অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের আমন্ত্রণে বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা শনিবার প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে আলোচনায় মিলিত হয়েছিলেন।দেশ পরিচালনায় এবং কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত জানার জন্য প্রধান উপদেষ্টার এই প্রচেষ্টা সঙ্গত কারণেই মানুষকে কৌতূহলী করেছে। এই সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশের অতীতের কেয়ারটেকার গভর্নমেন্টগুলোর অনেকটা পার্থক্য রয়েছে। অতীতের সরকারগুলোর সামনে একমাত্র লক্ষ্য ছিলো একটি সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান। তাদের সংস্কার চিন্তা করতে হয়নি। এমনকি তারা নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্যও প্রয়োজনীয় আইন বিধি-বিধান তৈরি পেয়েছে।
Advertisement
কিন্তু বর্তমান সরকারকে গ্রহণযোগ্য সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় সংস্কারের মতো গুরু দায়িত্বও পালন করতে হবে। আগের কেয়ারটেকার সরকারগুলো নিয়মিত কাজগুলো ছাড়া অন্যান্য কাজ করতে বাধ্য ছিলো না।কিন্তু বর্তমান সরকারকে একটি নির্বাচিত সরকারের মতো সর্ববিষয় পরিচালনা করতে হচ্ছে। আরও একটি ভিন্ন দিক হচ্ছে এই সরকার একটি বিপ্লবের ফসল। তাদেরকে নিয়মিত কাজের বাইরে আগামী রাজনৈতিক সরকারের দিকনির্দেশনাও তৈরি করতে হচ্ছে।
দায়িত্বের ক্ষেত্র বেশি হলেও সরকারের আয়তন ছোট। ফলে তাদের কাজের চাপ বেশি। এই সরকারে দেশের সেরা সেরা মানুষগুলোকে এই উপদেষ্টা পরিষদে রাখা হয়েছে,তবে রাজনীতির ক্ষেত্রে তাদের অভিজ্ঞতা তেমন নেই। যে কারণে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জনে এগিয়ে যাওয়ার জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত গ্রহণ জরুরি। সেই বিবেচনাতেই প্রধান উপদেষ্টা এবারও রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে এভাবে মিলিত হয়েছেন।
রাজনৈতিক দলগুলো অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সামনে অগ্রাধিকারযোগ্য পদক্ষেপ হিসেবে সরকার কি কি করতে পারে সেগুলোর মোটামুটি একটি খতিয়ান উপস্থিত করেছে। বিশেষ করে বড় রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপি নির্বাচন, নির্বাচন কমিশন, নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কারের ওপর অধিক গুরুত্ব দিয়েছে। এক্ষেত্রে গত রোববার সরকারের একজন উপদেষ্টার বক্তব্যের কথাও স্মরণ করা যেতে পারে। তিনিও বলেছেন, নির্বাচন ব্যবস্থার সংস্কার অত্যন্ত জরুরি।
Advertisement
এখানে লক্ষ্যণীয় যে কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন গত ৫ সেপ্টেম্বর পদত্যাগ করার পর নির্বাচন কমিশন শূন্য হয়ে পড়েছে। মাসাধিককাল গত হওয়ার পরও নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন হয়নি এখনও। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নির্বাচন কমিশন গঠনের চেয়ে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কারের বিষয়টি অধিক গুরুত্বপূর্ণ হওয়ার কারণেই হয়তো সরকার নির্বাচন কমিশন গঠনের দিকে তড়িঘড়ি করে এগিয়ে যাচ্ছে না। প্রচলিত নির্বাচন ব্যবস্থা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই বিতর্ক আছে। অতীতে দেখা গেছে নির্বাচন কমিশন যে সরকারই গঠন করুক না কেন সেখানে রাজনৈতিক দলগুলোর আস্থার ঘাটতি থেকেই যায়। যে দল ক্ষমতায় থাকে তারা তাদের পছন্দ মাফিক লোক দিয়ে কমিশন গঠন করে।
নির্বাচন শেষে পরাজিত দলগুলো নির্বাচন কমিশনকে সমালোচনা করে। এমনকি সরকারের বাইরে থাকা দলগুলো নির্বাচনের আগেই তাদের বিষয়ে আপত্তি জানিয়ে থাকে। নির্বাচন শেষে তারা তাদের বক্তব্যই যে ঠিক ছিলো তাও প্রমাণে চেষ্টা করে থাকে। নির্বাচনী আইনগুলো নিয়েও সমালোচনা হয়, আচরণবিধি নিয়ে তর্ক-বিতর্ক হয়। বিশেষ করে প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলোকে প্রায় নিয়মিত অভিযোগ করতে শোনা যায়-নির্বাচনে লেবেল প্লেয়িং ফিল্ড দেওয়া হয় না। এটা মূলত দলীয় সরকার ক্ষমতায় থেকে নির্বাচন হলে বেশি হয়। গত কয়েকটি নির্বাচনে মনে হয় নির্বাচনে কারচুপির চেয়ে এই অভিযোগটি কম উচ্চারিত হয়নি। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানকালে তুলনামূলক এই অভিযোগটি অনুপস্থিত থেকেছে।
রাজনৈতিক দলগুলোর প্রস্তাব অনুযায়ী হয়তো সরকার এগিয়ে যাবে। কারণ রাজনৈতিক সরকার প্রতিষ্ঠাই তাদের মূল লক্ষ্য। সেই লক্ষ্য অর্জনের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের ক্ষেত্রে কালক্ষেপণ না করাই উত্তম বলে মনে করি।
তারপর আছে নির্বাচনে কারচুপি, ব্যালট ছিনতাইসহ নানা অপকর্মের খতিয়ান। এই অভিযোগ দলীয় সরকারের অধীনে কিংবা নির্দলীয় সরকারের অধীনে যে কোনো অবস্থায়ই নির্বাচন হোক না কেন,সবসময়ই হয়ে থাকে। এই মুহূর্তে নির্বাচনী ট্রাইব্যুনাল বিষয়েও বলতে হয়। নির্বাচনী ট্রা ট্রাইব্যুনালে কোনো অভিযোগ দায়ের হলে এমনও দেখা যায়-সরকারের মেয়াদান্তে সেই অভিযোগের ফয়সালা হয়। অভিযোগকারী রায়ের দীর্ঘসূত্রিতার কারণে মনে ক্ষোভ থাকার পরও পারতপক্ষে কোনো অভিযোগ দায়ের করতে আগ্রহ পায় না।
Advertisement
নির্বাচনে কারচুপি একটি সাধারণ অভিযোগ। প্রায় প্রতিটি নির্বাচনের ক্ষেত্রে কমবেশি এই অভিযোগ হবেই। অন্তত বিগত সময়ের নির্বাচনগুলোর দিকে নজর দিলে সেটি দেখা যায়। প্রশ্ন হচ্ছে লেবেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করতে হলে সরকারের সুবিধাভোগী কোনো পক্ষ যদি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে থাকে তাহলে লেবেল প্লেয়িং ফিল্ড আশা করাটা দুরূহ। সেই কথাটি দীর্ঘদিন ধরে রাজনৈতিক দলগুলো বলে আসছে। কিন্তু সাংবিধানিকভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল হয়ে যাওয়ায় মানুষের চাওয়াটা পূরণ হয়নি। অতীতের নির্বাচনগুলো বিশ্লেষণ করে সুষ্ঠুভাবে নির্বাচনী প্রচারণায় সবাই যেন সুযোগ পায় সেই ব্যবস্থাটি করতে হবে এই সরকারকেই। যে কারণে হয়তো বিএনপি মহাসচিব নির্বাচন বিষয়টিকে ১নম্বর অগ্রাধিকার তালিকায় রাখার জন্য অন্তবর্তীকালীন সরকারের কাছে উপস্থাপন করেছেন। যা তাদের নিয়মিত বক্তৃতা-বিবৃতিতেও বার বার উল্লেখ করে আসছে।
নির্বাচন কমিশনকে জবাবদিহিতার আওতায় আনার বিষয়টি নিয়েও কথা হয়। ভবিষ্যতে নির্বাচন কমিশনের দলীয় লেজুড়বৃত্তি বন্ধ করতে হলে বিগত সময়ের কমিশনগুলোর কাজের মূল্যায়ন প্রয়োজন। তাদের বিরুদ্ধে দলীয় লেজুড়বৃত্তির যে অভিযোগ আনা হয় সেগুলো খতিয়ে দেখা দরকার। এবং তাদের জবাবদিহিতার ব্যবস্থা করাও প্রয়োজন। বিএনপি সেই বিষয়টিও আলোচনায় এনেছে।
বর্তমান সরকারের উপদেষ্টাদের একেকজনকে অধিকসংখ্যায় মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়ার কারণে সরকারে কাজের স্থবিরতার বিষয়টি শুধু বিএনপিই নয় অন্যদেরও করতে শোনা যায়। এক্ষেত্রে বিএনপির মতো সাবেক ভিপি নুরুল হক নূর-এর মন্তব্যও একই। অবশ্য নূর চেয়েছেন উপদেষ্টা পরিষদকে সর্বদলীয় আদলে গঠন করা হোক। বিপ্লবে অংশগ্রহণকারী প্রতিটি দল থেকে উপদেষ্টা নিয়োগ করে মন্ত্রণালয়গুলোকে সঠিকভাবে পরিচালনার পরামর্শ অন্য কয়েকটি দলেরও মধ্যেও আলোচনা হয়েছে। তখন হয়তো অন্তর্বর্তী সরকারকে বিপ্লবী সরকার বলা যেতে পারে।
গণতন্ত্র মঞ্চ সরকারকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য নিয়মিত আলোচনার ওপর জোর দিয়েছে। যা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ইতোমধ্যে কার্যকরও করেছে। কিন্তু সাপ্তাহিক ভিত্তিতে এটা আদৌ সম্ভব কিনা দেখার বিষয় আছে।বামদলগুলোর পরামর্শে সরকারকে জনসম্পৃক্ত হওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। এই মুহূর্তে রাজনৈতিক সরকারগুলোর মতো অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের জন্য কাজটি কঠিন। কিন্তু সরকারের জন্য বিষয়টিকে গুরুত্বহীন ভাবার সুযোগ নেই। সেই ক্ষেত্রে সরকারের সহযোগী হিসেবে রাজনৈতিক শাখা গঠনের বিষয়টি ভাবা দরকার। যাদের কাজ হবে সরকারের হয়ে জনসংযোগের কাজটি করতে পারে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এই পর্যন্ত রাজনৈতিক সরকারের আদলে তাদের কর্মকাণ্ড তুলে ধরার জন্য নিজেরাই চালিয়ে যাচ্ছে। আমার মনে হয় সরকারকে ভিন্ন চিন্তা করা দরকার। সেক্ষেত্রে সরকারের আয়তন বৃদ্ধি পেলে সমস্যা কেটে যাবে।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কর্মপরিকল্পনা সম্পর্কেও রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টজন বিভিন্ন সময় জানতে চেয়েছেন। নিশ্চয়ই নির্দিষ্ট রূপরেখা নিয়েই সরকার এগিয়ে যাচ্ছে। স্বচ্ছতা আনার প্রয়োজনে সরকারকে তা জনসমক্ষে প্রকাশ করা উচিত। সরকারের গৃহীত অগ্রাধিকার ভিত্তিক কর্মসূচিগুলো এখনও স্পষ্ট নয়। সংস্কার কমিশনগুলো কাজ শুরু করার আগেই তারা বলেছে, তারা শুধু প্রস্তাব তৈরি করে সরকারকে দেবে।
একজন দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি বলেছেন তাদের প্রস্তাবনা তৈরির সময় তারা কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা করবেন না। তাদের কাজের সুবিধার্থে মনে করি রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে তাদের আলোচনার প্রয়োজন আছে। তাহলে নিজেদের প্রস্তাবগুলো আরও সমৃদ্ধ হওয়ারই সম্ভাবনা আছে। অন্তত রাজনৈতিক বিতর্ক এড়িয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে এটি সহযোগিতা করবে।
রাজনৈতিক দলগুলোর প্রস্তাব অনুযায়ী হয়তো সরকার এগিয়ে যাবে। কারণ রাজনৈতিক সরকার প্রতিষ্ঠাই তাদের মূল লক্ষ্য। সেই লক্ষ্য অর্জনের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের ক্ষেত্রে কালক্ষেপণ না করাই উত্তম বলে মনে করি।
লেখক: সাংবাদিক,শিশুসাহিত্যিক ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষক।
এইচআর/জিকেএস