সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব দুর্গাপূজা ঘিরে কয়েক বছর ধরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক হারে গুজব ছড়িয়ে দেয় একটি মহল। অনেক ব্যবহারকারী বুঝে, না বুঝে তাতে রিয়্যাক্ট, শেয়ার ও প্রতিক্রিয়া জানাতে শুরু করেন।
Advertisement
চলতি বছরও দুর্গাপূজা ঘিরে এক সপ্তাহে অনেক গুজব ছড়িয়েছে। তার মধ্যে সুনির্দিষ্ট ১০টি তথ্য যাচাই করে সত্য-মিথ্যা শনাক্ত করেছে ফ্যাক্ট চেকিং প্রতিষ্ঠান রিউমার স্ক্যানার। ৬ থেকে ১২ অক্টোবর সময়ে ফেসবুক, ইউটিউব, ইনস্টাগ্রাম, এক্সে (সাবেক টুইটার) ছড়িয়েপড়া এসব তথ্য যাচাই করেছে প্রতিষ্ঠানটি।
রিউমার স্ক্যানার বলছে, এক সপ্তাহে তারা যে ১০টি গুজব শনাক্ত করেছেন, তার মধ্যে অধিকাংশই গত বছরের ঘটনা। কিছু ঘটনা ভারতের হওয়া সত্ত্বেও তা বাংলাদেশের বলে অপপ্রচার করা হয়েছে। সাম্প্রদায়িক বিভেদ তৈরির ক্ষেত্রে এগুলো বেশি ব্যবহার করেছে কুচক্রি মহল।
দুর্গাপূজা ঘিরে ফেসবুকে যত গুজববরিশালে প্রতিমা ভাঙচুরের পর ডিজিটাল ব্যানারে দেব-দেবীর ছবি ছাপিয়ে পূজা উদযাপন করা হচ্ছে বলে একটি গুজব সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। রিউমার স্ক্যানার বলছে, এটা সম্পূর্ণ গুজব।
Advertisement
প্রতিষ্ঠানটির অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, শোভন কর্মকার নামে একজন প্রথম এ ছবিটি পোস্ট করেন। সেটিতে তিনি কোথাও প্রতিমা ভাঙচুরের ভয়ে বা ভাঙচুর করায় ডিজিটাল ব্যানারে দেব-দেবীর ছবি ছাপিয়ে পূজা করার কথা উল্লেখ করেননি। অথচ তার ছবিটি অন্যরা শেয়ার করে প্রতিমা ভাঙচুরের কারণে ব্যানার টানিয়ে পূজা করা হচ্ছে বলে অপপ্রচার শুরু করেন।
প্রতিমার সামনে ইসলামিক বাণী প্রচার করা হচ্ছে- এমন একটি ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে। অনেকে সেটা শেয়ার দিয়ে প্রতিবাদ জানাচ্ছেন। ওই ভিডিওটিও বাংলাদেশের নয়। ভিডিওটি ভারতের বলে নিশ্চিত হয়েছে রিউমার স্ক্যানার।
পূজামণ্ডপের সামনে দুই পক্ষের তুমুল বাগবিতণ্ডা চলছে- এমন একটি ভিডিও ছড়িয়ে তা বাংলাদেশের বলে অপপ্রচার চালানো হয়েছে। ‘জয় বাংলা পেজ’ নামে একটি ফেসবুক পেজে ওই ভিডিওটি শেয়ার করে ক্যাপশন জুড়ে দেওয়া হয় যে, ‘তেমন কিছু না। পূজা মণ্ডপের মাইক বাজানোর জন্য মণ্ডপের ভেতরে প্রবেশ করে সম্প্রীতির বার্তা ছড়িয়ে দিচ্ছে শিবির।’ এটি বাংলাদেশের কোনো মণ্ডপের ঘটনা নয়। রিউমার স্ক্যানার ফ্যাক্ট চেকিংয়ে নিশ্চিত হয়েছে যে, এটা ভারতের পূজামণ্ডপের ঘটনা।
পূজামণ্ডপের সামনে একজন সুপরিচিত এক ইসলামি বক্তাসহ চারজন মোনাজাত করছেন- এমন একটি ছবিও সম্প্রতি ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছে। এটি সম্পূর্ণ এডিটেড (সম্পাদিত) ছবি বলে নিশ্চিত হয়েছে রিউমার স্ক্যানার। প্রতিষ্ঠানটির অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, কবর জিয়ারতের একটি ছবি পূজা মণ্ডপের সামনে বসিয়ে অপপ্রচার চালানো হয়।
Advertisement
দুর্গাপূজার মূর্তি ভাঙচুরের পুরোনো একটি ছবি সাম্প্রতিক সময়ের ছবি দাবি করে অনেকে শেয়ার করছেন। সেটিও ফ্যাক্ট চেকিংয়ে মিথ্যা অপপ্রচার বলে নিশ্চিত হয়েছে রিউমার স্ক্যানার।
চট্টগ্রামে একটি মণ্ডপে ইসলামি গান গাওয়ার জেরে আরেকটি ভিডিও ফেসবুকে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। একজন নারী শিল্পী ‘মাঝি দে দে পাল তুলে দে...’ গান গাইছেন। আরেকটি মণ্ডপেও দলবদ্ধভাবে একই গান গাইতে শোনা যাচ্ছে ভিডিওতে। সেগুলোকে বাংলাদেশের বলে প্রচার করা হচ্ছে। রিউমার স্ক্যানার নিশ্চিত হয়েছে, এগুলো ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মণ্ডপের পুরোনো ভিডিও।
ঢাকার দোহারে মন্দির ভাঙচুরের একটি ঘটনা ফেসবুকে ব্যাপকভাবে প্রচার করা হচ্ছে। রিউমার স্ক্যানার যাচাই করে দেখেছে, ভাঙচুরের ওই ঘটনাটি ২০২৩ সালের। এছাড়া নরসিংদীতে পূজামণ্ডপের প্যান্ডেলের ত্রিপল কেটে ফেলার একটি গুজব ও ২০২৩ সালে ফরিদপুরে মন্দির ভাঙচুরে হিন্দু যুবক গ্রেফতারের ঘটনা এ বছরের বা সাম্প্রতিক বলে ফেসবুকে অপপ্রচার করা হচ্ছে।
আরও যত গুজব ছড়িয়েছে এ সপ্তাহেপ্রধান উপদেষ্টা ও সেনাপ্রধানের মধ্যে দ্বন্দ্ব হয়েছে বলে গত ৮ অক্টোবর রাতে ব্যাপকহারে গুজব ছড়ানো হয়। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ও সমর্থকরা এটি বেশি প্রচার করেন। আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গ-সংগঠনের নামে খোলা বিভিন্ন পেজ থেকে এ বিষয়ে মনগড়া তথ্য প্রচার করা হয়। রিউমার স্ক্যানার বলছে, এ ধরনের কোনো ঘটনা ঘটেনি। সম্পূর্ণ মিথ্যা ও বানোয়াট ঘটনা সাজিয়ে ফেসবুকে অপপ্রচার চালানো হয়।
আগের সরকারের আমলে বাংলাদেশ থেকে ভারতে ইলিশ উপহার (বিনামূল্যে) হিসেবে নয়, রপ্তানি পণ্য হিসেবেই যেতে। যদিও এ তথ্যটি এ সপ্তাহে ভুলভাবে ছড়ানো হয় বলে অনুসন্ধানে নিশ্চিত হয়েছে রিউোর স্ক্যানার।
৭ ও ৮ অক্টোবর প্রধান উপদেষ্টার পদ থেকে ড. ইউনূসের পদত্যাগের পিটিশনের নামে ফিশিং লিঙ্ক প্রচার করা হয়। রিউমার স্ক্যানার যাচাই করে দেখেছে, পিটিশনটি ভুয়া এবং লিঙ্কটি ক্ষতিকর। তাছাড়া এটি ব্যবহারকারীর তথ্য হাতিয়ে নেওয়ার মতো ক্ষতিও হতে পারে।
এদিকে, টাইম ম্যাগাজিনের ভুয়া সূত্রে কোটা সংস্কার আন্দোলনে ৩ হাজার ২০৪ জন পুলিশ নিহতের গুজব ছড়ানো হয়। ছাত্র আন্দোলনের সময় ছাত্রদের হাতে এসব পুলিশ সদস্য নিহত হয়েছেন শীর্ষক একটি ভুয়া তথ্য টাইম ম্যাগাজিনের বরাতে প্রচার করে একটি মহল। রিউমার স্ক্যানারের অনুসন্ধানে জানা যায়, এমন কোনো তথ্য ‘টাইম ম্যাগাজিন’ প্রকাশই করেনি। এটি সম্পূর্ণ ভুয়া ও মিথ্যা।
তবে গত সপ্তাহে চট্টগ্রামের পূজামণ্ডপে ইসলামি গানের ভিডিওটি কেউ কেউ এডিটেড (সম্পাদিত) বলে প্রচারণা চালালেও এটি আসল বলে জানিয়েছে রিউমার স্ক্যানার। তবে প্রতিমার সামনে ইসলামিক বাণী প্রচারের ভিডিওটি বাংলাদেশের নয়, ভারতের বলে অনুসন্ধানে উঠে এসেছে।
এএএইচ/এমআরএম/এএসএম