দেশজুড়ে

সুস্থ হয়ে গেলেও নিতে আসেন না স্বজনরা, আক্ষেপ রোগীদের

<> ভর্তির সময় ভুল ঠিকানা দিয়ে যান অনেকে<> খোঁজ না নেওয়ার অন্যতম কারণ পারিবারিক সম্পত্তি হাতিয়ে নেওয়া<> হতাশা থেকে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন অনেকে

Advertisement

‘আমি সুস্থ হয়ে গেছি। বাড়ির লোকজন নিতে আসে না। আমার বাড়িতে একটু খবর দিবেন তো...’—পাবনার হেমায়েতপুরে ৫০০ শয্যা দেশের একমাত্র বিশেষায়িত মানসিক হাসপাতালে গেলে এরকম কথা হাসপাতালের প্রায় প্রতিটি ওয়ার্ড থেকেই শোনা যায়। অনেকের ধারণা, মানসিক রোগীরা এমন বলেই থাকেন। কিন্তু আসলেই অনেকে সুস্থ এখন। বাড়ি ফিরতে পারছেন না শুধু তাদের স্বজনদের অনীহার কারণে।

সুস্থ হওয়ার পরও নিজ বাড়িতে যেতে পারছেন না পাবনা মানসিক হাসপাতালের ২৪ জন। দীর্ঘ মেয়াদে ভর্তি আছেন আরও ২৬ জন। তাদের প্রতীক্ষা কেউ তাদের ঠিকই একদিন নিতে আসবেন।

যারা সুস্থ হয়ে গেলেও পরিবার ফেরত নিচ্ছে না কিংবা ভুল ঠিকানার কারণে দিনের পর দিন রয়ে গেছেন তারা হলেন ইতেমাতুদ্দৌলা (৪৭), শাহজাহান আলম (৪৬), মহিউদ্দিন (৪৩), মোখলেছুর রহমান (৫৬), ডলি (৪১), জাকিয়া সুলতানা (৩০), সিপ্রা রানী (৫২), শাহানারা আকতার (৫১), আরজু বেগম (৪৫), নাজমা আক্তার (৩৬), কাজী খোদেজা (৫৮), নাজমা নিলুফার (৫৮), নাইমা চৌধুরী (৩৪), আমেনা খাতুন বুবি (৫৩), গোলজার বিবি (৫২), অনামিকা বুবি (৪৪) ও সাহিদা (৫৩)।

Advertisement

মাহবুব আনোয়ার নামের এক রোগী ২০ বছর ধরে এখানে চিকিৎসাধীন ছিলেন। ২০১৫ সালে ৫৩ বছর বয়সে তিনি মারা যান। ভুল ঠিকানার কারণে তাকেও বাড়িতে পাঠানো সম্ভব হয়নি। ছকিনা নামের আরেক রোগী ১২ বছর হাসাপাতালে থেকে ২০১৫ সালে ৪৭ বছর বয়সে মারা যান।

হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, ২০১৯ সালের ১৮ আগস্ট আদালত ১৫ জন রোগীর সঠিক ঠিকানা নির্ণয় করেন। তাদের শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা সাপেক্ষে আইনানুগ অভিভাবকের কাছে হস্তান্তরের নির্দেশ দেন। এর আগে জাতীয় পত্রিকায় ছবিসহ সাতজন রোগীর বিজ্ঞপ্তিও দেওয়া হয়। কিন্তু এখন পর্যন্ত তাদের সঠিক ঠিকানা খুঁজে পাওয়া যায়নি। ঠিকানা খুঁজে না পাওয়া চারজন রোগী মারা গেছেন হাসপাতালেই।

বর্তমানে হাসপাতালে ভুল ঠিকানায় ভর্তি হওয়া রোগীর সংখ্যা ২৪। আর দীর্ঘ মেয়াদে ভর্তি রোগীর সংখ্যা ২৬। তাদের মধ্যে কেউ ২৭ বছর, কেউ ১৭ বছর, কেউ ১০ বছর, আবার কেউ পাঁচ বছর ধরে ভর্তি আছেন। এখন পর্যন্ত পাবনা হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা সাড়ে চারশ।

হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানায়, ২৪ জন রোগী নিয়ে তারা পড়েছেন মহাবিপাকে। এদের চিকিৎসা খরচ মেটানো এবং শয্যা খালি না করার কারণে ওই শয্যায় নতুন রোগীও ভর্তি করা যাচ্ছে না।

Advertisement

হাসপাতাল সূত্র বলছে, মানসিক রোগীদের আত্মীয়-স্বজন এমনকি তাদের ভাই-বোনরাও পরিচয় দিতে লজ্জাবোধ করেন। এর কিছু সামাজিক কারণ ও কুসংস্কার রয়েছে। অনেকে পারিবারিক সম্পত্তি হাতিয়ে নেওয়ার জন্যও মানসিক রোগীদের দূরে সরিয়ে রাখেন। এক্ষেত্রে বেশিরভাগ পরিবার একবার রোগী এখানে রেখে যেতে পারলে আর তার খোঁজ নিতে চায় না। অনেকে ভুল ঠিকানায় রোগী ভর্তি করিয়ে দিয়ে যান। ফলে রোগী সুস্থ হওয়ার পর কিংবা যাদের আর কখনো সুস্থ হওয়ার আশা নেই, তাদের অভিভাবকদের কাছে ফিরিয়ে দিতে গেলে ঠিকানা খুঁজে পাওয়া যায় না।

বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ মানসিক হাসপাতালেই কেটে যাচ্ছে এরকম রোগী রয়েছেন অন্তত ২১ জন। তারা প্রতীক্ষা করেন কেউ তাদের ঠিকই একদিন নিতে আসবেন। কিন্তু ওদের কেউ আর নিতে আসে না। অনেকেই প্রতীক্ষা করতে করতে এখানেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ২০১৫ সালে এরকমভাবে মারা গেছেন দুজন।

৫ নম্বর ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন মানসিক রোগী সাইদ হোসেন মানসিক হাসপাতালে ভর্তি হন ১৯৯৬ সালে। তিনি বলেন, ‘খুব ইচ্ছে করে বাসায় যেতে। কিন্তু কেউ নিতে আসে না।’

চিকিৎসকরা জানান, অন্যান্য রোগীদের মধ্যে থাকার কারণে এবং হতাশাগ্রস্ত হয়ে সাইদ হোসেন মানসিকভাবে আবারও অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। সুস্থ হয়েও বাড়ি যেতে না পারার বেদনা এভাবেই ব্যক্ত করেন সাইদের মতো আরও অনেক রোগী।

এ বিষয়ে পাবনা মানসিক হাসপাতালের পরিচালক ডা. শাফকাত ওয়াহিদ বলেন, হাসপাতালে প্রয়োজনের তুলনায় শয্যা সংখ্যা কম। তার ওপর এখানে কেউ রোগী ভর্তি করতে পারলেই আর খোঁজ নেন না। রোগী সুস্থ হলেও বাড়িতে নিতে চান না। বারবার রোগী নিয়ে গিয়ে ফেরত আসতে হচ্ছে। ফলে সরকারি অর্থের অপচয় হচ্ছে।

এসআর/জেআইএম