক্টোবরের মধ্যে ব্যবস্থা না নিলে ওইসব বিচারপতির আদালত বর্জনেরও হুঁশিয়ারি দিয়েছেন আইনজীবীরা।

Advertisement

এরইমধ্যে গত ৬ অক্টোবর একটি গণমাধ্যমে “রায় দিয়ে ‘বাবার ট্রাস্টে’ টাকা নেন বিচারপতি” শিরোনামে একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়। এর আগে সুপ্রিম কোর্টের সাধারণ আইনজীবীদের ব্যানারে গত ৩০ সেপ্টেম্বর এবং সুপ্রিম কোর্ট বার ভবনের সামনে আয়োজিত বিক্ষোভ সমাবেশ থেকে শেখ হাসিনার সরকারের আমলে নিয়োগ পাওয়া দলবাজ ও দুর্নীতিবাজ হিসেবে চিহ্নিত বিচারপতিদের পদত্যাগের দাবিতে আলটিমেটাম দেওয়া হয়। পদত্যাগ না করলে ওই বিচারপতিদের বিচারকাজে অংশ নিতে দেওয়া হবে না বলে হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়। এর আগে গত ৮ আগস্ট সংবাদ সম্মেলন করে উচ্চ আদালতের ৫৬ জন বিচারপতির অপসারণ দাবি করেন আইনজীবীরা।

এদিকে গত ৫ অক্টোবর অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠকে অন্তত ৩০ জন বিচারপতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছে বিএনপি। ৩০ বিচারপতির নামের তালিকাও ঘুরছে হাতে হাতে। এছাড়া তাদের বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে গত ৭ অক্টোবর প্রধান বিচারপতি বরাবর স্মারকলিপি দেওয়া হয় এবং মানববন্ধন করা হয়।

আরও পড়ুন ষোড়শ সংশোধনী বিচার বিভাগকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছে ‘ষোড়শ সংশোধনীর রায়ে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা অপ্রাসঙ্গিক মন্তব্য’ সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠনে কী মতামত আইনজীবীদের? তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ছাড়া বাকি সংশোধনী ছিল রাজনৈতিক

বিএনপির আইনবিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার কায়সার কামাল বলেন, গত ১৫ বছরে আচরণবিধি লঙ্ঘনে জড়িত বিচারপতিদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে। পাঁচ বছর আগে দুর্নীতির অভিযোগে বিচারকাজ থেকে বিরত রাখা হয় হাইকোর্ট বিভাগের তিন বিচারপতিকে। তাদের বিষয়ে এখন পর্যন্ত চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন।

Advertisement

সব মিলিয়ে প্রশ্ন এখন উচ্চ আদালতের বিচারপতিদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ উঠলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে কোন প্রক্রিয়ায়? আইনজীবীরা সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিল গঠনের বিষয়ে ভিন্ন ভিন্ন মত দিয়েছেন। আবার কেউ কেউ ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ শুনানি শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষায় থাকার কথা বলেন। কেউ বলছেন, অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিল গঠন করে ব্যবস্থা নিতে পারে সরকার।

যদিও সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর মাধ্যমে বিচারপতিদের অপসারণের যে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছিল সংসদের হাতে, তা চূড়ান্তভাবে বাতিল করেছেন সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ। এই রায়ের ফলে ক্ষমতা আবারো সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিলের হাতে ফিরে যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন আইনজীবীরা। কিন্তু বর্তমানে ওই রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ (পুনর্বিবেচনার) আবেদন শুনানি অব্যাহত রয়েছে।

বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা কার হাতে?

১৯৭২-এর সংবিধানে বিচারপতিদের অপসারণে বা অভিসংশনের ক্ষমতা সংসদের হাতেই ছিল। ১৯৭৫-এ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনামলে চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে এ ক্ষমতা দেওয়া হয় রাষ্ট্রপতিকে। ১৯৭৮ সালে জিয়াউর রহমান সামরিক ফরমানে সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিলকে এই ক্ষমতা দেন। তার সময়ই পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে এই বিধান সংবিধানে স্থান পায়।

আরও পড়ুন বিচারক নিয়োগে আইন প্রণয়নের প্রয়োজন আছে কি? সংবিধানে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা সীমাহীন, এটা পরিবর্তন করা হবে পুনর্লিখনে সংবিধান হোক জনবান্ধব ৯ সদস্যের সংবিধান সংস্কার কমিশন গঠন

২০১০ সালে আপিল বিভাগ পঞ্চম সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করলেও সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিলের বিধানে কোনো পরিবর্তন আসেনি। পরের বছর ২০১১ সালে জাতীয় সংসদে গৃহীত পঞ্চদশ সংশোধনীতে বাহাত্তরের সংবিধানের অনেক বিষয় ফিরিয়ে আনা হলেও সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিল রেখে দেওয়া হয়। সংসদের হাতে বিচারক অপসারণের ক্ষমতা দিয়ে ২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর ষোড়শ সংশোধনী আনা হলে তাতে সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিল বাদ দেওয়া হয়।

Advertisement

ওই সংশোধনীর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ২০১৪ সালের ৫ নভেম্বর হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন ৯ আইনজীবী। শুনানি শেষে ২০১৬ সালের ৫ মে হাইকোর্টের তিন বিচারকের বেঞ্চ সংখ্যাগরিষ্ঠের মতের ভিত্তিতে ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেন। রাষ্ট্রপক্ষ এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করে। শুনানি নিয়ে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার (এস কে) সিনহার নেতৃত্বে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের সাত সদস্যের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ ২০১৭ সালের ৩ জুলাই সর্বসম্মতিতে আপিল খারিজ করে হাইকোর্টের রায় বহাল রাখেন।

আপিল বিভাগ শুনানিকালে মোট ১০ জন অ্যামিকাস কিউরির মতামত নেন। তাদের মধ্যে ৯ জন ষোড়শ সংশোধনীর বিপক্ষে মত দেন। তারা হলেন ড. কামাল হোসেন, এম আই ফারুকী, আব্দুল ওয়াদুদ ভূঁইয়া, সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল এ এফ এম হাসান আরিফ, ব্যারিস্টার এম আমির-উল ইসলাম, বিচারপতি টি এইচ খান, ব্যারিস্টার রোকন উদ্দিন মাহমুদ, ফিদা এম কামাল এবং এ জে মোহাম্মদ আলী। শুধু ব্যারিস্টার আজমালুল হোসেন কিউসি সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর পক্ষে মত দেন।

আইনজীবীরা বলেন, ষোড়শ সংশোধনীর মাধ্যমে বিচার বিভাগকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিতে চেয়েছিল আওয়ামী লীগ সরকার। কিন্তু আপিল বিভাগের রায়ের মধ্য দিয়ে তা ধূলিসাৎ হয়েছে।

যেভাবে কাজ করে সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিল

রিটকারী আইনজীবী মনজিল মোরসেদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের মাধ্যমে বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা আবার সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিলের হাতেই ফিরে গেছে। এ রায় ঘোষণার পর থেকেই কাউন্সিল আবার কার্যকর হয়েছে।’

আরও পড়ুন বিচার বিভাগের সচিবালয় হতে হবে হস্তক্ষেপমুক্ত-স্বাধীন ভারসাম্য আনতে সংবিধান সংস্কারের উদ্যোগ: অ্যাটর্নি জেনারেল সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রথম সভা অনুষ্ঠিত সংবিধান সংস্কার নয়, নতুন করে প্রণয়ন করতে হবে

সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিল কীভাবে কাজ করে এবং এর গঠন প্রক্রিয়া সম্পর্কে মনজিল মোরসেদ বলেন, ‘কোনো বিচারপতির অদক্ষতা, দুর্নীতি বা বিচারপতির বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ পেলে প্রধান বিচারপতিকে সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিল গঠন করতে বলবেন রাষ্ট্রপতি। প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে এই কাউন্সিলে আপিল বিভাগের একজন বিচারপতিসহ মোট তিন সদস্যের কাউন্সিল হবে। এই কাউন্সিলই অভিযোগের তদন্ত করবে, শুনানি করবে। আর যার বিরুদ্ধে অভিযোগ, তাকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেবে। এরপর তারা সিদ্ধান্ত দেবে যে অভিযোগটি সঠিক কি না। তারপর রাষ্ট্রপতি সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিলের মতামতের ভিত্তিতে ওই বিচারকের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবেন।’

সংসদের হাতে বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা থাকায় যে অসুবিধা

সংসদের হাতে বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা থাকায় অসুবিধা কী ছিল জানতে চাইলে মনজিল মোরসেদ বলেন, ‘সংসদের হাতে থাকলে বিচার বিভাগের ওপর চাপ সৃষ্টি হতো। তারা পুরো স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারতেন না। কারণ বাংলাদেশে সংসদ সদস্যরা শুধু আইন প্রণয়নই করেন না, তারা নিজের নির্বাচনী এলাকায় উন্নয়নমূলক কাজসহ নানা কাজে জড়িত। তাছাড়া উচ্চ আদালতে যত রিট বা মামলা হয়, তার অধিকাংশই এসব কাজ নিয়ে। একজন সংসদ সদস্য চান যে রায় যেন তার পক্ষে আসে। ফলে তা বিচার বিভাগের ওপর প্রভাব সৃষ্টি করতো। অথবা রায় কারও বিপক্ষে গেলে সংশ্লিষ্ট বিচারপতিদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া হতো। সংসদে অভিযোগ তুলে আলোচনাও শুরু হতো। ফলে বিচারকের স্বাধীনভাবে বিচার করা কঠিন হয়ে পড়তো।’

আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এ রায়ের মধ্য দিয়ে সংসদের সার্বভৌমত্ব কোনোভাবেই ক্ষুণ্ণ হয়নি। এছাড়া সংসদের সার্বভৌমত্ব বলে কিছু নেই। বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী সার্বভৌম হলো জনগণ অর্থাৎ সার্বভৌমত্ব জনগণের। সংসদ আইন প্রণয়ন করবে আর সংবিধানের রক্ষক হলো সুপ্রিম কোর্ট। সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বা যে কোনো আইনই সুপ্রিম কোর্ট বাতিল করে দিতে পারে।’

দ্রুততম সময়ে সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিল গঠনের দাবি

সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী প্রধান বিচারপতির দৃষ্টি আকর্ষণ করে জাগো নিউজকে বলেন, ‘প্রধান বিচারপতিকে অনুরোধ করবো, আপনার উদ্যোগে দ্রুততম সময়ে সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিল গঠন করুন এবং বিচারকদের বিরুদ্ধে যদি কোনো অভিযোগ পাওয়া যায় সেগুলোর বিষয়ে কার্যক্রম শুরু করুন। এসব বিষয় ব্যক্তি টু ব্যক্তিনির্ভর করে। যেসব বিচারকের পার্সোনালিটি আছে মেরুদণ্ড আছে, তারা নিশ্চয় সাংবিধানিকভাবে তাদের কার্যক্রম অব্যাহত রাখবে। কিন্তু আমরা গত ১৫ বছর সেটি পাইনি। আশা করবো সামনের দিনগুলোতে বিচার বিভাগের ওপর মানুষের যে আস্থা চলে গিয়েছিল, সেই আস্থাটি ফিরে আসুক। বিচারক এবং বিচারপতিরা যাতে ন্যায়বিচার দিতে পারেন, তাদের মধ্যেও যেন স্বস্তি ফিরে আসুক।’

সুব্রত চৌধুরী বলেন, উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগের বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের নির্দেশনা অনুযায়ী একটি নীতিমালা তৈরি করবে এবং সেই নীতিমালার আলোকে আপাতত অর্ডিন্যান্স জারি করা হোক, ইন্টেরিম অ্যারেজমেন্ট।

বিচারপতি অপসারণের বিষয়ে অধ্যাদেশ জারি করতে পারে সরকার

বিচারপতি অপসারণ প্রক্রিয়া কী এবং সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিল বহাল আছে কি না- এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ব্যারিস্টার মো. রুহুল কুদ্দুস কাজল জাগো নিউজকে বলেন, ‘বিগত ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে এ ক্ষমতা (বিচারপতি অপসারণ) জাতীয় সংসদের কাছে দিতে সংবিধানে ষোড়শ সংশোধনী আনা হয়েছিল। কিন্তু এখন সংসদ নেই। এদিক দিয়ে যদি দেখা যায় বিচারপতি অপসারণ কোনো প্রক্রিয়ায় হবে সেটাও সঠিকভাবে নেই। তা হলে উচ্চ আদালতের বিচারক অপসারণ প্রক্রিয়া কী হবে সেটা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। তবে, ষোড়শ সংশোধনীর রায়ের ফলে আমার মতে সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের অসদাচরণ তদন্ত ও অপসারণের সুপারিশ করার ক্ষমতা সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিলের হাতেই ফিরছে।

রুহুল কুদ্দুস কাজল জানান, বিচারপতি অপসারণের বিষয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে।

আরও পড়ুন সংবিধান দেশের নাগরিকদের আপন করে নিতে পারেনি প্রভাবমুক্ত স্বাধীন বিচার বিভাগ চান সুপ্রিম কোর্ট বার সভাপতি সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদের বৈধতা নিয়ে রিট সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয়সহ বিচারকদের ১২ দফা

‘সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিল গঠন সংক্রান্ত বিষয়ে ষোড়শ সংশোধনীর রায় সুপ্রিম কোর্টে নিষ্পত্তির অপেক্ষায়। যেহেতু এর রিভিউ আপিল বিভাগে শুনানির জন্য রয়েছে, এখন দেখার পালা এই রিভিউতে কী সিদ্ধান্ত আসে।’

রুহুল কুদ্দুস কাজল বলেন, ‘সংবিধানে সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিল গঠনের বিধান আছে। কারও বিষয়ে অভিযোগ পেলে সেটি গঠন করতে হবে। অভিযোগটি আইন মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতির কাছে যাবে, রাষ্ট্রপতি এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেবেন।’

আপিল ও হাইকোর্ট বিভাগের কিছু রুলস রিভাইজ করা দরকার

বিচার বিভাগের সংস্কার নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘বিচারপতির বিষয়ে কোনো অভিযোগ থাকলে ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। কিন্তু কোন মাধ্যমে ব্যবস্থা নেওয়া হবে, এখন তো আপাতত কোনো প্রক্রিয়া নেই। তবে, সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিলকে ফেরত আনাসহ আমাদের সুপ্রিম কোর্টের আপিল ও হাইকোর্ট বিভাগের কিছু রুলস রিভাইজ করা দরকার। ফ্যাসিবাদ আওয়ামী লীগ সরকার সংবিধানকে অপব্যবহার করেছে, সেই বিষয়ে এই সংবিধানকে রিফর্ম করে আইন প্রয়োগ করতে একটা অর্ডিন্যান্স জারির মাধ্যমে সেটি করতে পারে।’

নাম প্রকাশ না করার শর্তে সুপ্রিম কোর্টের এক আইনজীবী জাগো নিউজকে বলেন, সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করা উচ্চ আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ আবেদন গ্রহণের সময়ে আপিল বিভাগে রায়টি যেহেতু স্থগিত করা হয়নি, সেহেতু সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিলের বিধান এখনও বিদ্যমান।

ওই আইনজীবী মনে করেন, রিভিউ আবেদন করলেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে রায় স্থগিত হয়ে যায় না। ষোড়শ সংশোধনীর মামলায় রিভিউ আবেদনে আবেদনকারীদের রায়টি স্থগিত করার বিষয়টি চাইতে হবে। আদালতকেও স্থগিতাদেশ দিতে হবে। যদি আদালত স্থগিত করেন তাহলে রায় নেই, আর স্থগিত না করলে বিদ্যমান আছে।

ষোড়শ সংশোধনীতে যা ছিল

ষোড়শ সংশোধনী বিলে বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতাসংক্রান্ত বিধান সংসদের হাতে রাখা হয়। এতে বলা হয়েছিল, ‘প্রমাণিত ও অসদাচরণ বা অসামর্থ্যের কারণে সংসদের মোট সদস্য সংখ্যার অন্যূন দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা দ্বারা সমর্থিত সংসদের প্রস্তাবক্রমে প্রদত্ত রাষ্ট্রপতির আদেশ ব্যতীত কোনো বিচারককে অপসারিত করা যাবে না।’

এতে বলা হয়, কোনো বিচারকের অসদাচরণ বা অসামর্থ্য সম্পর্কে তদন্ত ও প্রমাণের পদ্ধতি সংসদ আইনের দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করবে।

ষোড়শ সংশোধনীর আপিলের পূর্ণাঙ্গ রায়ে যা আছে

বিচারপতি অপসারণ ক্ষমতা সংসদের হাতে ন্যস্ত করে আনা সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী ‘অবৈধ’ ঘোষণার পূর্ণাঙ্গ রায় ২০১৭ সালের ১ আগস্ট সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হয়। মোট ৭৯৯ পৃষ্ঠার রায়ে বিচারকদের জন্য ৩৯ দফা আচরণবিধি প্রণয়ন করেন সর্বোচ্চ আদালত। এগুলো অনুসরণ না করা হলে তা গুরুতর অসদাচরণ হিসেবে গণ্য হবে। রায়ে সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদের ২, ৩, ৪, ৫, ৬ ও ৭ উপ-অনুচ্ছেদ পুনবর্হাল করা হয়। ফলে সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিল ফিরে এসেছে। এই কাউন্সিল গঠিত হয় প্রধান বিচারপতি ও পরবর্তী জ্যেষ্ঠ দুজন বিচারপতিকে নিয়ে।

আরও পড়ুন বিচার বিভাগের স্বাধীনতায় আলাদা সচিবালয় করা জরুরি: প্রধান বিচারপতি ফ্যাসিবাদের দোসর বিচারকরা এখনো গুরুত্বপূর্ণ পদে রয়েছেন অনেকে বিচার না পেয়ে আসেন, আপনারা কেন বিব্রত?

মূল রায়টি লিখেছেন তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা। পূর্ণাঙ্গ রায়ে দেখা যায়, একজন ছাড়া সব বিচারপতি পৃথকভাবে তাদের মতামত ব্যক্ত করেছেন। বলা হয়েছে, সর্বসম্মতিতে আপিল খারিজ করা হলো, হাইকোর্টের কিছু মন্তব্য বাতিল করা হলো।

আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায়ে বলা হয়, সন্দেহ ও বিভ্রান্তি এড়াতে সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদের অধীনে একটি আচরণবিধি পুনরায় প্রণয়ন করা হচ্ছে। এতে বলা হয়, প্রধান বিচারপতি যদি কোনো ব্যক্তি বা অন্য কোনো সূত্রে কোনো বিচারকের আচরণের বিষয়ে অভিযোগ গ্রহণ করেন তাহলে প্রধান বিচারপতি আপিল বিভাগের পরবর্তী দুই জ্যেষ্ঠ বিচারককে নিয়ে তদন্ত করবেন। কোনো অভিযোগের বিষয়ে তদন্ত করতে প্রধান বিচারপতি বা অন্য কোনো বিচারক অস্বীকৃতি জানালে কিংবা অভিযোগ যদি তাদের বিরুদ্ধেই উঠে তাহলে পরবর্তী জ্যেষ্ঠ বিচারক ওই কমিটির সদস্য হবেন। এরপর তদন্তে যদি প্রাথমিকভাবে দেখা যায় অভিযোগের প্রাথমিক ভিত্তি রয়েছে, তখন প্রধান বিচারপতি বিষয়টি রাষ্ট্রপতির কাছে প্রেরণ করবেন। কোনো বিচারকের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হলে তা দ্রুত এবং ন্যায়পরায়ণতার সঙ্গে খতিয়ে দেখতে হবে। তবে বিচারক যদি ভিন্নরূপ কোনো অনুরোধ না করেন, তাহলে বিচারকের বিরুদ্ধে তদন্ত করার বিষয়টি প্রাথমিক পর্যায়ে গোপন রাখা হবে। সব ধরনের শৃঙ্খলামূলক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত বিচার বিভাগীয় মানদণ্ডে সম্পন্ন করা হবে।

একজন বিচারক উচ্চমানের আচার প্রতিষ্ঠা, প্রয়োগ ও রক্ষণে অংশ নেবেন এবং ব্যক্তিগতভাবে এ মান মেনে চলবেন, যাতে বিচার বিভাগের ন্যায়পরায়ণতা এবং স্বাধীনতা বজায় থাকে। একজন বিচারককে সংবিধান ও আইন মানতে হবে। সব সময় এমন কাজ করবেন, যাতে বিচার বিভাগের ওপর মানুষের আস্থা বাড়ে। পরিবার, সামাজিক গণ্ডি বা অন্য কোনো সম্পর্কের কাউকে রায় বা বিচারিক আচরণ প্রভাবিত করতে দেবেন না।

রায়ে আরও বলা হয়, বিচারক দলীয় স্বার্থ, জনবিক্ষোভ বা সমালোচনার ভয়ে প্রভাবিত হবেন না। তিনি পরিবার, সামাজিক পারিপার্শ্বিকতা বা অন্য কোনো সম্পর্ককে বিচারিক আচরণ বা রায়কে প্রভাবিত করতে দেবেন না। ব্যক্তিস্বার্থে তিনি বিচার বিভাগীয় দায়িত্ব বিকিয়ে দেবেন না। বিচারকের সঙ্গে অমুকের ভালো সম্পর্ক রয়েছে—কারও সম্পর্কে এরকম ধারণাও সৃষ্টি করতে দেবেন না।

রায়ে বলা হয়, কোনো মামলার বা বিচারাধীন বিষয়ের সারবত্তা নিয়ে বিচারক জনসমক্ষে মন্তব্য করবেন না। একজন বিচারক আদালতের কাজে বিলম্ব না করে দ্রুত শেষ করবেন। রায় দেওয়ার পর স্বাক্ষর দিতে কোনোভাবেই ছয় মাসের বেশি সময় নেওয়া যাবে না।

যদি যৌক্তিক কারণে কোনো মামলায় বিচারকের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে, তাহলে ওই বিচারক নিজেকে বিচারকাজ থেকে সরিয়ে নেবেন। কোনো মামলায় বিচারক পূর্বে আইনজীবী হিসেবে ছিলেন, সেখান থেকেও তিনি নিজেকে প্রত্যাহার করে নেবেন। বিচারক অতীতে যার সঙ্গে প্র্যাকটিস করেছেন, তার কাছে থাকা সেই সময়কার মামলাগুলোর ক্ষেত্রেও এবং যেসব মামলায় তিনি সাক্ষী ছিলেন, সেখান থেকেও তিনি নিজেকে সরিয়ে নেবেন।

রায়ে বলা হয়, যদি ব্যক্তিগতভাবে বা জিম্মাদার হিসেবে বিচারক, তার স্বামী-স্ত্রী বা সন্তানদের কোনো অর্থনৈতিক স্বার্থ থাকে বা তারা মামলায় পক্ষ থাকে বা অন্য কোনো স্বার্থ থাকে, যা মামলায় প্রভাব বিস্তার করতে পারে, তাহলে বিচারক সে মামলার শুনানি করবেন না। প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বিচারক নিজে বা অন্য কারও সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্যে জড়িত হবেন না। দেশে বা বিদেশে একজন বিচারক কখনোই রাজনীতির সঙ্গে জড়িত হবেন না।

রায়ে বলা হয়, বিচারকের পরিবারের কোনো সদস্য যদি আইনজীবী হন, তাহলে ওই আইনজীবী কোনোভাবে বিচারকের বাসায় পেশাগত কাজ পরিচালনা যেমন ব্যক্তিগত চেম্বার করতে পারবেন না। আরও বলা হয়, বিচারক বা তার পরিবারের কোনো সদস্য কারও কাছ থেকে বিচারিক ক্ষমতার বিনিময়ে উপহার, অনুরোধ, ঋণ বা সুবিধা চাইতে পারবেন না। তিনি গণমাধ্যমে সাক্ষাৎকার দেবেন না। প্রধান বিচারপতি চাইলে একজন বিচারক তার সম্পদ ও দায়ের হিসাব দাখিল করবেন।

রায় প্রকাশের পর রাষ্ট্রের তৎকালীন প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, ‘রায়ে সর্বসম্মতিক্রমে আপিল খারিজ করে সংবিধানের ৯৬-এর (২) থেকে (৭) পর্যন্ত পুনর্বহাল করা হয়েছে। আমার বিবেচনায় সংবিধানের যে কোনো অনুচ্ছেদ সংশোধন করা বা বাদ দেওয়া সবটাই সংসদের ব্যাপার ও এখতিয়ার। সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদ সংশোধন করে সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিলের যে বিধান অন্তর্ভুক্ত করে সংশোধন করা হয়েছিল, সেটি আবার পুনর্বহাল করা হয়েছে। রায়ে বিচারপতিদের কোড অব কন্ডাক্ট সম্পর্কে যে বিস্তারিত বর্ণনা আছে, এর সঙ্গেও সব বিচারপতি একমত পোষণ করেছেন।’

রায় পুনর্বিবেচনা চেয়ে আবেদন করা হবে কি না, এমন প্রশ্নে মাহবুবে আলম বলেন, ‘রিভিউয়ের বিষয়টি সরকারের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করবে।’

ষোড়শ সংশোধনী পুনর্বহাল, সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিলের বিধান বাতিল এবং এর কিছু পর্যবেক্ষণ বাতিল করার বিষয়ে সরকারের প্রার্থনা বিবেচনা করতে পারে এমন ৯৪টি কারণ দেখিয়ে ২০১৭ সালের ২৪ ডিসেম্বর শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার আপিল বিভাগে ৯০৮ পৃষ্ঠার রিভিউ পিটিশন দাখিল করে।

অক্টোবরের তৃতীয় সপ্তাহে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে রিভিউ আবেদনের ওপর শুনানি হবে। গত ১৫ আগস্ট প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বাধীন চার বিচারপতির আপিল বেঞ্চ এ আদেশ দেন।

এফএইচ/এমএমএআর/জিকেএস