সাজ্জাদ নকীব
Advertisement
অদ্ভুত এক সমীকরণে জীবন চলে নগরের অধিবাসীদের। কাউকে হারিয়ে যেতে হয়, আবার কেউ ফিরেও আসে। জীবনযাপনে কষ্ট আসে কিন্তু সময়ের নিয়মে হেরফের হয় না। বয়ে চলা নিয়মের ভেতর রাসু, রিনি, সমু আর ঝিনি এবং তাদের আশেপাশের মানুষজন ক্রমশ এগিয়ে যেতে থাকে। সোবহান সাহেব এবং মায়মুনা বেগমের দীর্ঘ অপেক্ষার যেন কোনো শেষ নেই। কিন্তু হঠাৎ রিনি কেন ছক কষে অন্য এক জীবন ধারণের? বাস্তবতা নাকি মোহ, নাকি ত্যাগ; কোনটিকে ঘিরে চলে এই উপন্যাসের চরিত্রগুলোর জীবনের ঘটনাপ্রবাহ?
বলছিলাম ঔপন্যাসিক শারমিন আহমেদের উপন্যাস ‘নাগরিক জলপত্র’র কথা। বইটি মূলত দুই খণ্ডের নাগরিক জীবনের গল্প নিয়ে লেখা উপন্যাসের প্রথম খণ্ড। একটি পরিবারের গল্প। গল্পের শুরুতেই আমরা দেখতে পাই, রিনি নামের একটি মেয়ে হাতে একটা সুটকেস নিয়ে তার বাবার বাড়িতে ফিরে আসে। যে নিজেই পরিবারের বিরুদ্ধে গিয়ে দুই বছর আগে বিয়ে করছিল মাকসুদ নামের এক সন্ত্রাসীকে।
রিনির ফিরে আসায় পাঠকের মতোই তার মা-বাবার মনেও প্রশ্ন জেগেছিল, কেন ফিরে এলো রিনি? এসব জল্পনা-কল্পনার মধ্য দিয়েই এগিয়ে চলে উপন্যাসের গল্প। রাসুর প্রবল উপস্থিতি টের পাই আমরা উপন্যাসে। যে মূলত নিখোঁজ। কেউই জানে না সে বেঁচে আছে না মারা গেছে। সোবহান সাহেব, মায়মুনা বেগম, রিনি, সামু ও ঝিনির বারবার স্মৃতিচারণে ভেসে ওঠে রাসু নামের এই ছেলের গল্প।
Advertisement
রিনির বিয়ে এবং রাসু নিখোঁজ হওয়ার পর মধ্যবিত্ত পরিবারের সমস্ত ভার এসে পড়ে সামুর ওপর। সে প্রায়ই সমস্ত দায়িত্ব সামলাতে হিমশিম খায়। সে নিজেই নিজের ওপর বিরক্ত হয়ে যায় একসময়। রিনি ফিরে এসে পরিবারের সমস্ত দায়িত্ব নিয়ে নেয় তার কাঁধে। সমু কিছুটা স্বস্তি ফিরে পায় জীবনে।
ঝিনি বরাবরই একটু অভিমানী আর সাধারণ ঘরানার মেয়ে। নাগরিক বিভিন্ন দহন, তার বড় ভাইয়ের চলে যাওয়া, বড় আপুর বিয়ে এবং হঠাৎ করে ফিরে আসা, পরিবারের বিভিন্ন ঝামেলার মধ্যে তার জীবন চলছিল সাধারণ ভাবেই। একদিন হঠাৎই বিয়ে ঠিক হয় তার মেজো ফুপুর ছেলে মিজানের সাথে। এমন না সে মিজানকে ভালোবাসে কিন্তু সে তার পরিবারের কাউকে বারণও করে না। হয়তো নাগরিক জীবনের এতো ঝামেলার মধ্যে সে আর বাড়তি কোনো ঝামেলা দিতে চায় না। কিছুদিন পরেই মিজানের সাথে বিয়ে হয় ঝিনির এবং সে বেশ সুখেই সংসার শুরু করে।
আরও পড়ুনআল মাহমুদের সোনালি কাবিন: সৃষ্টিতে বিস্ময়আশার ছলনে ভুলি: মাইকেল মধুসূদনের জীবনগল্পের একপার্যায়ে আগমন ঘটে সামাদ মিয়া নামের একটি চরিত্রের, সাথে তার বোন রূপাই। সোবহান সাহেব সামাদ মিয়ার দুর্সম্পর্কের মামা। একদিন সামাদ তার সৎ বোনকে নিয়ে হাজির হয় রিনিদের বাসায়। তার বাবা রূপাইকে বিয়ে দিতে চায় এক বয়স্ক লোকের সাথে। যে কারণে সে তার বোনকে নিয়ে পালিয়ে আসে সোবহান সাহেবের কাছে। রূপাই সদ্য কৈশোরে পা রাখা এক তরুণী। সমুকে দেখে রূপাই ধীরে ধীরে প্রেমে পড়ে যায় তার।
সমুরও হয়তো প্রথমে ভালো লাগে রূপাইকে কিন্তু হঠাৎই সে তাসনুভার প্রতি প্রবল টান লক্ষ্য করে। তাসনুভা সমুর ভার্সিটিরই জুনিয়র। যে অনেক আগে থেকেই পছন্দ করে সামুকে। কিন্তু সামুর আগ্রহহীনতায় সে আর বলে উঠতে পারে না। তাসনুভার মা অসুস্থ বেশ কয়েক বছর ধরে। বাবা জুয়াড়ি এবং নেশাখোর। আপন বলতে শুধু একটা ছোট ভাই, তাসু। তাসনুভার মা মারা যাওয়ার পর সামু সিদ্ধান্ত নেয়, সে তাসনুভাকে বিয়ে করবে এবং বাড়িতে জানায় সে কথা। কেউ কোনো আপত্তি করে না এ ব্যাপারে। শুধু রিনি বুঝতে পারে রূপাইয়ের মনে ঝড় বয়ে যাচ্ছে প্রবল বেগে।
Advertisement
‘নাগরিক জলপত্র’ একটি সামাজিক উপন্যাস। এখানে নাগরিক জীবনের অনেক সাধারণ ঘটনাকে তুলে ধরা হয়েছে অসাধারণ রূপে। উপন্যাসটি এক কথায় চমৎকার। নাগরিক জীবনের বিভিন্ন টানাপোড়েন বিশেষত মানবিক বিভিন্ন আবেগ-অনুভূতি ফুটিয়ে তোলা হয়েছে দারুণ ভাবে। ঠিক উপন্যাসের চরিত্রগুলোর মতোই আমাদেরও নাগরিক জীবনে এমন অনেক ঘটনা ঘটে, যে ঘটনাগুলো আমাদের সবার জীবনেই এক নস্টালজিয়ার বহিঃপ্রকাশ।
রাসু কি আসলেই বেঁচে ছিল? শেষমেশ রিনি, সামু, ঝিনি এবং রূপাইয়ের জীবনে কী হলো, তা জানতে হলে অবশ্যই পাঠককে পড়তে হবে শারমিন আহমেদের লেখা ‘জলমগ্নতার দহন’ বইটি। শারমিন আহমেদের অন্য বইয়ের মধ্যে ‘আমার কোনো তাড়া নেই’, ‘বিষুবসংক্রান্তি’, ‘ওরা কেউ না’, ‘কেইস হিস্ট্রি’, ‘ক্রীতদাস’ উল্লেখযোগ্য।
বইয়ের নাম: নাগরিক জলপত্র (প্রথম খণ্ড)লেখক: শারমিন আহমেদ প্রকাশনী: কিংবদন্তী পাবলিকেশন প্রচ্ছদ: সঞ্চিতা সৃষ্টিমূল্য: ৩০০ টাকা।
এসইউ/জেআইএম