শারদীয় দুর্গোৎসবের ইতিহাস বহু প্রাচীন ও সমৃদ্ধ, যা হাজার বছরের পুরনো ঐতিহ্যের ধারক। এই উৎসবের উৎপত্তি ও বিকাশ মূলত প্রাচীন ভারতীয় ধর্ম, সমাজ, এবং সংস্কৃতির সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত। দেবী দুর্গাকে কেন্দ্র করে এই পূজা প্রাথমিকভাবে সনাতন ধর্মের এক গুরুত্বপূর্ণ আচার হলেও, কালের বিবর্তনে এটি বাঙালি সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়েছে।
Advertisement
প্রাচীন শাস্ত্র অনুযায়ী শারদীয় দুর্গোৎসব এবং ফসল কাটার সময়ের মধ্যে একটি গভীর সম্পর্ক বিদ্যমান। এটি মূলত ভারতীয় উপমহাদেশের প্রাচীন কৃষিনির্ভর সমাজব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত। শারদীয় দুর্গোৎসব আসলে শরৎ ঋতুতে পালিত হয়, যা ফসল কাটা বা "শারদীয় ফসল" সংগ্রহের সময়ের সঙ্গে মিলে যায়। এই ঋতুতে কৃষকরা সাধারণত তাদের কষ্টার্জিত ফসল ঘরে তুলে নেয় এবং তা উদযাপনের অংশ হিসেবে দেবী দুর্গার পূজা করা হয়।
দেবী দুর্গা মূলত শক্তির প্রতীক হিসেবে পূজিত হন এবং শাস্ত্র অনুযায়ী তিনি মহিষাসুর নামক অসুরের বিনাশকারী। এই পূজার মাধ্যমে প্রকৃতির সঙ্গে এক ধরণের পারস্পরিক সংযোগও প্রতিফলিত হয়। দেবী দুর্গা মূলত কৃষিকাজ এবং ফসল উৎপাদনের উর্বরতা ও সমৃদ্ধির প্রতীক হিসেবেও বিবেচিত হন। প্রাচীন যুগে যখন ফসল ভালো হতো, তখন কৃষকরা দেবীর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাতে পূজা করতেন, যাতে আগামী বছরের ফসলও ভালো হয় এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।
দেবী দুর্গার আগমন শরৎকালে হয়, যাকে ফসল কাটা ঋতুর শুরু হিসেবে দেখা হয়। এই সময় ফসল উৎপাদনের কাজ শেষের দিকে থাকে, এবং কৃষকরা তাদের কৃষিশ্রমের ফল হাতে পাওয়ার আনন্দে মেতে ওঠে। শারদীয় দুর্গাপূজা তখন হয়ে ওঠে এক ধরণের ধন্যবাদজ্ঞাপন এবং প্রাচীন সমাজে দেবীর আশীর্বাদ কামনার একটি রূপ। এটি প্রকৃতির প্রতি সম্মান জানানোর একটি উৎসব, যেখানে ফসল উৎপাদন এবং পূজা একে অপরের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
Advertisement
এছাড়াও, কৃষি ও পূজার এই সংযোগের পেছনে এক ধরণের অর্থনৈতিক ও সামাজিক দিকও কাজ করে। ফসল কাটার পর কৃষকদের হাতে কিছুটা অর্থনৈতিক সচ্ছলতা আসে এবং এই সময় তারা বিভিন্ন উৎসব ও পূজা উদযাপন করে। এতে দেবীর পূজা শুধু আধ্যাত্মিক নয়, বরং সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটেও গুরুত্ব বহন করে। এটি মূলত একটি ঋতুবিশেষের উদযাপন এবং একইসঙ্গে দেবীর পূজা ও ফসল কাটার সময়ের সঙ্গে সম্পর্কিত।
সুতরাং, প্রাচীন শাস্ত্র অনুযায়ী শারদীয় দুর্গোৎসব এবং ফসল কাটা ঋতুর মধ্যে সম্পর্ক হলো দেবী দুর্গার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানানো এবং ফসলের উর্বরতা ও সমৃদ্ধির আশীর্বাদ কামনা। এই সম্পর্ক দেবীকে শুধু শক্তি ও ধ্বংসের প্রতীক নয়, বরং উর্বরতা ও সাফল্যের দেবী হিসেবেও উপস্থাপন করে, যা কৃষিভিত্তিক সমাজব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।
দুর্গাপূজার প্রথম লিখিত উল্লেখ পাওয়া যায় প্রাচীন ভারতীয় পুরাণ ও ধর্মগ্রন্থে। পৌরাণিক কাহিনি অনুসারে, দেবী দুর্গা মহিষাসুর নামে এক অসুরকে বধ করে দেবতাদের রক্ষা করেন। এই দেবী দুর্গা হলেন শক্তির প্রতীক, যিনি শৃঙ্খলা ও ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা করেন। তার এই বিজয়কে কেন্দ্র করেই দুর্গাপূজার মূল ধারণা গড়ে ওঠে। দেবী দুর্গার এই রূপ বাঙালি হিন্দুদের কাছে মহাশক্তি ও মাতৃত্বের প্রতীক হিসেবে গৃহীত হয়।
দেবী দুর্গা কর্তৃক মহিষাসুরকে বধ করার ঘটনাটি হিন্দু পুরাণে এক বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ উপাখ্যান হিসেবে বিবেচিত। দেবী দুর্গা এখানে শুদ্ধ শক্তির প্রতীক, আর মহিষাসুর হলেন অশুভ শক্তির প্রতীক। এই কাহিনী মূলত ন্যায় ও অন্যায়ের চিরন্তন লড়াইয়ের একটি মূর্ত প্রতীক, যেখানে দেবী দুর্গা অসুরের অত্যাচারের অবসান ঘটিয়ে ন্যায় প্রতিষ্ঠা করেন।
Advertisement
পুরাণ অনুযায়ী, মহিষাসুর ছিল একজন অসুর, যার জন্ম অশুভ শক্তি থেকে। দীর্ঘ তপস্যার মাধ্যমে মহিষাসুর ব্রহ্মার কাছ থেকে একটি বিশেষ বর লাভ করে, যেখানে তাকে কোনো দেবতা বা মানুষ হত্যা করতে পারবে না। এই বর পাওয়ার পর মহিষাসুর পৃথিবী এবং স্বর্গে তার ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। সে দেবতাদের পরাজিত করে স্বর্গরাজ্য দখল করে নেয় এবং নিজেকে অপরাজেয় মনে করে।
মহিষাসুরের অত্যাচার এবং অহংকার যখন চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছায়, তখন দেবতারা ব্রহ্মা, বিষ্ণু এবং মহেশ্বরের কাছে সাহায্যের জন্য আবেদন করেন। দেবতারা মিলে একটি বিশেষ শক্তির সৃষ্টি করেন, যা দেবী দুর্গার রূপ ধারণ করে। দেবী দুর্গা হলেন সেই সংহত শক্তির প্রতীক, যিনি দেবতাদের শক্তিকে একত্র করে মহিষাসুরকে পরাজিত করার জন্য প্রেরিত হন।
দেবী দুর্গা মহিষাসুরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য সিংহে আরোহণ করে যুদ্ধে প্রবৃত্ত হন। মহিষাসুর বিভিন্ন রূপ ধারণ করে দেবীকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করে, কিন্তু দেবী তার প্রতিটি রূপকে পরাজিত করেন। অবশেষে মহিষাসুর মহিষের রূপ ধারণ করে দেবীর সঙ্গে চূড়ান্ত যুদ্ধে লিপ্ত হয়। দীর্ঘ যুদ্ধের পর দেবী দুর্গা মহিষাসুরকে বধ করেন এবং তার অশুভ শক্তির অবসান ঘটান।
মহিষাসুর বধের কাহিনী থেকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ নৈতিক শিক্ষা পাওয়া যায়। প্রথমত, এটি ন্যায় ও সত্যের বিজয়ের প্রতীক। মহিষাসুরের অহংকার এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে দেবী দুর্গা ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা করেন। দ্বিতীয়ত, এটি শক্তি এবং একাত্মতার উদাহরণ, যেখানে দেবতাদের সম্মিলিত শক্তি দেবী দুর্গার রূপে প্রকাশ পায় এবং অসুরের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে জয়লাভ করে।
শারদীয় দুর্গোৎসব শুধু একটি ধর্মীয় উৎসব নয়; এটি বাংলাদেশের সামগ্রিক সামাজিক সহাবস্থান ও বাঙালি সংস্কৃতির এক বহিঃপ্রকাশ, যেখানে ভিন্ন ভিন্ন ধর্মের মানুষ শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান করে এবং একে অপরের আনন্দ ও দুঃখ ভাগাভাগি করে।
তৃতীয়ত, মহিষাসুরের বধ কেবল এক পাপিষ্ঠের পতন নয়, বরং তা অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে শুভ শক্তির চিরন্তন সংগ্রামের প্রতিফলন। এই কাহিনী মানুষের জীবনেও প্রযোজ্য, যেখানে অন্যায়, অত্যাচার এবং অহংকারের বিরুদ্ধে সঠিক পথে থেকে সংগ্রাম করা এবং জয়লাভ করা উচিত।
সুতরাং, দেবী দুর্গা কর্তৃক মহিষাসুর বধের মূল কারণ হলো ন্যায় প্রতিষ্ঠা, অশুভ শক্তির বিনাশ, এবং পৃথিবীতে শান্তি ও সুস্থিতি ফিরিয়ে আনা। এটি এমন একটি কাহিনী যা মানব সমাজে সত্য, ন্যায় এবং শুদ্ধতার গুরুত্বকে প্রাধান্য দেয়।
শারদীয় দুর্গাপূজার বিশেষ গুরুত্ব পাওয়ার পিছনে আছে শারদ ঋতুর বিশেষ প্রভাব। পৌরাণিক কাহিনী অনুযায়ী, আদিতে দুর্গাপূজা বসন্তকালে করা হতো, যা "বসন্তি পূজা" নামে পরিচিত। কিন্তু রামায়ণে উল্লেখ আছে, শ্রীরামচন্দ্র শারদ ঋতুতে দুর্গাকে পূজা করে তার আশীর্বাদ প্রার্থনা করেন রাবণের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জয়লাভের জন্য। এই পূজাকেই "অকালবোধন" বলা হয়, যা পরে শারদীয় দুর্গোৎসব হিসেবে জনপ্রিয়তা লাভ করে।
ঐতিহাসিক দিক থেকে দেখা যায়, ১৬শ শতাব্দীতে বাংলার জমিদার ও রাজপরিবারগুলোর উদ্যোগে দুর্গাপূজা ধীরে ধীরে এক বিশাল আকার ধারণ করে। এ সময় বাংলার বিভিন্ন জমিদাররা তাদের ক্ষমতা ও প্রতিপত্তির প্রদর্শন করতে দুর্গাপূজার আয়োজন করতেন। বিশেষ করে নদীয়া, কৃষ্ণনগর, ও কাশিমবাজারের রাজপরিবারগুলো দুর্গাপূজাকে বর্ণাঢ্য ও রাজকীয় আকারে উদযাপন করত। এই সময় থেকেই দুর্গাপূজা সমাজের অভিজাত শ্রেণির উৎসব হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠে।
১৮শ ও ১৯শ শতাব্দীতে ব্রিটিশ শাসনামলে কলকাতায় দুর্গাপূজা আরও ব্যাপকভাবে জনপ্রিয় হয়। সেই সময়ে বাঙালি ধনী ও শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সমাজ দুর্গাপূজাকে ঘিরে সামাজিক মেলবন্ধন ও সংস্কৃতির বিকাশ ঘটায়। তখন থেকে বারোয়ারি বা সার্বজনীন দুর্গাপূজার প্রথা শুরু হয়, যেখানে ব্যক্তিগত বাড়ির পরিবর্তে সমাজের সকলের জন্য উন্মুক্ত পূজার আয়োজন শুরু হয়।
বারোয়ারি পূজার সূচনা বাঙালি সংস্কৃতির একটি নতুন ধারা তৈরি করে, যা শুধুমাত্র ধর্মীয় উৎসব নয়, বরং সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক মিলনক্ষেত্রে পরিণত হয়। কলকাতার বাবু সংস্কৃতির সময় এই উৎসবের আকার ও ব্যাপ্তি বাড়তে থাকে, এবং শিল্প-সংস্কৃতির মেলবন্ধন দুর্গাপূজার অংশ হয়ে ওঠে। প্রতিমা নির্মাণ, মণ্ডপ সজ্জা, এবং পূজার আচার-অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বাঙালির নান্দনিকতা ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের এক অনন্য প্রদর্শনী ঘটতে শুরু করে।
আধুনিককালে, দুর্গাপূজা একটি সর্বজনীন উৎসব হিসেবে উদযাপিত হয়, যেখানে ধর্মীয়, সামাজিক, এবং সাংস্কৃতিক উপাদানগুলি একত্রে মিলে যায়। বাংলাদেশ ও ভারতের বাঙালি সমাজে শারদীয় দুর্গোৎসব আজও একই রকম উজ্জ্বলতা ও আবেগের সঙ্গে উদযাপন করা হয়।
শারদীয় দুর্গোৎসব বাঙালি সমাজে একটি বিশেষ তাৎপর্য বহন করে, যা শুধু ধর্মীয় উৎসব হিসেবেই সীমাবদ্ধ নয় বরং এর সামাজিক ও সাংস্কৃতিক গুরুত্বও বিশাল। এটি হিন্দু সম্প্রদায়ের অন্যতম প্রধান ধর্মীয় অনুষ্ঠান হলেও, বাংলাদেশ ও ভারতের বাঙালি সংস্কৃতির একটি বিশেষ অঙ্গ হয়ে উঠেছে। দুর্গাপূজা বছরের সেই সময় যখন ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে মানুষ একত্রিত হয়, যা সামাজিক ঐক্য ও সম্প্রতি গড়ে তোলার ক্ষেত্রে একটি শক্তিশালী মাধ্যম হিসেবে কাজ করে।
দুর্গাপূজার সামাজিক গুরুত্বের প্রথম দিকটি হলো, এটি একটি সম্মিলিত উৎসব। দুর্গাপূজার সময় শুধু হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ নয়, অন্যান্য ধর্মের মানুষও মণ্ডপে এসে অংশগ্রহণ করে। শহর থেকে শুরু করে গ্রামাঞ্চলে পর্যন্ত, দুর্গোৎসবের আয়োজন একটি সমাজিক মেলবন্ধনের ক্ষেত্র তৈরি করে। এটি এমন একটি সময়, যখন সবাই একসঙ্গে উৎসব উদযাপন করে, যা সামাজিক সুসম্পর্ক এবং পারস্পরিক সৌহার্দ্যের প্রতীক হিসেবে পরিগণিত হয়।
দুর্গোৎসবের সাংস্কৃতিক গুরুত্বের দিকে তাকালে দেখা যায়, এটি বাঙালি সংস্কৃতির বিভিন্ন দিককে প্রতিফলিত করে। দুর্গাপূজার সময় মণ্ডপগুলোতে যে শৈল্পিক সজ্জা ও প্রতিমা নির্মাণ করা হয়, তা শুধু ধর্মীয় নয়, সাংস্কৃতিক সৃষ্টিশীলতারও একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ। প্রতিমা গড়ার শিল্পকলা, মণ্ডপ সজ্জার কারুকার্য, এবং পূজার আচার-অনুষ্ঠানের প্রতিটি ধাপে বাঙালি সংস্কৃতির গভীর শেকড় স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়। প্রতিমা তৈরিতে মাটির ব্যবহার, কুমারদের নৈপুণ্য, এবং পূজার সংগীত-সংস্কৃতির মিশ্রণ বাঙালির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রতীক হয়ে উঠেছে।
দুর্গোৎসবকে কেন্দ্র করে যে সামাজিক মেলামেশা এবং সাংস্কৃতিক বিনিময় ঘটে, তা সমাজে সংহতি এবং ঐক্যের বার্তা দেয়। উৎসবের সময়ে নাটক, গান, নৃত্য, আলোকসজ্জা, এবং মেলা আয়োজিত হয়, যা সকল বয়সের এবং বিভিন্ন শ্রেণির মানুষকে একত্রিত করে। এই সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডগুলোর মাধ্যমে বাঙালি সংস্কৃতির সমৃদ্ধ ঐতিহ্য রক্ষা ও প্রচারিত হয়। এছাড়া, দুর্গাপূজার সময় গ্রামীণ মেলা এবং হস্তশিল্প প্রদর্শনীও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, যা স্থানীয় অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে।
শারদীয় দুর্গোৎসব কেবলমাত্র ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি বাঙালি সংস্কৃতির মেলবন্ধন ও সামাজিক সহাবস্থানের এক উজ্জ্বল উদাহরণ। এই উৎসব শুধুমাত্র ধর্মীয় পূজা নয়, বরং এটি বাঙালি ঐতিহ্যের একটি বিশাল অংশ, যেখানে ধর্ম, সংস্কৃতি, ও সামাজিক বন্ধন পরস্পরের সঙ্গে মিলিত হয়। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে দুর্গোৎসব কেবল হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; বরং এর প্রভাব সারা দেশের সংস্কৃতি এবং সামাজিক জীবনধারায় গভীরভাবে প্রতিফলিত হয়।
দুর্গাপূজার সময় বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে যেভাবে সার্বজনীনভাবে উৎসবটি উদযাপিত হয়, তা একটি গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক সহাবস্থানের প্রতীক। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ হওয়া সত্ত্বেও, বাংলাদেশে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে মানুষ শারদীয় দুর্গোৎসবে অংশ নেয় এবং এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক উৎসব হিসেবে বিবেচিত হয়। এটি সম্প্রীতি ও সহমর্মিতার বার্তা দেয়, যেখানে বিভিন্ন ধর্মের মানুষ একসঙ্গে মিলিত হয়ে এই আনন্দঘন সময়ে শামিল হয়।
বাংলাদেশের বাঙালি সংস্কৃতিতে এই উৎসবের সময় কেবল হিন্দু সম্প্রদায় নয়, মুসলিম, খ্রিস্টান ও অন্যান্য সম্প্রদায়ের মানুষও একসঙ্গে দুর্গাপূজার আনন্দ ভাগাভাগি করে নেয়। বিভিন্ন স্থানে মণ্ডপ পরিদর্শন, পূজার আনুষ্ঠানিকতা, এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানগুলোতে সকল ধর্ম ও বর্ণের মানুষ অংশগ্রহণ করে। এটি দেখায় যে, শারদীয় দুর্গোৎসব ধর্মীয় উৎসবের সীমা পেরিয়ে বাঙালি জাতির ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির একটি অংশ হয়ে উঠেছে, যা একে অপরকে সংযুক্ত করে।
দুর্গোৎসব বাংলাদেশের সামাজিক জীবনে একটি গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক বিন্দু, যেখানে শিল্প, সংগীত, এবং সংস্কৃতির বহুমাত্রিক রূপ ফুটে ওঠে। প্রতিমা তৈরি থেকে শুরু করে মণ্ডপ সাজানো, এবং নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান – সবই বাঙালি নান্দনিকতার প্রতীক। বিভিন্ন স্থানে আয়োজিত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে নাটক, নাচ, গান ইত্যাদির মাধ্যমে বাঙালি সংস্কৃতি আরও শক্তিশালী হয় এবং এটি সকলের জন্য এক সাংস্কৃতিক মিলনমেলায় পরিণত হয়।
এছাড়া দুর্গোৎসব বাংলাদেশে একটি সামাজিক ঐক্য এবং সংহতির প্রতীক হিসেবে কাজ করে। সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে কখনো কখনো উত্তেজনা দেখা দিলেও, দুর্গোৎসবের সময় ধর্মীয় সৌহার্দ্য ও মিলনের এক অনন্য পরিবেশ তৈরি হয়, যা বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্প্রীতির বার্তা দেয়। এটি প্রমাণ করে যে, বাংলাদেশে ধর্মীয় বৈচিত্র্য থাকলেও, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক মেলবন্ধন এতটাই দৃঢ় যে সবাই একে অপরের উৎসবে শামিল হতে পারে।
তাই, শারদীয় দুর্গোৎসব শুধু একটি ধর্মীয় উৎসব নয়; এটি বাংলাদেশের সামগ্রিক সামাজিক সহাবস্থান ও বাঙালি সংস্কৃতির এক বহিঃপ্রকাশ, যেখানে ভিন্ন ভিন্ন ধর্মের মানুষ শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান করে এবং একে অপরের আনন্দ ও দুঃখ ভাগাভাগি করে।
লেখক: গবেষক ও উন্নয়নকর্মী।
এইচআর/জেআইএম